ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

কলেরা ॥ একাত্তরের এক অজানা ঘাতক

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

কলেরা ॥ একাত্তরের এক অজানা ঘাতক

১৯৭১ সালের জুন মাসে কলকাতা সফরে আসেন লাইফ ম্যাগাজিনের সাংবাদিক জন সার (Jhon Saar) ও ফটোগ্রাফার মার্ক গডফেরি (Mark Godfery) তারা দুজন মিলে একটি গাড়িতে করে ঘুরে বেরিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে। গিয়েছেন সীমান্ত এলাকার ট্রানজিট শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে। প্রত্যক্ষ করেছেন মৃত্যু, অসহায়ত্ব আর মানবিক বিপর্যয়। ১৮ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত হয় লাইফ ম্যাগাজিনের Vol 70 No 23 সংখ্যাটি। ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের কন্যা ট্রিসিয়া লিঙ্কনের কনের সাজে এক রাজকীয় ছবি,White House Bride শিরোনামে প্রকাশিত লিঙ্কন কন্যার এই হাসিমুখ প্রচ্ছদের অন্তরালে ম্যাগাজিনটির ২২ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয়ের গল্প। The Pakistani Refugee Diaster” শিরোনামে সাংবাদিক জন সার তুলে ধরেছেন ভিন্ন এক গণহত্যার ছবি। যেখানে পাকিস্তানীদের গুলিতে সরাসরি হত্যাকান্ডের বর্ণনায়, ভিন্ন এক হত্যাকান্ড, ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের কথা উঠে এসেছে। জুন মাসের মাঝামাঝি জন সার গিয়েছেন করিমপুরে। বৈষ্ণব ভক্তিবাদের প্রবক্তা শ্রী চৈতন্যের জন্মস্থান এই গ্রামে। পাকিস্তান সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এই গ্রামের সীমান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রবেশ করছে ভারতে। পাকিস্তানী বাহিনীর তাড়া খেয়ে, গণহত্যার বর্বরতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে, সহায়সম্বল ছেড়ে এই উদ্বাস্তু জীবন বেছে নেয়া। কিন্তু এই উদ্বাস্তু জীবনে এসেও রক্ষা পেল না শরণার্থীরা। নতুন এক বিপদে তারা জড়িয়ে পড়ল, জড়িয়ে পড়ল নতুন এক অন্ধকারে। তাদের চারপাশে শুধু মৃত্যু। সর্বত্র মৃত্যুর ভয়ঙ্কর থাবায় তারা আতঙ্কিত। সাংবাদিক জন সার করিমপুরের রাস্তায় দেখতে পেলেন অসীম দৈর্ঘ্যরে লম্বা শরণার্থী মানুষের মিছিল। এই সব মানুষ এত বেশি সংখ্যায় মরেছে যে আমরা গুনতে পারিনি। গোনা সম্ভব নয়। একজন স্বেচ্ছাসেবক সাংবাদিক জন সারকে বলছেন, এরা জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। তারা চলছে তো চলছেই। তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত অবসন্ন। তৃষ্ণার্ত হয়ে পথের পাশ থেকে আঁজলা ভরে কলেরাদুষ্ট পানি পান করছে। তারা এত দুর্বল হয়ে পড়ছে যে, আক্রান্ত হওয়ার পর একদিনও টিকতে পারছে না। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। করিমপুরের আশপাশের গ্রামগুলোতে কোনো ডাক্তার নেই। কলেরা ভ্যাক্সিন নেই। নেই কোন প্রতিষেধক ঔষধপত্র। কাছাকাছি কৃষ্ণনগরে একটি হাসপাতাল আছে। হাসপাতালের উদ্দেশে অসুস্থ মানুষ চলেছে মানুষের কাঁধে চড়ে। কেউবা বাঁশের তৈরি টে¤েপারারি স্ট্রেচারে করে। এই হতভাগ্যদের অর্ধেকই শিশু। সাংবাদিক জন সার একটি সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে শিশুকে তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। তার চোখ বড় করে খোলা। তার হাত ঝুলে পড়েছে। নার্স এক পলক দেখেই বলছে, সব শেষ। কিছু করার নেই। মেয়েটি মরে গেছে। একজন ক্লান্ত ডাক্তার বলছেন, এর চেয়ে কুকুর-বেড়ালেরাও ভাল করে মরে। কিছুটা হলেও তারা চেষ্টা তদ্বির পায়। আর এই শরণার্থী মানুষদের কলে পড়া ইঁদুরের মত মরা ছাড়া কপালে আর কিছু লেখা নেই। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে কলেরা ঘাতকের ভূমিকার অবতীর্ণ হয়েছিল। ঠিক কত লোক কলেরায় মারা গিয়েছে কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ৬ জুন দৈনিক কালান্তর লিখছে কলেরা মহামারীতে মৃতের সংখ্যা অগণিত, শুধু নদীয়াতে মারা গিয়েছে ৩০০০। মুর্শিদাবাদে মৃতের সংখ্যা ১০০০। সরকারী হিসাব মতে ১৬ জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৩৪৫৩। ১৫ জুলাই পর্যন্ত সরকারী হিসেবে কলেরায় মৃতের সংখ্যা ৪৫৭৬ জন। যদিও প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এইসময় ১০,০০০ ছাড়িয়ে যায়। সরকারী হিসেবে শুধু ক্যাম্পে মৃতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে শত শত লাশের কোন হিসাব এতে উঠে আসেনি, ৯ জুন যুগান্তর শিরোনাম করে ‘নদীয়াতেই ছাব্বিশ’শ শরণার্থীর মৃত্যু’, এতে দেখা যায় ক্যাম্পে মৃতের সংখ্যা ১০০০ কিন্তু রাস্তাঘাটে বেওয়ারিশ পড়ে থাকা লাশের সংখ্যা ১৬০০। কৃষ্ণনগর-শিকারপুরের রাস্তায় কলেরায় মৃতদেহ আর শকুনের অরুচির বর্ণনা জন সারের রিপোর্টে যা ওঠে এসেছে বাস্তবিকে আরও ভয়াবহ। যুগান্তর লিখছেন, ‘দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা হাজারে হাজারে আসছেন। আসার পথে বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন। তাঁদের পথের মাঝে ফেলে রেখেই আত্মীয়স্বজনরা চলে আসছেন।’ এত বেশি মৃত্যু দেখে যুগান্তরের প্রতিনিধি সংবাদে লিখছেন “অর্ধেক বোধহয় মরে যাবে”। New York times এ প্রকাশিত Sydney Schanberg এর একটা প্রতিবেদন ৯ই জুন ১৯৭১ Palm beach Post পত্রিকায় পুনরায় প্রকাশ করা হয়। টাইমস ম্যাগাজিনে Bengali Refugees : A surfeit of woe শিরোনামে ১৯শে জুন ১৯৭১ এ আরেকটা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। দুই জায়গাতেই কলেরার কথা বলা হয়। বলা হয় প্রথম ধাক্কাতেই কলেরার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। মানুষগুলো হয়তো পাড়ি দিচ্ছে সীমান্তের ওপারে যাবে বলে কিন্তু পথের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়েছে। হিন্দু হলে হয়তো মুখে একটু আগুন দিয়েছে। পুরো শবদাহ হয়নি। বাকিটা কুকুর শকুনের পেটে চলে গিয়েছে। করিমপুর রিফিউজি ক্যাম্পে পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবক ২৪ ঘণ্টায় তিনশ’র মত লাশ দাফন করে যারা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২২শে জুন, ১৯৭১ এ ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজে James Foster এর একটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়। রিপোর্টটির শিরোনামই ছিল ৬০০,০০০ of 5 million Refugees Have died ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১-এ গধী ইবধঃঃরব এর আরেকটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়। যার হেডলাইন ছিল Death reaps a Young hervest. জুন মাসের মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থীর মধ্যে ৬০০০০ শরণার্থীর মৃত্যু একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী জীবনের ভয়াবহতা তুলে ধরে। ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ The New York Times G East Pakistan: In Brief শিরোনামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওখানেও শরণার্থীদের শেষ পর্যন্ত কতজন বেঁচে থাকবে সেটা নিয়ে আশঙ্কা করা হয়। The number of refugees who fled to India has been estimated at 10 million and it is not known how many of these survive or how many will choose to return. মালয়েশিয়ার দ্য স্ট্রেইট টাইমস ৮ জুন লিখেছে কলেরার মহামারীর কথা। সেখানে বলা হয়েছে মহামারীতে শরণার্থী শিবিরে এখন পর্যন্ত মৃত মানুষের সংখ্যা ৮ হাজার। দ্য গ্লবাতে নরওয়ে লিখেছে ৩ লক্ষাধিক শিশু তীব্র অপুষ্টিজনিত মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। দ্য অর্ডিন্যান্স নরওয়ে ২৭ সেপেম্বর লিখেছে শুধু ক্ষুধা ও ঠান্ডায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। The Lancet কে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সবচেয়ে পুরনো মেডিক্যাল জার্নাল। এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক মেডিক্যাল জার্নালও বলা হয়ে থাকে। তাদের রিসার্চ জার্নালে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও সচেতনতা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবির নিয়ে একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তারা তাদের একটি জার্নালে। তাদের ভাষ্য কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপকে নিয়ে, যারা একাত্তরের জুনের শেষ থেকে বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি শুরু পর্যন্ত পাঁচ মাস চালু থাকা একটা রিফিউজি ক্যাম্পের ওপর সার্ভে চালায়। এবং তাদের সার্ভেটি (Relief work in a refugee camp for Bangladesh refugees in India) খুবই বিশ্বাসযোগ্য কারণ সেইসব ডাটা প্রত্যেকটি ঘর থেকে আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সার্ভের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাম্পের জনসংখ্যা, সেখানকার মানুষের বয়সের ধরন আর মৃত্যুহার নিয়ে। তাদের ভাষ্য মতে ১,৭০,০০০ শরণার্থীর ঐ ক্যাম্পে কম করে হলেও ৪০০০ মানুষ মারা যায়। তারা বলেছে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হতে পারে, স্বাভাবিক মৃত্যুকে তারা বিবেচনা করেনি এবং নিহতদের বড় অংশই ছিল শিশু। আরিফ রহমান ‘ত্রিশ লাখ শহীদ বাহুল্য না বাস্তবতা’ গ্রন্থে একাত্তরে শরণার্থী শিবিরে মৃতের সংখ্যা নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন। ‘তবুও অনেক কমিয়ে এই সংখ্যাটাকেই ধ্রুব ধরে যদি শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষদের সংখ্যাটা কত হতে পারে সে নিয়ে ধারণা করতে চাই তাহলে হিসাবটা দাঁড়ায় অনেকটা এরকম ঃ ১,৭০,০০০ মানুষের মধ্যে কমপক্ষে মৃতঃ ৪,০০০ তাহলে; এক কোটি মানুষের মাঝে পাঁচ মাসে ন্যূনতম নিহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে কলেরা ও অন্যান্য রোগে ঠিক কত লোক মারা গিয়েছিল, প্রশ্নটা করেছিলাম উৎপলা মিশ্র। উল্লেখ্য, মিসেস উৎফলা একাত্তরের সেই সময়গুলোতে রেডক্রসের কর্মী হয়ে বালুরঘাট, বসিরহাট, নদীয়াসহ সীমান্ত এলাকায় কাজ করছিলেন। তিনি ঠিক অনুমান করতে পারছিলেন না, বলছিলেন সীমান্ত এলাকাগুলো জুন মাসে লাশের স্তূপে পরিণত হয়। এই সংখ্যা তিন লাখের কম নয়। নদীয়ার মৃণাল দত্ত একাত্তরে কাজ করতেন কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে। একাত্তরে দায়িত্বে ছিলেন কলকাতায়। সারা রাজ্যের শরণার্থী মৃত্যুর হিসাব রাখার দায়িত্ব ছিল তার কাছে। বলছিলেন, একাত্তরের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমার কাছে ৫৮৩৭ জন শরণার্থীর মৃত্যুর রেকর্ড ছিল। তবে আমার কাছে যে তথ্য বিভিন্ন জেলা থেকে আসত তাতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা এর প্রায় পঞ্চাশ গুণ। আমি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম, এতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে তাহলে আপনি কেন মৃত্যুর সংখ্যা চেপে গেলেন। বলছিলেন, সরকারী নির্দেশে। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ৮টি জেলার মধ্যে দার্জিলিং ছাড়া বাকি সাতটি জেলা ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদা, জলপাইগুঁড়ি ও কোচবিহারে একাত্তরে কলেরা মহামারী ঘোষণা করা হয়। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৭ লক্ষ লোককে কলেরার প্রতিষেধক দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নদীয়ায় জেট ইনজেকটারের সাহায্যে কলেরার টিকা দেয়া হয়। একসময় ভয়াবহ রকমের কলেরার টিকার সঙ্কট দেখা দেয়, সেই সময় রেডক্রসের সহায়তায় বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা ও কলেরার চিকিৎসা সরঞ্জাম আসতে শুরু করে। বালুরঘাট, কোচবিহার ও মুর্শিদাবাদের ডোমকলে কলেরার টিকার অভাবে অনেক শরণার্থী মারা যায়। এখানে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তোলে স্থানীয় সাধারণ জনগণ। কলেরা মহামারী ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একের পর এক নোটিস জারি শুরু করে। এই রোগটি ছোঁয়াচে বিধায় সাধারণকে সতর্ক থাকতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেলে মৃতদেহ না পুড়িয়ে কবর দেয়ার আদেশ জারি করা হয়। এবার এই আদেশের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক শরণার্থী মারা যাওয়ার পর মৃতদেহ দাহ করতে না দেয়ার ফলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কলেরা জীবাণুর জন্য দাহের প্রথার মুশির্দাবাদে সরকারী বিধি-নিষেধ জারি থাকায় প্রশাসনের সঙ্গে শরণার্থীদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লাখ লোক চোখ ওঠায় আক্রান্ত, লক্ষাধিক শরণার্থীর কলেরায় মৃত্যু, প্রায় ৫০,০০০ শরণার্থী কলেরা জীবাণু বহন, পাশাপাশি নিউমোনিয়সহ বেশ কয়েকটি মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত পূর্ববঙ্গের শরণার্থীরা। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ এটাকে কীভাবে মেনে নিয়েছেন? কিংবা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে এটার অভিঘাত কী ছিল? মুর্শিদাবাদে সীমান্ত এলাকা কাহারপাড়া। একাত্তরে এই সীমান্ত জনপদে আশ্রয় নিয়েছিল লক্ষাধিক শরণার্থী। ভয়াবহ বন্যা, কলেরাসহ নানাধিক রোগে প্রায় পাঁচ হাজার শরণার্থীর মৃত্যু ঘটেছে মুর্শিদাবাদের জলাঙ্গী, লালগোলা, কাহারপাড়া ও ডোমকলে। জলাঙ্গীতে কথা হচ্ছিল আনিস রহমান, আবু বক্কর, আমির শেখ, আনোয়ার উদ্দীন মন্ডলের সঙ্গে। একাত্তরে এখানে সাহেবরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প গড়ে ওঠেছিল। বন্যায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়, সঙ্গে কলেরা। আনিস রহমান আমাকে নিয়ে যান জলাঙ্গী নদীরপাড়ে, সারি সারি বাঁশঝাড়, সারি সারি কবর। একাত্তরের নীরব ঘাতকের চিহ্ন। আমি জানতে চাইলাম এখানে কত শরণার্থীর কবর আছে। আনিস রহমান বললেন, সেটা সংখ্যায় পরিমাণ করা যাবে না। একটি কবর খুঁড়ে আমরা ২০-২৫ জনকে একত্রে দিয়েছি। আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হলে কবর দেয়ার আর কোন জায়গা জলাঙ্গীতে ছিল না। কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে শত শত মৃতদেহ। নদীয়ার গল্প জন সারের বর্ণনাকে ছাড়িয়ে যায়। শত শত লাশ পড়ে আছে রাস্তায়, এতসব প্রতিকূলতা, ছোঁয়াছে রোগের ভয় সাধারণ লোকজন, স্বেচ্ছাসেবকরা মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে পাশে এসে দাঁড়ায় পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের পাশে। একদিকে কলেরা রোগীদের সেবা, ঔষধ প্রদান অন্যদিকে মৃতদেহের সৎকার। নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। সবকিছুকে উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ একাত্তরে ভিন্ন এক সহায়তা আর অপ্রতিরোধ্য ভালবাসার জন্ম দিয়েছিল। সোমেন গুহরায় একাত্তরের বয়স ছিল ২২ বছর। পড়তেন কলকাতায়, একাত্তরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন নিজ শহর পশ্চিম দিনাজপুরে। বলছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোকজন শরণার্থীদের পাশে না দাঁড়ালে একাত্তরে মড়ক লেগে যেত’। মৃত্যু শুধু বুলেটের বেশে আসেনি তখন, এসেছে বন্যা হয়ে কিংবা কলেরার চেহারায়। সেই সময়ে জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ালেন পশ্চিমবঙ্গের কাঁঠালি গ্রামের নলিনী মোহন বিশ্বাস। লাইফ ম্যাগাজিনের জন সার লিখেছেন - In the village of Kanthalia,a tubby, globe faced man named Nalini Mohan Biswas, welcomed 125 cholera victims into the courtyard of his home when they collapsed while passing through town.Biswas himself was unprotected by a vaccination.Even so, he nursed the stricken refugees so conscientiously that only four died. মানবতা কাকে বলে? শুভবোধের কোন কবচ-কুন্ডল ধারণ করলে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়, নিজে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা জেনেও অজানা-অচেনা শতাধিক মানুষের চিকিৎসায় নিজেকে সঁপে দেয়া যায়? নুরুল আলম নামক এক শরণার্থী তার ক্যাম্প জীবনের বর্ণনায় সে সময়কে তুলে ধরেছেন, ‘ওই ভয়াল পরিস্থিতিতে কিছু ইন্টার্নি ডাক্তারের পেশাগত দায়িত্বের চেয়েও মানবিক মূল্যবোধ যেভাবে আমার কচি মনে নাড়া দিয়েছিল তা জীবনের শেষ মুহূর্তেও ভুলতে পারব না। ওখানে রোগীদের সবাইকে তাঁবুর ভেতর রাখার মতো জায়গা ছিল না। হাসপাতালটির চারদিকে ছিল তাঁবু ঘর, মাঝখানের একটি বড় ফাঁকা জায়গায় ত্রিপালের সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে চলছিল চিকিৎসা সেবা। সেখানেই রোগীর শরীরে দেয়া হচ্ছিল স্যালাইন। ওই সামিয়ানার নিচে চোখ বুলিয়ে দেখা যায়, শত শত কাচের স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। ইন্টার্নি ডাক্তাররা নিরলসভাবে রাতদিন রোগীদের সেবায় নিয়োজিত। একরাশ বিস্ময় নিয়ে দেখি, রোগীরা সারা অঙ্গন জুড়ে পায়খানা করছে, বমি করছে, আর ইন্টার্নি ডক্তাররা হাতে গ্লোভস পরে নির্বিকারভাবে ওই সমস্ত পায়খানা-বমি মেঝে থেকে তুলে তুলে বালতিতে রাখছেন। যেসব কাজ অনেক সময় মায়েরাও সহজে সন্তানদের জন্য করতে চান না, মৃত্যু ঝুঁকি সত্ত্বেও সেসব কাজ সুইপারদের দিয়ে না করিয়ে ডাক্তাররা নিজ হাতে করছেন। এ ধরনের দৃশ্যাবলি দেখার পর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ি, ওই মহান ইন্টার্নিদের কথা মনে পড়লে আজও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁদেরকে তখন মানুষ নয়, ফেরেস্তা মনে হতে থাকে’। শরণার্থী ইস্যুতে জাতিসংঘের টনক নাড়ানোর জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক সহায়তা প্রতিষ্ঠান অক্সফাম এগিয়ে আসে। তারা প্রকাশ করে টেস্টিমনি অব সিক্সটি। ষাট জন বিশ্ববরেণ্য মানুষের সাক্ষ্য। সাক্ষ্যদাতাদের মাঝে আছেন মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সাংবাদিক জন পিলজার, মাইকেল ব্রানসন, নিকোলাস টোমালিন, এন্থনি মাসকারেনহাস এবং আরও অনেকে। বিরাট সেই দলিলে সাংবাদিক সানিকোলাস টেমালিনের লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি; যদি এই শিশুদের অতিরিক্ত প্রোটিন দেয়া না হয়, তাহলে এরা অবশ্যই মারা যাবে। শিশুদের চার ভাগের তিন ভাগ নয় মাসের মধ্যে অবশ্যই মারা যাবে। তার মানে “দশ লাখ শিশু”। ষাটজনের সাক্ষ্য থেকে সিনেটর কেনিডির লেখাটি উল্লেখযোগ্য, সিনেটর কেনিডি বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে যান। তিনি লিখেছেন; গত তিরিশ বছরে পৃথিবী যত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে তার মধ্যে ভায়াবহটি হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্কট। তিনি লিখেছেন সপ্তাহের পর সপ্তাহ গড়াচ্ছে আর মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কেউ কেউ ভারতে যাচ্ছেন আর ৯০ লাখের মধ্যে মাত্র কয়েকশ জনকে খাওয়াচ্ছেন এবং শুশ্রুষা দিচ্ছেন। মরা কত সহজ ছিল মানুষগুলোর কাছে। যেখানে জীবনে আগামী দিনটা কেমন যাবে জানা ছিল না সেখানে বোধহয় মরাটা খুব শান্তির! কতশত দুধের বাচ্চার কপালে জুটেনি মায়ের বুকের একফোঁটা দুধ। এ দৃশ্য কি চোখে দেখার! তবুও দেখতে হয়েছিল একটা সময়ে। একাত্তরে। সেরকমই একটা ঘটনার খানিকটা তুলে দিচ্ছি- “এতো বেশি সংখ্যায় হাড্ডিসার শীর্ণশিশু মায়ের স্তন চুষছে এবং তাদের লোমচর্ম বৃদ্ধের মতো দেখাচ্ছে। এ ধরনের জিরজিরে শিশু কোলে নিয়ে স্তন্যপানের ব্যাপারটায় মায়েরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ দৃশ্যটায় তারা অকারণে আঁতকেও উঠছে না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে যদি শিশুটি না খেতে চায়, যে কোন তরল প্রত্যাখান করে, তাহলে তাকে আর তোষামোদ না করেই ফেলে রাখা হচ্ছে।” শরণার্থী শিবিরের এই ঘটনাটি বিবৃত করেছেন ডাঃ মেয়ার কারিতাস।
×