ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ ঘটনাই তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহির্প্রকাশ

বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পরিকল্পিত সহিংসতা ঘটাচ্ছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

 বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পরিকল্পিত সহিংসতা ঘটাচ্ছে বিএনপি

শংকর কুমার দে ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পরিকল্পিতভাবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছে বিএনপি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। উদোরপি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলো আওয়ামী লীগের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতায় থাকতে দেশব্যাপী যে সন্ত্রাসী, ক্যাডার গড়ে তুলেছে তারা আবার গোপন আস্তানা থেকে প্রকাশে এসে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলগুলোর সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ত্যাগী নেতাদের বঞ্চিত করে সুযোগ সন্ধানী সুবিধাভোগীদের ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে সহিংসতার ঘটনা উত্তেজনায় রূপ নিয়ে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চার দিন গত ৮ ডিসেম্বর আগে মুন্সীগঞ্জ-১ (সিরাজদিখান-শ্রীনগর) আসনে বিএনপির প্রার্থী ও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের গাড়িবহরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোঃ আব্দুল্লাহর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধর জের ধরে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার আগে মনোনয়ন লাভের ধারাবাহিকতায় আব্দুল্লাহ গ্রুপ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কোচিয়ামোড়া এলাকায় সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচী পালন করে। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই সহিংস হামলার ঘটনার আগে বিএনপির চেয়ারম্যান খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিসের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ, ঘেরাও, বিক্ষুব্ধদের সেøাগানের ঘটনাগুলো এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপির প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ধানের শীর্ষ মনোনয়ন লাভের পর প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোঃ আবদুল্লাহর মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় সংঘটিত সহিংস ঘটনায় অন্তত ৬ জন আহত হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সিরাজদিখান থানার ওসি মোঃ ফরিদউদ্দিন বলেছেন, বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ আব্দুল্লাহর মধ্যে বিরোধের জের ধরে আব্দুল্লাহ গ্রুপ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কোচিয়ামোড়া এলাকায় সড়ক অবরোধ, মানববন্ধনসহ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচী পালন করে। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। তবে হামলার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করেনি। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের এপিএস ওমর ফারুক এ বিষয়ে অবাক বিস্ময়ের অভিযোগ করে জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন তার কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে সিরাজদিখানের কোচিয়ামোড়া কলেজ গেট এলাকায় গণসংযোগ করতে যান। এ সময় নৌকার প্রার্থী মাহী বি চৌধুরীর ২০-২৫ জনের একদল যুবক গাড়িবহরে হামলা ও গুলিবর্ষণ করে। গত ৮ ডিসেম্বরের বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ঘটনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সাবেক রাষ্ট্রপতি ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারার ওপর চাপাতে রবিবার বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাহী বি চৌধুরীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। রবিবার রাতে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা মহাজোটের প্রার্থী মাহী বি চৌধুরী এবং তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের ওপর হামলা চালিয়েছে। বিকল্পধারার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান বিবৃতিতে বলেছেন, রবিবার রাত ৯টার দিকে দলীয়প্রধান সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার মজিদপুর দয়হাটা গ্রামে পারিবারিক এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানমঞ্চের সামনে থেকে একদল লোক মঞ্চে উপস্থিত মাহী বি চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তাদের রক্ষার জন্য বিকল্পধারার নিবেদিত কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় প্রতিরোধকারীদের কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন আবদুল মান্নান। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিগত দুই বছরে সন্ত্রাসী কর্মকা- অনেকটা চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু নির্বাচনের কারণে বিএনপি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আবারও তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সরকারের শক্ত পদক্ষেপের কারণে দেশে বেশি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। দেশে সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে ঘটে থাকে এবং আমি আশঙ্কা করা হচ্ছে, নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যের বহির্প্রকাশ ঘটছে, যা এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে পারে এবং এসব ঘটনার দায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ওপর বর্তানোর চেষ্টা করা হতে পারে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের বানারহাটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে ৪টি গাড়ি ভাংচুর হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি ইউনিয়নের বানারহাট এলাকায় নির্বাচনী গণসংযোগে গেলে তার গাড়িবহরে এ হামলা হয়। মির্জা ফখরুল ওই এলাকায় নির্বাচনী পথসভা করছিলেন। এ সময় একদল লোক হামলা চালিয়ে দুই-তিনটা গাড়ির কাচ ভেঙ্গেছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ বাসভবনে যাচ্ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পথে সদর উপজেলার ডানারহাট এলাকায় পথসভার উদ্দেশে তিনি গাড়ি থামালে দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালায়। তারা ইটপাটকেল ও লাঠিসোটা দিয়ে হামলা করে। এতে মির্জা ফখরুলের কালো হায়েস গাড়িসহ আরও ৪টি গাড়ি ভাংচুর করা হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনী প্রচার হিসেবে ঠাকুরগাঁওয়ে গণসংযোগ করছিলেন। ঠাকুরগাঁও পুলিশ বলেছে, বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর বিএনপির বহু নেতাকর্মী মারাত্মক ক্ষুব্ধ। তারই বহির্প্রকাশ ঘটে থাকতে পারে এ হামলার ঘটনাটি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিএনপিকে বাংলাদেশে একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে অভিহিত হয়েছে কানাডার আদালতে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের বিচরণ বেড়েছিল। তিনি বলেন, নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সমতল ভূমি আছে। নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রচারে কোন বাধা নেই। বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিজেরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের ওপর ঢালাও অভিযোগ করে আসছে, যা সঠিক নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব কিছু এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই প্রশাসনে রদবদল আর নির্বাচনী পরিবেশ অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের অধীনে আছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার কবিরহাট বাজার জিরো পয়েন্টে বিএনপি প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পূর্ব ঘোষিত পথসভায় হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হামলায় ঘটনায় প্রায় ৩০ জন আহত, কমপক্ষে ২৫টি দোকানপাট, ঘরবাড়ি অফিস ভাংচুর হয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পথসভা উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল সহকারের সভাস্থলে সমবেত হতে থাকে। এ সময় বিএনপি সমর্থকরা জিরো পয়েন্ট থেকে একটি মিছিল বের করলে হামলার ঘটনা ঘটে। কবিরহাট বিএনপি অভিযোগ করেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা মিছিলে হামলা চালায়। এরপর শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। কবিরহাট থানার পুলিশ বলেছেন, হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থলে গেছে পুলিশ। হামলাকারী যে দলেরই হোক না কেন পুলিশ গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদিকে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের বিএনপি প্রার্থী শরীফুজ্জামান শরীফের গাড়ি বহরে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার রাত ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সীগঞ্জ পশুহাট এলাকায় এ হামলার ঘটে বলে দাবি করেছে বিএনপি। হামলাকারীরা দুটি মাইক্রোবাস ভাংচুর করেছে। বিএনপি প্রার্থী শরীফুজ্জামান শরীফ গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাত ৯টার দিকে আলমডাঙ্গা থেকে ফেরার পথে একদল দুর্বৃত্ত তাদের গাড়িতে হামলা চালায়। তাদের ধারণা, দুর্বৃত্তরা হত্যার উদ্দেশে এ হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনার পর বিএনপি নেতারা চুয়াডাঙ্গা জেলা রিটার্নিং অফিসার ও পুলিশ সুপারকে টেলিফোনে ঘটনা জানিয়েছে বলেও জানান তিনি। চুয়াডাঙ্গা পুলিশ বলেছেন, বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ও মনোনয়ন বাণিজ্যের জের ধরে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপির মনোনয়নদানের জন্য অঘোষিত একটি সিন্ডিকেট হয়েছে, যারা প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজেদের বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছেন, তাদের দায়ী করা হচ্ছে সুবিবেচনা না করার অভিযোগেও। এসব কারণে দলে দীর্ঘদিন সক্রিয় ও আনুগত্য প্রদর্শন করেও সংস্কারপন্থীদের কাছে মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। যাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতোমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে গুলশানে বিএনপির চেয়ারম্যানের অফিসে দিনভর বিক্ষোভ, ইট-পাথরের ঢিলে ভেঙ্গেছে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়। তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এই বিক্ষোভ রবিবারও স্থায়ী হয়েছে দিনভর। গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন নেতাকর্মীরা। এখন এসব ঘটনা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
×