ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুক্তরাষ্ট্রে মওদুদের স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে ॥ এফবিআই

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

যুক্তরাষ্ট্রে মওদুদের স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে ॥ এফবিআই

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আইনী প্রতিষ্ঠান মওদুদ আহমদ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস নাইকোর পরামর্শক ছিল। একই সময়ে মওদুদ আহমদের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে ৪ চার লাখ ডলার মূল্যের একটি বাড়ি ক্রয় করেন। কানাডার আরসিএমপি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। খবর ওয়েবসাইটের। এফবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা তার দেয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, ছাতক পূর্ব গ্যাস ক্ষেত্রটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে চায়নি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা। তারা নাইকো পশ্চিম গ্যাসক্ষেত্রের সঙ্গে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র আকারে কোম্পানিটির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার এ্যাগ্রিমেন্ট (জেভিএ) স্বাক্ষর করতে চায়নি। ২০০১ সালের ২৪ ও ২৫ জুন বাপেক্স-নাইকো জেভিএ চূড়ান্তকরণ সভায় ছাতক পূর্ব গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। নাইকোকে বাপেক্স জানায়, সরকারের অনুমোদিত ‘প্রসিডিউর ফর ডেভেলপমেন্ট অব মার্জিনাল/এ্যাবানডোনড গ্যাস ফিল্ডস’ এ মার্জিনাল/পরিত্যক্ত গ্যাস ফিল্ডস-এর যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে ছাতক পূর্বকে মার্জিনাল বা পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বাপেক্স কমিটি এই বিষয়ে বিস্তারিত নাইকো প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় জানায় এবং বলে ছাতক পূর্ব গ্যাস ক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত বলার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু নাইকো ছাতক পূর্বকে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। এই বৈঠকে ছাতক গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই বিষয়ে পেট্রোবাংলা/মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে বলে বাপেক্সের পরিচালক (অপারেশন)-কে অবহিত করেন। ২০০২ সালের ৮ আগস্ট বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক চিঠিতে নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্টকে জানান, নাইকোর প্রস্তাব অনুসারে ছাতক পূর্বকে পরিত্যক্ত গ্যাস ক্ষেত্র হিসেবে বাপেক্স-নাইকো জেভিএ-তে অন্তর্ভুক্ত করার কোন সুযোগ নেই। এই চিঠির সূত্র ধরে ১০ আগস্ট নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেড জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে নাইকো ছাতক পূর্বকে পরিত্যক্ত হিসেবে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করে বাপেক্স-নাইকো জেভিএ বাস্তবায়নের আহŸান জানায়। একই দিন মওদুদ আহমদ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস বাপেক্স-নাইকো জেভিএ নিয়ে একটি আইনী অভিমত দেয়। এতে বলা হয়, ছাতক গ্যাস ক্ষেত্র থেকে পূর্বকে বাদ দেয়া ও পরিত্যক্ত ঘোষণা না করা বেআইনী হবে। ওই চিঠিতে, এ বিষয়ে দ্রæত পদক্ষেপ ও ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন রোধ করতে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। নাইকোর দুর্নীতি তদন্তকারী এফবিআই কর্মকর্তা ডেবরা গ্রিফিতি মওদুদের ভূমিকার বিষয়ে তার সাক্ষ্যে বলেছেন, ২০০১ সালের শেষের দিকে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের অবস্থান ছিল নাইকোর সঙ্গে ছাতক পূর্ব গ্যাসক্ষেত্র ছাড়া জেভিএ স্বাক্ষরিত হতে পারে। তা হতে হবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে। ২০০৩ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স একই অবস্থান নিয়েছিল। ছাতক পূর্ব গ্যাসক্ষেত্র ছাড়া জেভিএ স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে নাইকো। এক্ষেত্রে যদি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো, তাহলে যেকোন দরপত্রদাতার কাছেই নাইকো হেরে যেত। কারণ তারা আর্থিক ও কারিগরি দিক দিয়ে যোগ্য ছিল না। এফওইউ’র একটি আইনী ব্যাখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়ার আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের অবস্থান পরিবর্তন করান। আইনমন্ত্রী হিসেবে দেয়া আইনী অভিমতে যেভাবে উল্লেখ করেছেন অনুসন্ধান করা হয়নি, এমন কোন গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত হিসেবে সিদ্ধান্ত দেয়ার পারদর্শিতা নেই মওদুদ আহমদের। তিনি ছিলেন নাইকোর সাবেক আইনজীবী। আইনমন্ত্রী থাকার সময়ও তার প্রতিষ্ঠান মওদুদ আহমদ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস নাইকোর প্রতিনিধিত্ব ও অর্থ গ্রহণ করে। এফবিআই’র তদন্তে পাওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে ডেবরা তার সাক্ষ্যে বলেছেন, মওদুদ আহমদ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আইনমন্ত্রী ছিলেন। নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, ফার্স্ট ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০২ সালের ১৫ জানুয়ারি নাইকো মওদুদ আহমদের এ্যাকাউন্টে ৮ হাজার ৩১৫ ডলার পাঠায়। ওই সময় আইনমন্ত্রী হিসেবে মওদুদ আহমদ এক বছর হলো দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০২ সালের আগস্ট মাসে মওদুদ আহমদ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটস একটি চিঠি পাঠায়। যেখানে ছাতক পূর্বকে ছাতক গ্যাস ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করার যুক্তি তুলে ধরা হয়। ২০০৩ সালের ২৫ আগস্ট আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ এক আইনী অভিমতে উল্লেখ করেন, ছাতক পূর্ব ছিল পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র। আমি জানতে পেরেছি এই অভিমত ছিল বাপেক্সের ভূ-তত্ত¡বিদদের মতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাদের দাবি, পূর্ব ক্ষেত্রটি অনুসন্ধান করা হয়নি। ফলে এটাকে পরিত্যক্ত ক্ষেত্র বলা যায় না। তাই, সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে কোম্পানিটির স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়ে নাইকোর কাছ থেকে অর্থ পাচ্ছিলেন মওদুদ। আমার কাছে নথি রয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, ওই সময়ের মধ্যে মওদুদের স্ত্রী হাসনা যুক্তরাষ্ট্রে ৪ চার লাখ ডলার মূল্যের একটি বাড়ি কিনেছেন। ওই সময়ে মওদুদ আহমদের সরকারী ভাতা ছিল প্রায় সাড়ে ৯ হাজার ডলার। নাইকোর পক্ষে মওদুদের ভ‚মিকার কথা কানাডার তদন্তেও উঠে এসেছে। তদন্ত কর্মকর্তা লয়েড স্কোয়েপ তার সাক্ষ্যে বলেছেন, কাশেম শরিফ উল্লেখ করেছেন যে, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী অন্তত ১০ বার পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে নাইকোর প্রকল্পটি আটকে থাকার কারণ জানতে চেয়েছেন। কাজটি আটকে ছিল একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে, আর সেটি হলো ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের পূর্ব ও পশ্চিম বøকের বিষয়ে দ্বিমত। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স সম্পূর্ণভাবে নাইকোর বিরুদ্ধে ছিল। শেষ পর্যন্ত কামাল সিদ্দিকী (তৎকালীন মুখ্য সচিব) পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানকে ডেকে পাঠান এবং বলেন তাকে বিষয়টি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান যদি মনে করেন, ছাতক গ্যাসক্ষেত্র নাইকোকে দেয়া উচিত নয়, তাহলে তাকে তার আপত্তির কারণও জানাতে হবে। কাশেম শরিফের জবানবন্দীর বরাতে কানাডার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, এরপর কাশেম শরিফকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ফোন করে বলেন, তার পক্ষে শুধু একটা কাজই করা সম্ভব আর তা হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আইনগত বৈধতার বিষয়ে অভিমত নিয়ে আসার পরামর্শ দেয়া। এর আগে বাপেক্স-পেট্রোবাংলা প্রকল্পটিতে সম্মত হবে না। কাশেম শরিফ জানিয়ে দেন, ছাতকের পূর্ব বøক না পেলে নাইকো প্রকল্পটি করবে না। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় তাদের অভিমতে জানায়, ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে পূর্ব বøককে আলাদা করার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়।
×