ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরাও কেন ভুল আদর্শে বিশ্বাসী?

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরাও কেন ভুল আদর্শে বিশ্বাসী?

’৭১-এর মুুক্তিযুদ্ধ অসংখ্য গৌরবগাথার জন্ম দিয়েছিল, যাতে রয়েছে রাজাকার পিতাকে পুত্র, কোথাও কন্যার হাতে নিহত হওয়ার সত্য ঘটনা। কোথাও তারামন বিবিদের মতো নারীদের, কিশোর গ্রাম্য ছেলেদের পাকিস্তানী সেনাদের অবস্থান, তাদের হামলার প্ল্যানের তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়া, রাইফেল-বন্দুক লুকিয়ে রাখা, শাক-সবজির নিচে অস্ত্র লুকিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়া, খান সেনাদের গ্রামে পৌঁছানোর আগাম খবর দেয়া, এমনকি খান সেনাদের প্রলুব্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সে ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়ার জন্য গ্রেনেড, বোমা-টাইমবোমা লাগানোর সময় নিজেকেসহ ওই ক্যাম্পের ধ্বংস সাধন, এমন হাজারও দেশপ্রেমমূলক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিল। তাছাড়া, অনেক নারী, তারামন বিবির মতো রাইফেল হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। আমাদের লাখ লাখ কৃষক-সন্তান, শিক্ষিত সেনা, পুলিশ, ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবীদের পাশে মহান মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল। তাদের ত্রিশ লাখ আত্মত্যাগ করে, চার লাখ নারী সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই বাঙালী জাতিকে চিরদিনের জন্য ঋণী করে গিয়েছে। যে ঋণ কোন কিছু দিয়েই আমরা শোধ করতে পারব না। এই স্বাধীন দেশে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা-রক্ষাকর্তা জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিল বলে যে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত নাগরিক হওয়ার কথা ছিল, তারা হয়ে গেল সম্মান-অর্থ-পুরস্কার-জীবিকাহীন। অন্যদিকে যে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে দ-িত হওয়ার কথা ছিল, তাদের ’৭১-এর লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ, যে সম্পদের ওপর ভিত্তি করে আরও ধন-সম্পদ-বাড়ি-গাড়ি-পুত্র-কন্যাদের উচ্চশিক্ষা হয়েছিল, যা হওয়ার কথা ছিল না, তাদেরই সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব থাকার কথা ছিল। কথা ছিল ভাল জীবিকা দ্বারা মুক্তিযোদ্ধা ও তার সন্তানরা হবে উচ্চশিক্ষিত, বিত্তবান, সচ্ছল। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সবটাই উল্টে গেল। রূপকথার সেই গল্পের মতো- ‘রানী হলো দাসী, আর দাসী হলো রানী’ এমনটিই ঘটল দুর্ভাগা এদেশে। এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে ঘটেনি বলেই সম্ভবত অন্য দেশের রাজনীতিক-কূটনীতিকরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনকারী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী দলের নেতাকর্মীদের এক সমান গণ্য করে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধপন্থী-মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিকদের অন্যায়, অন্যায্য এক চরম বৈষম্যের মুখে তারা ঠেলে দিয়েছে। অথচ ইউরোপের কোন দেশ হিটলারের জামায়াতের মতো, জিয়া, খালেদা, তারেকের বিএনপির মতো হিংস্র হত্যার রাজনীতি করা নাজি বাহিনীকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমান ভাবা দূরে থাক, নাজি বাহিনীর নেতাদের বিচার এখনও ইউরোপে চলমান আছে এবং তাদের কোন নাগরিক অধিকার নেই। তারা নির্বাচনে প্রার্থী বা ভোটার হতে পারে না। অথচ বিপরীতে, ইউরোপীয়রা আমাদের দেশের স্বাধীনতার শত্রু-যুদ্ধাপরাধীদের এবং তাদের সুরক্ষা দাতা দলের নেতা খালেদা-তারেকের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দেনদরবার করে চলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকার জামায়াত ও বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল, তারেককে রাজনীতির দুর্বৃত্ত গণ্য করে অনেক দেরিতে হলেও একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দিয়েছে, যা বাঙালীদের অনেকটা স্বস্তি দিয়েছে। ইউরোপীয়রা ’৭১-এ জামায়াতের নেতাকর্মীদের হত্যাযজ্ঞ দেখেছে। দেখেছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যায় সম্পৃক্ত জিয়াকে খুনীদের দলনেতা হিসেবে তাদের ‘গো এহেড’ বলে ক্লিয়ারেন্স দিতে দেখেছে, দেখেছে খালেদা-নিজামী-তারেকের শাসনামলে বাংলাভাইসহ অসংখ্য জঙ্গী ও জঙ্গীদল, এমনকি ভারতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী উলফা দলের নিরাপদে ভারতবিরোধী নাশকতা কার্যক্রম, জেএমবি জঙ্গীদলের নির্বিঘেœ প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধপন্থী নেতাকর্মীদের হত্যা, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে বোমা হামলা করা, আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রথম সারির নেতা-নেত্রীদের হত্যার লক্ষ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংঘটন করা, যার বিচারে বহু ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা। ২০০৫ সালে সাংসদ, প্রখ্যাত কূটনীতিক-মুক্তিযোদ্ধা শাহ কিবরিয়াকে হত্যা এবং হিন্দু, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নজিরবিহীন ধর্ষণ-হত্যা-লুট, নির্যাতন, গ্রামত্যাগ ও দেশত্যাগে বাধ্য করার হাজার হাজার ঘটনা বিএনপির উদ্যোগে ঘটেছিল। এর পাশে আছে লাখো কোটি টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনাবলী। ২০১৪-১৫ সালের খালেদা-তারেক কর্তৃক পেট্রোলবোমা হামলায় দুই শ’র বেশি ট্রাক, বাস-সিএনজি-ট্রেন চালক ও যাত্রী হত্যাও তারা দেখেছে। গুলশানে হোলি আর্টিজান ক্যাফে হামলা, প্রগতিশীল তরুণ, গণজাগরণ কর্মী, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রকাশক, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, পুলিশ হত্যা কি ইউরোপীয়রা দেখেনি? এদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চাইলে তো জেল থেকে খুনী-হত্যাকারী-দুর্নীতিবাজদের মুক্তি দিয়ে সাংসদ করার সমান অপরাধ করতে হয়। তাছাড়া, এরা তো আদালতে খালেদার নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করতে করতে ১০/১২ বছরে মাত্র কয়েকটি মামলা শেষ করতে পেরেছে এবং রায়ে খালেদা ও তারেকের দুর্নীতি ও হত্যায় সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়েছে। ইউরোপে কি দুর্নীতি ও হত্যাকা-ে দ-িত অপরাধীর নির্বাচনে প্রার্থী বা ভোটার হতে পারে? প্রশ্ন জাগে মনে- কেন ওরা দুর্নীতি ও হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত প্রমাণিত অপরাধী খালেদা, তারেকের প্রতি এত দুর্বল? কেনইবা বার বার কূটনীতিকরা প্রটোকল ভেঙ্গে বিএনপিসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সভা করে? এটি কি তাদের পক্ষে সীমা লঙ্ঘন নয়? ইংল্যান্ডে বিলাসী জীবনযাপন করছে যে দুর্নীতি ও হত্যাকা-ে জড়িত তারেক, তার মতো ইউরোপের কূটনীতিকদের স্বদেশী কোন প্রমাণিত অপরাধী কি ঢাকায় তাদের সরকার এবং কূটনীতিকদের নাকের ডগায় রাজকীয় বিলাসী জীবনযাপন করতে পারবে? যা হোক, ফিরে আসি যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের প্রসঙ্গে। আমি ভেবেছিলাম, যুদ্ধাপরাধী একজন ব্যক্তিই হয়, তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও দ্বিতীয় প্রজন্মের সদস্যরা যুদ্ধাপরাধী হবে- এ ছিল আমার জন্য অবিশ্বাস্য এক আঘাত। কারণ, যুদ্ধাপরাধী পিতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বহু পুত্র, কন্যা, স্ত্রীর কথা আমরা জেনেছি, যাদের জন্য গর্ববোধ করতাম। আমরা সন্তান হিসেবে আমাদের দেশপ্রেমিক বাবা, মা’র কত ছোটখাট কাজের বিরোধিতা করতাম, কোন্টা করলে ভাল হবে, সে পরামর্শও দিতাম। সেই সব অতি প্রাচীন, অচল, অনাধুনিক, অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার ধারক-বাহক যে হবে না তাদের এ প্রজন্মের সন্তানরা, তা বিস্ময়কর বৈকি। যুদ্ধাপরাধীদের এই আজকের শনি গ্রহের, মঙ্গলের, চাঁদের, শেষ পর্যন্ত সূর্যের কাছে মহাকাশযান পাঠিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চমকপ্রদ তথ্য জেনে যখন তাদের উচ্ছলিত, আনন্দিত হয়ে এসব অভিযাত্রার ফল জানার কৌতূহলে ব্যগ্র হওয়া, মানুষের জ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উত্তরণ দেখে গর্ববোধ করার কথা, যেমন আমি হচ্ছি, তা না হয়ে তারা ওই পচন ধরা, ধ্বংসের কাছাকাছি এক অচল বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে আবার নির্বাচনও করছে দেখে চরম দুঃখিত হলাম এই ভেবে যে, পৃথিবীর এই বর্তমান মুহূর্তে এই যে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে আমরা প্রায় অবিশ্বাস্য গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল, রোগ-জীবাণু, রোগের প্রতিকারের আবিষ্কার জেনে নিজেকে ভাগ্যবান ভেবে অনাস্ব^াদিত পূর্ব এক গভীর আনন্দে ভাসছি, তখন এই এত অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সে আনন্দ থেকে নিজেরাই নিজেদের বঞ্চিত রাখল এবং ক্ষুদ্র হয়ে গেল ভেবে সত্যিই দুঃখবোধ না করে পারছি না। আমি ভাবিনি যুদ্ধাপরাধীদের স্বদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা যে কত বড় ঘৃণিত পাপ কাজ, তা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে না। ভাবিনি যুদ্ধাপরাধীর পুত্র-কন্যারাও সেই কলুষিত বীজ বহন করার জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হবে। আমার বাল্যবেলার সন্ধ্যাগুলোতে লম্বা বারান্দায় হাঁটতে থাকা বাবার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে আকাশ, নক্ষত্র দেখার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। আকাশের সব নক্ষত্রপুঞ্জ ছিল আমার নখদর্পণে। বাবা যখন আমার বিয়ের কথা ভাবছে তখন আমি হঠাৎ বলে উঠেছিলাম, আমি নাসায় কাজ করব। বিয়ের পরদিন রাতে জানালায় আকাশের চাঁদের দিকে চেয়ে থাকা বধূকে কি যেন বলেছিল নতুন বর, আমি ত্বরিত জবাব দিয়েছিলাম, ‘আমার খুব ইচ্ছা হো চি মিনের ভিয়েতকংদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, ওদের সেবা করব। ওরা কেমন আছে সেটা ভেবে উদ্বিগ্ন হচ্ছি।’ এতখানি না হলেও, ওরা স্বাধীন দেশের বেনিফিট পেয়ে স্বাধীনতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে না, এও কি হতে পারে। এ ঘটনা বাঙালীর জন্য চরম দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক এবং অবিশ্বাস্য। লেখক : শিক্ষাবিদ
×