ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১০ ডিসেম্বর ২০১৮

 গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ গত ১০ বছরে ধারাবাহিক সময়ে দেশের অর্থনীতি উন্নত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। তবে এই উন্নতি বিভাজিত। ফলে বৈষম্যও বেড়েছে। অর্থনীতির আকার বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি টেকসই মান। এখন সময় এসেছে এই গুণগত মান নিশ্চিতের। এজন্য আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বড় বড় আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির বাইরে নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষা, বেকারত্ব ও বৈষম্য কমানোর পূর্ণ রূপরেখা চায় গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এ লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। রবিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সিপিডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, প্রথমবারের মতো টানা দশ বছর দেশ চালাচ্ছে একই সরকার। তাই, এই লম্বা সময়ের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে, নেতৃত্ব নির্বাচনে আবারো সুযোগ আসছে সাড়ে দশ কোটি ভোটারের সামনে। গেল এক দশকে মাথাপিছু আয়, দৃশ্যমান প্রকল্প কিংবা বাজেটের আয়তনসহ মোটা দাগে অর্থনীতি এগিয়েছে অনেকখানি। সেই সঙ্গে পুঞ্জীভূত হয়েছে বেশকিছু সংকটও। তাই আসছে নির্বাচন সামনে রেখে দেয়া ইশতেহারে একটি সুষম উন্নয়নের বাংলাদেশ নির্মাণে জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাস চায় সংস্থাটি। বর্তমান সরকারের কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে সিপিডি। সেগুলো হচ্ছে প্রথম পাঁচ বছরের চেয়ে দ্বিতীয় পাঁচ বছরে কাঠামোগত পরিবর্তন এবং বাস্তবায়নের গতি ছিল কম। অর্থনীতিতে বৈষম্য বেড়েছে আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে। ঘাটতি ছিল নতুন নীতিগ্রহণ ও উদ্যোম বাস্তবায়নে। যার কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা না থাকাকে। এছাড়া নিয়মের বাইরে নির্বাচনী ব্যয়কে নতুন বিনিয়োগ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, এর ফলে পিছিয়ে পড়ছে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা। যাকে গণতন্ত্রের জন্য অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, গত ১০ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। অর্থনীতির ব্যাপ্তি বিস্তৃত হয়েছে। বিনিয়োগ বেড়েছে। জ্বালানি খাতে বড় বিনিয়োগের ফলে আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও বিপুল বিনিয়োগ এসেছে। এক কথায় দেশের অর্থনীতির ইতিবাচক উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনীতির এই উন্নতি নিষ্কলুষভাবে যে হয়েছে তা কিন্তু নয়। অর্থনীতির এই উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুণমত অবনমন হয়েছে। বিভাজিতভাবে বৈষম্যের ধারা দ্রুততম হয়েছে। সরকারের নতুন উদ্যোগ ও উদ্যোম গ্রহণের ক্ষেত্রেও ঘাটতি দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০১৪-১৫ সালের পর থেকেই এই ধারা লক্ষ্য করা গেছে। এই নেতিবাচক ধারা সম্পর্কে ড. দেবপ্রিয় বলেন, এর কারণ নতুন উদ্যোক্তা তৈরি না হওয়া এবং কর্মসংস্থানের অভাব। যা তৈরি হয়েছে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কমে যাওয়া, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা না থাকা ও অর্থনীতির গুণগতমানের পতন হওয়ায় এটা হয়েছে। একই সময়ে অর্থনীতির ভাল ও মন্দ দুই রূপ তুলে ধরাই সিপিডি’র এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। ড. দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচন আসন্ন। অথচ এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। এটা উদ্বেগের বিষয়। এজন্যই এ আয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির যে কার্যক্রম, তাতে মূল দলগুলোর অর্থনৈতিক দর্শন প্রায় সমান। পার্থক্য কেবল কী পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। তাই আমরা চাই এবারের নির্বাচন উপলক্ষে দলগুলো তাদের ইশতেহারে ঘোষণা দিক কিভাবে তাদের ভিশন বাস্তবায়িত হবে। বাস্তবায়নের জন্য কী প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো হবে তাও তাদের বলতে হবে। তিনি বলেন, এইসব কথা বলার মানে এই নয় যে, যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তাকে ছোট করা। উন্নয়ন হয়েছে। সামগ্রিক ভাবেই হয়েছে। তবে বিভাজিত বৈষম্যও তৈরি হয়েছে ব্যাপক। তা শহর ও গ্রামের মধ্যে যেমন, তেমনি নারী ও পুরুষের মধ্যে, বয়স্ক ও তরুণের মধ্যে, সংখ্যালঘুর মধ্যে, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ইত্যাদি। এখন প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে বৈষম্য কমাতে হবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। সিপিডির এই ফেলো বলেন, এজন্য বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তা যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে, তেমনি সরকারী পর্যায়েও। কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। শ্রমঘন শিল্পায়ন লাগবে। কেবল তা রফতানির জন্য নয়। স্থানীয় বাজারের জন্য শিল্পায়ন প্রয়োজন। কৃষিপণ্যের প্রণোদনা দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পায়ন ঘটাতে হবে। কৃষিতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। লাইভস্টক ও ফিশারিতে সম্ভাবনা তৈরি করে কাজে লাগাতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থান ঘটাতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য কমাতে হবে। ভৌত অবকাঠামো সহজলভ্য করতে হবে। কী দামে অবকাঠামো সুযোগ ও জ্বালানি ব্যবহার করা যাচ্ছে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। কর আহরণ বাড়াতে হবে। কেবল আয়করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সম্পদের ওপর কর আরোপ শুরু করতে হবে। জ্বালানি খাতে ক্রস ব্রিডিং করতে হবে। এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ব্যাংকিংখাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। রেমিটেন্স প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পগুলোতে বাস্তবায়ন ব্যয় কমিয়ে তা বাস্তবসম্মত করার পরামর্শ দিয়ে ড. দেবপ্রিয় গত সময়ের বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের কথাও বলেন। দেবপ্রিয় বলেছেন, নির্বাচনী ব্যয় এখন অনেক যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করছে। তার এই ব্যয় দিয়ে নির্বাচনে অংগ্রহণের সামর্থ্য নেই। কিন্তু নির্বাচনী ব্যয়টাই এখন গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হচ্ছে কি না, সেটা আমাদের বিবেচনা করার সময় হয়েছে। নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী আরও গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া জরুরী। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে, ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা এবং উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শও দেন তিনি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, হয়তো নির্বাচনী ইশতেহারে উনারা (রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা) অনেক গগনস্পর্শী উন্নয়ন আকাক্সক্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু সেটাকে অর্জন করার পদ্ধতি এবং অর্থায়নের সুযোগ উনাদের একই সঙ্গে বলতে হবে। অনষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশ থেকে সম্পদ যে পাচার হচ্ছে, জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে এটাকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, পাচার হচ্ছে মূলত বিভিন্ন রকম দুর্নীতি ও সাধারণ জনগণের অর্থ লুট করার পর। এছাড়া নির্বাচনের আগে আমদানির নামে অর্থপাচার ঠেকাতেও সতর্ক থাকার কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, রিসার্চ ফলো তৌফিক ইসলাম খান প্রমুখ।
×