ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত গরিব আর গরিব হচ্ছে নিঃস্ব

মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়ে ২৩শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১০ ডিসেম্বর ২০১৮

 মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়ে ২৩শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে

নিখিল মানখিন ॥ দেশের মানুষের মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বেড়ে প্রায় ২৩শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে খরচ করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, তা দেশের সমষ্টিগত অগ্রগতির অন্তরায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে থাকে। সরকারী হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যের এবং ৩০ শতাংশ বেডের জন্য সামান্য ভাড়া নির্ধারিত আছে। এছাড়া রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রোগীকে স্বল্প পরিমাণ ইউজার ফি বহন করতে হয়। সরকারী হাসপাতালে একজন রোগীর আউটডোরে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা আর ভর্তি হতে ১৫ টাকা। ভর্তির পর থাকা খাওয়া ও চিকিৎসা ব্যয় সরকারই বহন করে থকে। আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবি, হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফাইন্যান্সিং রিসার্চ গ্রুপের সমন্বয়কারী ড. জাহাঙ্গীর এ এম খান জানান, সম্প্রতি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ সরকার ও শ্রীলঙ্কার একটি সংস্থার সমন্বয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বিভিন্ন কারণে নিঃস্ব হয়ে পড়া মানুষের প্রায় ২০ শতাংশ চিকিৎসা খরচ যোগান দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে সর্বশেষ এক গবেষণা অনুসারে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে দেশের সীমিত আয়ের মানুষ। আয়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়। এই ব্যয়ের শতকরা ৬২ ভাগ নিজেদেরই বহন করতে হচ্ছে রোগীদের। জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা গরিব এবং গরিব হয়ে যাচ্ছে নিঃস্ব। অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সমস্যা যেন গরিবের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ কারণেই অনেক গরিব মানুষ অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আইসিডিডিআরবির গবেষক ড. জাহাঙ্গীর এ এম খান জানান, রাষ্ট্র বা সরকারের ওপর দেশের নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায় থাকলেও বাস্তবে নাগরিকদের চিকিৎসার পেছনে সরকারের খরচ থাকে মাত্র ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া ৮ শতাংশ আসে দাতাদের কাছ থেকে, মাত্র ১ শতাংশ করে দেয়া হয় প্রাইভেট ও এনজিও খাত থেকে। পাশাপাশি পাইলট আকারে শুরু হওয়া বীমা থেকে এ খাতে সুবিধার হার এখন ১ শতাংশের নিচে। তবে কমিউনিটি স্বাস্থ্য বীমা এ ক্ষেত্রে কার্যকর একটি পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে, যাতে মানুষ নিজের সাধ্যমতো আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে টাকা চিকিৎসার জন্য অংশীদার ভিত্তিতে জমা রাখতে পারে। সরকারের সর্বশেষ এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি গরিব পরিবারে চিকিৎসা খরচের ৬৯ শতাংশ আসে আয় থেকে, ২১ শতাংশ আসে জমানো টাকা থেকে, ৪ শতাংশ আসে জমিজমা বিক্রি করে, ১১ শতাংশ চলে ধারদেনা করে, ৭ শতাংশ চলে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য বা চাঁদায়, ৩ শতাংশ আসে অন্যান্য প্রক্রিয়ায়। ক্যান্সার রোগী নিয়ে চলে থেরাপি ব্যবসা-দেশে নেই পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থা ॥ দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা এখনও অপ্রতুল। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেলেও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও মেডিক্যাল উপকরণ এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। দেশের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রতিবছর তিন লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর বছরে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ রোগী। সরকারী- বেসরকারী পর্যায়ের বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে বছরে ৫০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসা গেলেও আড়ালে থেকে যায় প্রায় আড়াই লাখ রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, জনসংখ্যার অনুপাতে বর্তমানে দেশে সব ধরনের সুবিধাসম্বলিত ১৬০ ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এমন কেন্দ্রের সংখ্যা আছে মাত্র ১৫। আবার এর সবই কার্যকর নয়, বেশিরভাগই চলে জোড়াতালি দিয়ে। এ ছাড়া সারাদেশে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ৮৫। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে থেরাপি ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। দেশে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপন নেই ॥ আর্থিক ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দেশে পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, লিভার প্রতিস্থাপনে প্রয়োজন হলে রোগীকে বিদেশে পাড়ি দিতেই হয়। বাংলাদেশে একটি স্থায়ী সেন্টার গড়ে উঠলে প্রতিটি লিভার প্রতিস্থাপন ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসতে পারে, যাতে দেশের বাইরে লাগে ৯০ লাখ থেকে আড়াই কোটি টাকা। ব্যয়বহুল চিকিৎসা হওয়ায় লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া অনেক রোগীকে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। তবে লিভার প্রতিস্থাপন প্রকল্পের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা কমিশনে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। কিডনি অকেজো হলেই রোগীর মৃত্যু ঘনিয়ে আসে ॥ দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুবই ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সাফল্যের মাত্রা খুব সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই সপ্তাহে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা লাগে। নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে কিডনি সংযোজনের জন্য। অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দু’দিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দু’টি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওষুধ দু’টি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দু’টি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দু’টি ইনজেকশন দিতে হয়। প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে হয় বলে দু’টি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক গরিব পরিবার। তাই ওই দু’টি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে।
×