ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আব্দুল মালেক

মুখোশধারী নব্য ফ্যাসিস্টদের রুখতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮

মুখোশধারী নব্য ফ্যাসিস্টদের রুখতে হবে

আমার আজকের লেখা শুরুর সময় ২০০১ সাল ও ঘটনাস্থল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু অনভিপ্রেত নাটকের সেই অভিনয় মঞ্চ ‘বঙ্গভবন’। ঘটনার পটভূমিতে তখন বিরাজ করছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে এক প্রশ্নবিদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল- যাতে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বিজয়ী ঘোষণার পর মন্ত্রিসভার একটি সভা আহ্বান করা হয়েছিল বঙ্গভবনে। কিন্তু মঞ্চের পর্দা উঠলে দেখা গেল উপদেষ্টা পরিষদের একজন বহুল আলোচিত হেভি ওয়েট সদস্য সেখানে প্রয়োজনীয় আলোচনা তোলার বিষয়টি ছুড়ে ফেলে শুরুতেই নির্বাচনে পরাজিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করে সদম্ভে গালাগালি দিতে লাগলেন। যা ছিল এতটাই উচ্চৈঃস্বরে যে, কক্ষে উপস্থিত সকলে খুব সহজেই শুনতে পাচ্ছিলেন তার সংলাপ। কেমন দিলামতো হারিয়ে! তারপর ভিলেনের কায়দায় হা হা হা করে ফেটে পড়লেন খুশির অট্টহাসিতে! পাশে উপবিষ্ট তার অপর এক সঙ্গী উপদেষ্টা, যিনি সবাইকে শুনিয়ে আরও অশালীন গালাগালি দিয়ে যোগ করলেন- -হুঁহ আমাদের কাজের সমালোচনা করা? উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে বলা? মজাটা এবার কেমন পাইয়ে দিলাম? এদের একজন বর্তমানে প্রয়াত। পেশায় ছিলেন ব্যারিস্টার এবং প্রকাশ্য সভায় এই রকম নিচুস্বরের বাগাড়ম্বর করতে আইনের ধার ধরেননি। অন্যজন সাবেক আমলা তিনি অবশ্য এখনও বেঁচে আছেন। মন্ত্রিসভার সেই বৈঠকে উপস্থিত পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদেরও তারা ছাড়লেন না ব্যঙ্গ করতে। শুধু তাই নয়, তাদের প্রতি ধমকের সুরে বললেনÑ -কি সাহেব বঙ্গভবন ভোট কেন্দ্রে আপনারা ভোট দিয়ে তো নৌকাকে বিজয়ী করলেন? কিন্তু সারা দেশে শেখ হাসিনাকে জেতাতে পারলেন কই! এরকম অযাচিত অপমানে বিব্রত কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, স্যার আমাদের তো সবার মাত্র একটি করেই ভোট দেয়ার অধিকার ছিল এবং আমরা সেটাই দিয়েছি। বঙ্গভবনের তালিকাভুক্ত ভোটাররা তাদের পছন্দেই নিজ নিজ ভোট দিয়েছে একটি করে। তাতে তো আমরা কোন ভূমিকা রাখিনি। নাটক ছেড়ে এবার পরিভ্রমণ করা যাক সেই সময়কার ইতিহাসের চারণভূমিতে। পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি লতিফুর রহমানের কীর্তিগাথার কথা। কথায় বলে ‘মর্নিং শোজ দা ডে’-বিচারপতি লতিফুরের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুটাই প্রমাণ করেছিল তাদের সারাদিনের হিসাব-নিকাশ। লতিফুর সরকার বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের পর মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ কর্মকর্তাদের টর্নেডো স্টাইলে একাধারে বদলি ও অবসরে পাঠানো শুরু করে দিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই লতিফুর রহমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন না। চাকরি জীবনে বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। সে বিষয়ে অবগত হতে গেলে প্রশাসনের মাধ্যমেই হতে হতো। অথচ এই গণহারে বদলির পূর্বে নবগঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোন আলাপ-আলোচনা কিংবা সচিবদের সঙ্গে প্রশাসনিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন মতামত নেয়ার অবকাশটুকুও তিনি নিতে চাননি। আচমকা উন্মত্ত বেগে কেন হঠাৎ ধেয়ে এসেছিল এই বদলি ঝড় এটি একটি প্রশ্ন। তাছাড়া বদলিকৃতদের স্থলে যাদের সেখানে বসানো হয়েছিল তাদের নিরপেক্ষতার সার্টিফিকেটাই বা কে দিয়েছিল? সঙ্গত কারণে একটা প্রশ্ন উঠেছিল এই তালিকা কি ছিল কোন মহল বিশেষের দ্বারা সরবরাহকৃত? অবশ্যই পরবর্তীতে জানা গিয়েছিল এসব কর্মকর্তা সকলেই বিএনপি জোটের লিস্টেড কর্মকর্তা। এরপর লতিফুর রহমানদের সমুদয় কর্মকা- ছিল তছনছ ও ভাঙচুরের এবং সেটা অব্যাহত ছিল তাদের সমগ্র সময়জুড়ে। বিএনপির তৈরি করা ছক অনুযায়ী ডিসি ও এসপি বদলি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হয়রানি-নির্যাতন, গ্রেফতার এবং সংখালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর সৃষ্ট দানবীয় অত্যাচার ছিল এক দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। এ সবই তখন ঘটেছিল লেবেল প্লেয়িংয়ের ছদ্মনামে। শুধু তাই নয়, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হবার মুহূর্তের মধ্যে চরম অসৌজন্যতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তার বাসস্থল গণভবনের টেলিফোন ও বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্নের ঘটনা ঘটে। অথচ তখন কোন গণআন্দোলনের মাধ্যমে তো তার সরকারের পতন হয়নি। সবাই জানেন বরং হাসিনা সময় শেষ হবার আগে আগেই বঙ্গভবনে উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের কাছে সানন্দে তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এসেছিলেন। নির্বাচনে তথাকথিত লেবেল প্লেয়িংয়ের নামে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানাবিধ অন্যায় বৈরিতামূলক কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ করেছিল। এর ফল স্বরূপ তাদের ভেতরে জন্ম নেয়া অযৌক্তিক অশালীন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সেদিনকার নাটকে। বর্তমানে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও তাদের সহযোগী সুশীল বাবুরা নিজেদের গণতন্ত্রপ্রেমী ও আইনের শাসনের প্রবক্তা হিসেবে গালভরা বুলিই শুধু নয়, হিক্কা পর্যন্ত তুলছেন ঘন ঘন। আর তাতে করে একই কায়দায় সেই ২০০১ সালের চিত্রনাট্য অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন অভিযোগ প্রমাণের আগে লতিফুর স্টাইলে ডিসি-এসপিসহ প্রশাসন ও পুলিশে বদলি শুরু করেছে। অথচ ইদানীংকার অনেক লেখায় তাদের সেই সব দিনের কথা উঠে আসছে। কয়েকদিন আগে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম ভুয়া ভোটার তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত রাজত্বকালে নির্বাচন কর্মকর্তা পদে ৩২০ জন ছাত্রদল-শিবির ক্যাডারকে চাকরি দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামী আমলের সেই পদে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত ৩২০ ছাত্রদল-শিবির ক্যাডারই নাকি এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজমান। ডিজিটাল দেশের এনালগ আওয়ামী লীগ দলের কাছে এদের বিষয়ে তথ্য আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে এদের সরিয়ে রাখা দরকার। মজার কথা বেশ কিছু ঋণ খেলাপী মহাজনকে গারদখানায় ঢোকানো নয় দেশের আইন প্রণেতা হিসেবে নমিনেশন বাতিল হবার ঘটনায় বলে চলছেন কামাল সাহেবের ঐক্যদল- এটা সরকারেরই মাস্টার প্ল্যান। নির্বাচনী ব্যাংকে রক্ষিত জনগণের গচ্ছিত অর্থ ধার নিয়ে যারা পরিশোধ করেননি তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াফত হওয়া উচিত। কিন্তু তারা নাকি কেবল নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন নাÑ এটা সকল দলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বিএনপির শীর্ষ ৫০ প্রার্থীর নমিনেশন সরকারের নির্দেশে বাতিল করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশ থাকলে কি আওয়ামী জোটের বিশাল নেতা- জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার কি মনোনয়ন অযোগ্য হতেন? অনিয়মের অভিযোগে কি আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে কারও কারও মনোনয়ন কি বাতিল হতো? দৈনিক জনকণ্ঠে ৫ নবেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা যায় বিএনপির এক ডজন প্রার্থীর কাছেই দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে পাওনা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে তাদের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্শেদ খানের ঋণের পরিমাণ এক হাজার তিনশ’ কোটি টাকা। দলের যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর রয়েছে ৯৫০ কোটি, মন্নু গ্রুপের আফরোজা রিতার ২৩০ কোটি টাকা ও গিয়াস কাদের চৌধুরীর ২৪৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। সাধু বেশে বিএনপি নেতাদের ঋণ খেলাপীর হিসাব মিডিয়ায় দেখতে পেয়ে বিবেকবান মানুষের চক্ষু বিস্ফোরিত করেছে। আওয়ামী আমলের লুটপাট নিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলের অভিযোগের অন্ত নেই। অথচ নমিনেশন ক্যাম্পে যেসব দুর্নীতিবাজ সরকার দলীয়দের দেখা মিলল তাদের অবস্থা তো তুলনায় দুগ্ধপোষ্য শিশুর। জিয়া এতিমখানা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আদালতে সাজাপ্রাপ্ত নেত্রীর বিষয়ে গ্রেনেড হামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তারেক জিয়ার বিষয়েও একই তার স্বরে চিৎকার ঠিক এমনিভাবে তারা একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছেÑ দেশের আইন কানুন তাদের জন্য নয়। সেটা শুধু প্রযোজ্য তাদের বিরোধী রাজনৈতিক দল ও আমজনতার জন্য। বোধগম্য দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের অধিকার এদের হাতে নিরাপদ নয়। তাই ৩০ ডিসেম্বর ব্যালটের মাধ্যমে এই মুখোশধারী নব্য ফ্যাসিস্টদের রুখতে হবে জনগণকেই। নইলে দেশ ফিরে যাবে এক অন্ধ কার যুগে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×