ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা প্রার্থিতা ফিরে পাননি ॥ ৩ আসনেই আপীল খারিজ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ ডিসেম্বর ২০১৮

খালেদা প্রার্থিতা ফিরে পাননি ॥ ৩ আসনেই আপীল খারিজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইসির আপীল নিষ্পত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফা শুনানি শেষে তিন আসনেই খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বৈধতা বিষয়ে আপীল খারিজ করে দেয়া হয়েছে। ফলে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নিতে হলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হবে। গত ২ ডিসেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তারা বাছাইয়ে ফেনী-১ এবং বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র দুই বছরের অধিক সময়ের সাজার কারণে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনটি আসনেই প্রার্থিতা ফিরে পেতে ইসিতে আপীল দায়ের করেন খালেদার আইনজীবীরা। শনিবার দুই দফায় তার আপীলের ওপর শুনানি করে ইসি। শেষ পর্যন্ত তার প্রার্থিতা বাতিল বলে সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। শনিবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাচন কমিশনে ভোটাভুটি হয়। এতে মাহবুব তালুকদার খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বৈধ বলে ঘোষণা দেন। শুনানির এক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার আদেশে বলেন, আইনী দিক বিবেচনায় আমি খালেদা জিয়ার মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেয়া সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে মনে করছি। তিন আসনেই তার প্রার্থিতা আমি বৈধ বলে ঘোষণা করছি। তবে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনে আসা নিষ্পত্তি আমি একা করছি না। সিইসিসহ বাকিরা খালেদা জিয়ার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছেন। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তিনি প্রার্থিতা ফিরে পেলেন না। পরে কমিশনার রফিকুল ইসলাম তার রায়ে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিধায় তার প্রার্থিতা বাতিল করা হলো। একই কারণ দেখিয়ে কমিশনার কবিতা খানম ও ব্রি. জে. শাহাদত হোসেন চৌধুরীও অবৈধ বলে ঘোষণা দেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বৈধতার বিষয়ে আপীল খারিজ হয়ে যায়। এখন বেগম জিয়ার নির্বাচনে অংশ নিতে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হবে। আদালত তার পক্ষে রায় দিলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু আপীল খারিজ হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সিইসি কে এম নুরুল হুদা আপীল নিষ্পত্তি করে বলেন, শুনানি শেষে এক কমিশনার খালেদা জিয়ার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু, বাকি তিন কমিশনার অবৈধ ঘোষণা করেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে তিনি তিন আসনেই নির্বাচন করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, মাহবুব তালুকদার খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্রকে বৈধ বলে ঘোষণা দেন। সিইসি অন্য তিন কমিশনার তার মনোনয়নপত্র ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা দেন। এর আগে শনিবার দুপুরে এবং সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার ওপর দু’দফা শুনানি হয় ইসির আপীল নিষ্পত্তিতে। দুপুরে প্রথম দফায় খালেদা জিয়ার শুনানিতে অংশ নেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীনসহ তার পক্ষের কয়েক আইনজীবী। এ সময় তিনি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার তিন আসনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে আরপিওর ১২ ডি (এক) ধারা অনুযায়ী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে নির্বাচনী অপরাধ করলে তার প্রার্থিতা বাতিল হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া কোন নির্বাচনী অপরাধ করেননি। ফলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে না। রিটার্নিং কর্মকর্তা যে গ্রাউন্ডে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন সেই গ্রাউন্ডের ওপর কমিশনে আপীল করা হয়েছে। আপীল নিষ্পত্তিও সে গ্রাউন্ডের ওপর হতে হবে। এর বাইরে আপীল নিষ্পত্তির কোন সুযোগ নেই। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দাবি করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাদের নেত্রীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন নির্বাচনী অপরাধের অভিযোগে। কিন্তু, বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাজা হয়েছে দুর্নীতি মামলায়, নির্বাচনী অপরাধে নয়। পরে নির্বাচন কমিশনে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে আপীল শুনানি চলাকালে আইনজীবীরা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের কাছে জানতে চান, খালেদা জিয়া কারাগারে, তিনি কীভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেন বা নির্বাচনী অপরাধ করলেন? আর এই কারণে কীভাবে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। দুপুরে শুনানি শেষে এই বিকেলে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। দুপুরে আপীল শুনানি শেষে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে না। আর্টিকেল ১২ ডি এক ধারায় নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনও নির্বাচনী কোন কাজই শুরু হয়নি। ইসি শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের ওপর শুনানি করতে পারবে। যে ধরায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে সেটা নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধ। খালেদা জিয়া সেই ধরনের অপরাধ করেননি। সাজার প্রসঙ্গে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়নি। কেবল সেই বিবেচনায় সিদ্ধান্ত দিতে হবে। তার মনোনয়নপত্র বাতিল বেআইনী বলেও উল্লেখ করেন তারা। শনিবার কমিশন খালেদা জিয়ার আপীলের ওপর আবারও শুনানি করে। এতে খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী, জয়নাল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন যুক্তিতর্কে অংশ নেন। তারা আইনের ধারা উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে রায় দাবি করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিপক্ষে মত তুলে ধরেন। এ সময় কোন পক্ষের আইনজীবী না হওয়ার পরও ইউসুফ হোসেনের বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এজে মোহাম্মদ আলী। তাকে উদ্দেশ্য করে ‘হু আর ইউ’। ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ছাড়াও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের বেশ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। শুনানির পরপরই কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক যথাক্রমে ফেনী-১, বগুড়া ৭ ও ৮ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপীল দায়ের করা হয়েছে, তা আইনগত বিশ্লেষণ করে আমার রায় এই আপীল মঞ্জুরের পক্ষে। আমি এই আপীল মঞ্জুর করলাম। মাহবুব তালুকদারের পরপরই বিএনপির আইনজীবীরা উল্লাস প্রকাশ করেন। অন্যদিকে আওয়ামী আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। উত্তপ্ত আদালত কক্ষেই কমিশনার রফিকুল ইসলাম তার রায় ঘোষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ-প্রাপ্তরা নির্বাচন করতে পারেন না। এ কারণে খালেদা জিয়ার আপীল নামঞ্জুর করা হলো। এরপর কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও একই রায় দেন। কমিশনার কবিতা খানমও এই দুই কমিশনারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, ‘খালেদা জিয়া দ-প্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দ-িত হয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) এখন কারাগারে। তার দ- স্থগিত হয়নি। মনোনয়নপত্র বাতিল করে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা যে আদেশ দিয়েছেন, তার স্পিরিট বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী আপীল না মঞ্জুর করা হলো। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, আমি আমার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন ও কবিতা খানম এই তিনজনের পক্ষে রায় দিলাম। এই আপীল আবেদন মঞ্জুর হয়নি। পরে ইসি সচিব বলেন, ৪-১ ভোটে এই আপীল নামঞ্জুর হলো। অবশ্য ইসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথ এখনও খোলা রয়েছে খালেদা জিয়ার। তবে আদালত থেকেই ইতোমধ্যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে যে ২ বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্তরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দ- হলে সেই দ- বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপীলে ওই দ- বাতিল বা স্থগিত হয়। খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান বিএনপির আইনজীবীরা। বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, বেগম জিয়ার মনোনয়নপত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। মাহবুব তালুকদারের সিদ্ধান্ত ফেয়ার ছিল বলে দাবি করেন সুপ্রীমকোর্টের এই আইনজীবী। খালেদা জিয়ার আপীল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শনিবার নির্বাচন কমিশনে অন্য দিনের তুলনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এদিন, প্রথমবারের মতো পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবও দায়িত্ব পালন করে। প্রার্থিতা ফিরে পেলেন এম মোর্শেদ খান ॥ রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। একাদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দাখিল না করায় এবং বিদ্যুতের বিল খেলাপী হওয়ায় সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। শনিবার নির্বাচন ভবনে তৃতীয় দিনের শুনানিতে মোরশেদ খানের আবেদন মঞ্জুর করে। ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের করা আবেদন নামঞ্জুর করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শনিবার বিকেল ৫ টার দিকে কমিশন এ আবেদন নামঞ্জুর করে। ফলে ঢাকা-৮ আসনে মির্জা আাব্বাসের নির্বাচন করতে আর কোন বাধা রইল না। এদিকে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আপীলে প্রার্থিতা ফিরে পাননি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান। শুনানিতে তার আবেদন শুনানি করে নামঞ্জুর করে দিয়েছে ইসি। তবে আফরোজা আব্বাস বৈধতা চেয়ে প্রার্থিতা ফেরত পেয়েছেন।
×