ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষক হাসনা হেনার মুক্তি দাবিতে বিক্ষোভ

পরীক্ষায় ফিরেছে ভিকারুননিসা, আজ ক্লাস শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

 পরীক্ষায় ফিরেছে ভিকারুননিসা, আজ ক্লাস শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় অধিকাংশ দাবি পূরণের পর শুক্রবার পরীক্ষায় ফিরেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের আন্দোলনকারী ছাত্রীরা। তবে অরিত্রীর আত্মহত্যার ‘প্ররোচনার’ অভিযোগে করা মামলায় কারাগারে থাকা শিক্ষক হাসনা হেনার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে বর্তমান ও সাবেক ছাত্রীদের একটি অংশ। দাবি আদায়ে শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটির বেইলি রোডে মূল ক্যাম্পাসে দিনভর অবস্থান ও বিক্ষোভ করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির গবর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেছেন, এখন ছাত্রীদের মধ্যে দুুটি পক্ষ দাঁড়িয়েছে। যদিও তারা সকলেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম অটুট রাখার বিষয়ে সচেতন। আমরা আমাদের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় মর্মাহত। দ্রুত আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। ছাত্রীরাও বুঝতে পেরেছে। বৃহস্পতিবারের ঘোষণা অনুসারে ছাত্রীরা শুক্রবার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আজ শনিবার থেকে ক্লাসে ফিরবে তারা। তবে ছাত্রীরা তাদের শিক্ষিকার গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানোকে মেনে নিতে পারছে না। তারা নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে দিনভর অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে। আমরা শিক্ষকদের নিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে বিষয়টি আইনী। তার পরও আমরা দেখব। এক প্রশ্নের জবাবে সভাপতি বলেন, আসলে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ধান্ধা করছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী একটি বহিরাগত চক্র। সঙ্গে কিছু বামপন্থী লোকজনও যোগ হয়েছে। তারা চায়না আন্দোলন বন্ধ হোক। এর আগে শুক্রবার সকালেই বেইলি রোডে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রীবৃন্দ’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচী শুরু করে। ‘নিরপরাধ হাসনা হেনা আপার নিঃশর্ত মুক্তিসহ সসম্মানে ফিরিয়ে আনার দাবিতে’ এই অবস্থান বলে লেখা হয় তাদের ব্যানারে। দোষীদের বিচার করতে গিয়ে নির্দোষের শাস্তি কেন? অরিত্রী আমাদের বোন, শিক্ষক হাসনা হেনা আমাদের মা। নির্দোষের নিঃশর্ত মুক্তি চাই স্লোগান লেখা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থানে বসেছে আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনে অংশ নেয়া রোজ নামে একাদশ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, যে শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে উনি কোনভাবেই অরিত্রীর ঘটনায় দায়ী নন। উনার নাম কোনভাবেই ঘটনার সঙ্গে আসেনি। উনি পরিস্থিতির শিকার বলে আমরা মনে করছি। এই অবস্থানে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরাও অরিত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ‘সুষ্ঠু বিচার চায়’ মন্তব্য করে রোজ বলেন, কোন শিক্ষিকা যাতে অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার না হন আমরা সেটাও চাচ্ছি। গেটের সামনে বসে ‘আমার মা নির্দোষ, মুক্তি চাই, মুক্তি চাই’ বলে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রীরা। শিক্ষার্থীদের সেøাগানের মধ্যে ছিল ‘অরিত্রী আমার বোন, হাসনা হেনা আমার মা’, ‘যাদের হাতে মানুষ গড়া তাদের কেন হাতকড়া?’, ‘আমরা কি শিক্ষকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছি না?’, ‘শিক্ষকের অপমান মানি না, মানব না’, ‘বিচার চাই, অবিচার না’, ‘বিচার চাইতে গিয়ে এ কোন্ অবিচার’। শিক্ষক মুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের একাদশের ছাত্রী ফরিয়া লামিয়া বলেন, হাসনা হেনা ম্যাডাম সম্পূর্ণ নির্দোষ, তাকে বিনা কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। অচিরেই তাকে মুক্তি দিতে হবে। আমরা তার মুক্তি চাই। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ দাবি করেন, অরিত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক। অথচ তাদেরকে বাদ দিয়ে মায়ের মতো শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষিকা হাসনা হেনার মুক্তির জন্য তারা আইনী প্রক্রিয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। তাই যতক্ষণ না তাকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তারা। পাশাপাশি তার মুক্তির দাবিতে আগামীকাল রবিবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হবে। স্কুলের শিক্ষার্থী ইকরা বলেন, আমরা চাই হাসনা আপাকে অতিদ্রুত মুক্তি দেয়া হোক। তারা আমাদের মা, তারা আমাদের সারা বছর গাইড করে আসছেন। আমরা চাই তাদের মুক্তি হোক। আমরা বিচার চাইতে গিয়ে তাদের কোন অসম্মান হোক, এটা আমরা চাই না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রিন্সিপালের বিচার চাই। শুক্রবার ছাত্রীদের সঙ্গে ছিলেন বেশ কিছু অভিভাবকও। সুমন আহমেদ নামে এক অভিভাবক বলেন, স্কুলের রেপুটেশন নষ্ট হচ্ছে আন্দোলনের নামে। বিষয়টাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে কোন একপক্ষ স্টুডেন্টদের রাস্তায় নামিয়েছে। এটা স্কুলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আপাকে যে অপরাধে অপরাধী করা হয়েছে, আসলে সে অপরাধে তিনি অপরাধী কিনা তা তদন্ত কমিটি করে এবং অন্য কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ভাল হয়। শাহিনা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, হাসনা হেনা আপাকে ১৫ বছর ধরে চিনি। উনি তো এটার সঙ্গে জড়িত নন। উনি ক্লাস টিচার। উনি জাস্ট ফোন করে গার্ডিয়ানদের এনেছিলেন। এটার জন্য তার এত বড় শাস্তি হতে পারে না। ক্লাস টিচারের দায়িত্ব সে পালন করেছে, এছাড়া তো কোনও কিছু করেননি। হাসনা হেনা আপার মুক্তি চাই আমরা। গত ৩ ডিসেম্বর শান্তিনগরের নিজ বাসায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয় অরিত্রী। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল (ঢামেক) কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় ‘আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী’ হিসেবে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার শিফট ইনচার্জ জিনাত আখতার ও প্রভাতী শাখার শ্রেণী শিক্ষিকা হাসনা হেনার বিরুদ্ধে মামলা করেন অরিত্রীর বাবা। এ ঘটনায় ভিকারুননিসার শিক্ষক আতাউর রহমান, খুরশিদ জাহান এবং গবর্নিং বডির সদস্য ফেরদৌসী বেগমকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করে গবর্নিং বডি। মঙ্গলবার দুপুরে অরিত্রী কেন আত্মহত্যা করেছে এর কারণ খুঁজতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। কমিটিতে একজন অতিরিক্ত শিক্ষা সচিব, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, মনোবিজ্ঞানী এবং বিচারক রাখার কথা বলা হয়। তারা অরিত্রী আত্মহত্যার ঘটনা এবং সারাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ রকম ঘটনা তদন্ত করে কারা দায়ী তা খুঁজে বের করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেবেন।
×