ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত পাল্টে যাওয়া একটি গ্রাম

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

 দ্রুত পাল্টে যাওয়া একটি গ্রাম

এই তো সেদিনের দৃশ্যপট- দ্রুতই অতীত হয়ে গেল। চেনা পথঘাট, চেনা ঘরবাড়ির চিহ্নটুকু আর নেই। শীতে বাঁশের বেড়ার ফুটো দিয়ে হিমেল হাওয়া ঢুকে কহিল করে না। গ্রীষ্মে ঝড়ো হওয়ায় ঘর উড়ে যাওয়ার ভয় নেই। সন্ধ্যা বাতির জন্য হারিকেনের চিমনি মুছে কেরোসিনে সলতে চুবিয়ে দেখতে হয় না। লণ্ঠন বা কুপিতে (স্থানীয় কথায় ন্যাম্পো) তেল আছে কিনা তাও দেখতে হয় না। হাটে যেতে কৃষকের হাতে দড়িতে বাঁধা তেলের শিশি ঝুলতে দেখা যায় না। অল্প দূরত্বের পথেও এখন কেউ হাঁটে না। গ্রামের কত যে পরিবর্তন...। সেদিনের সে-ই গ্রাম চিত্র বুঝি আর রইল না। আজকের গ্রাম আর নিকট অতীতের গ্রামের কত ফারাক। চলুন এমন একটি গ্রাম ঘুরে আসি। যে গ্রামও বর্তমানের দশ গ্রামের উন্নয়নের ধারার এগিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রামের নাম রানীরপাড়া। চরদিকে সবুজের বেষ্টনীতে ছায়া ঢাকা এক গ্রাম। বগুড়া জেলা নগরী থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্বের এই গ্রামে পাকা সড়ক ধরে যন্ত্রচালিত যে কোন যানে চেপে যাওয়া যায়। গ্রামের ফিডার রোডেরও বেশিরভাগ পাকা। প্রায় ৭শ’ পরিবার অধ্যুষিত এই গ্রামের প্রতিটি পরিবার শিক্ষিত। রানীরপাড়া সরকারী প্রাথমিক স্কুলে শতভাগ শিক্ষার্থীর অধিকাংশই মেয়ে শিশু। বেশিরভাগ পরিবারের সন্তান কলেজের পাঠ শেষে কেউ বিশ^বিদ্যালয়ে কেউ মেডিক্যালে কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সরকারী বেসরকারী চাকরিজীবীও আছে। আছে ব্যবসায়ী। গ্রামের তরুণ কৃষকদের অনেকেই শিক্ষিত। তরুণ তরুণীদের হাতে স্মার্ট ফোন ট্যাব ল্যাপটপ আছে। গ্রামের অনেক তরুণী জিনস প্যান্ট টি শার্ট পরে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙালী নদীর পাড়ে যেমন খেয়া পারপার আছে, অল্প দূরে আড়িয়ার ঘাটে পাকা ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। একদার খড়ে ছাওয়া বেড়ায় ঘেরা কুড়েঘরের দেখা মেলে না। বেশিরভাগ বাড়ি টিনে ছাওয়া আধা পাকা। অল্প বাড়ি টিনের। টিনের বাড়ির অনেক সদস্য বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকায় রেমিট্যান্সের অর্থে বাড়িগুলো পাকা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বাড়িই বিদ্যুতায়িত। প্রতিটি ঘরেই আছে রঙিন টেলিভিশন। কেবলওয়ালরাও বসেছে গ্রামে। কেবল সংযোগ আছে প্রতিটি বাড়িতে। গ্রামের লোকজন এখন বিদেশী চ্যানেল দেখে। গৃহস্থ বাড়িতে ফ্রিজ, ওভেনের পাশাপশি এলপি গ্যাসের চুলায় রান্না হয়। একদা গ্রামের বাড়িতে মাদুর পেতে খাওয়া হতো। এখন ডাইনিং টেবিল প্রায় সব বাড়িতেই। আসবাবপত্রও আধুনিক। গ্রামের মূল পাকা সড়কের ধারের মনিহারি দোকানগুলো উন্নত। শহরে জীবনের সকল পণ্য এই দোকানগুলোতেও মেলে। গ্রামের লোক এখন চা তো পান করেই কফিও পান করে। শহরের মতো আড্ডাও জমে। গ্রামের কোন বাড়িতেই এখন গোয়াল ঘর নেই। বলদের চাষ নেই। বড় গৃহস্থের পাওয়ার টিলার আছে। সেচ যন্ত্র প্রতিটি ঘরে। যে অল্প সংখ্যক ক্ষুদ্র কৃষক আছে তারা ভাড়ায় টিলার চাষ করে নেয়। এতে খরচ অনেক কম। হালে কৃষির যাবতীয় কাজ হয় যন্ত্রে। যার সবই মেলে এই গ্রামে। যন্ত্র কৃষি ও প্রতিটি ফসলে হাইব্রিড বিজের আধিক্যে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। ভর বছর কোন না কোন ধানের পাশাপাশি রবি ফসল পাট আখ সবজি উৎপাদন হচ্ছে। গ্রাম থেকে উত্তরে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে সোনাতলা উপজেলা সদররের হাট বাজার। পূর্বে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে যমুনা নদী তীরে হরিখালি হাট। কৃষকরা উৎপাদিত পণ্য সহজে পরিবহন করে হাট বাজারে নিতে পারে। বাড়তি ফলনে কৃষকরা আর্থিক ভাবে আগের চেয়ে অনেক উন্নত জীবনযাপন করছে। গ্রামের অনেক শিক্ষিত তরুণ মিনি ডেইরি ফার্ম দিয়েছে। ছোট আকারে পোলট্রি ফার্ম দিয়েছেন আশরাফ আলী। অনেক তরুণী সেলাই মেশিনে পোশাক বানিয়ে হাট বাজারে দিচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারী কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম মাছের চাষ করছেন। গ্রামের তরুণ নিপুণ আনোয়ার কাজল চাতালের ব্যবসা করে বর্তমানে সমাজ সেবামূলক কাজ করছেন। গ্রামের অনেক তরুণ মোটরসাইকেলে চলাফেরা করেন। অনেক পরিবারের সন্তান কেউ ঢাকা মহানগরীতে কেউ বগুড়া নগরীতে কেউ বিদেশে থাকেন। গ্রামের কৃষক সমেশ উদ্দিন জানালেন, বছর দশেক আগেও এই গ্রাম এত উন্নত ছিল না। এই গ্রামের ওপর দিয়ে জেলা ও উপজেলা সদরের যোগাযোগের মিনি বাস চলাচল করে। সিএনজিচালিত অটো রিক্সা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (অটো ও টোটো নামে অধিক পরিচিত), ব্যাটারি ও ইঞ্জিন চালিত রিক্সা এবং ঠেলা চলাচল করে। লোকজন দিনে ও রাতে যে কোন সময়ে কাছের উপজেলা সদর ও দূরের জেলা সদরে যেতে পারে। গ্রামের যারা ঢাকা ও বগুড়ায় থাকে ও গাড়ি আছে তারা গাড়িতেই যাতায়ত করে। এই গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে সোনাতলা সরকারী নজির আখতার কলেজ, সোনাতলা মডেল স্কুল, গার্লস স্কুল, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)। একটা সময় রানীরপাড়া গ্রামে যেতে ট্রেনে চেপে সোনাতলা রেল স্টেশনে নেমে কাঁচা পথে যেতে হতো। দূর অতীতে সোনাতলা ছিল পাট ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র। সেই সোনাতলা ও কাছের রানীরপাড়া এলাকা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। নিপুণ আনোয়ার কাজল বললেন এই গ্রামের উন্নয়নে বেশি অবদান রেখেছেন এই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আব্দুল মান্নান। সোনাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বুলু বললেন এলাকার যত উন্নয়ন তা গত দশ বছরে হয়েছে। রানীরপাড়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুক্তি বেগম বললেন, গ্রামের উন্নয়নে ও নারীদের এগিয়ে নিতে জনপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বললেন, নারী শিক্ষিত হওয়ায় এই গ্রামে কোন বাল্য বিয়ে নেই। গ্রামের প্রতিটি পরিবার সচেতন। কৃষক বাসেত আলী বললেন, যারা এক সময় প্রান্তিক চাষী ছিলেন তারা এখন স্বাবলম্বী। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের সদস্য নিজেদের উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিচ্ছেন। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×