ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গাজী আবদুস সালাম ভূঁইয়ার (বীরপ্রতীক) স্মৃতিচারণ

কর্নেল তাহেরের পা বিচ্ছিন্ন ঘটনা আজও চোখে ভাসে

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

কর্নেল তাহেরের পা বিচ্ছিন্ন ঘটনা আজও চোখে ভাসে

নভেম্বর ১৯৭১। তৎকালীন মেজর (পরে কর্নেল) মোঃ আবু তাহের কামালপুর রণাঙ্গন পরিদর্শনে আসেন। ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। আমি তখন আমার আত্মঘাতী দলের নজরুল, মোস্তফা এবং মজিদসহ কয়েকজনকে নিয়ে কামালপুরের কাছাকাছি দেওয়ানগঞ্জের রাস্তায় অবস্থান করছি। খবর পেয়ে তিনি সেখানে চলে আসলেন। অভ্যর্থনা জানানোর কিছুই ছিল না আমার কাছে। তখন সহযোদ্ধা নজরুলকে ইশারা দিই। তিনি চেনের আকারের এসএমজির বুলেটের একটি মালা কমান্ডার আবু তাহেরের গলায় পড়িয়ে দেন। এতে তিনি বেশ খুশি হন। কামালপুরের পাকহানাদারদের শক্ত ঘাঁটির পতন যখন সময়ের ব্যাপার তখনই সেখানে ঘটে যায় ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। শত্রু পক্ষের ছোড়া মর্টারের একটি শেল এসে পড়ে সেখানে। শেলের আঘাতে আবু তাহেরের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কর্নেল তাহেরের পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাটি আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’ যুদ্ধ দিনের সেই স্মৃতিকথাগুলো বলছিলেন গাজী আবদুস সালাম ভূঁইয়া (বীরপ্রতীক)। নান্দাইল পৌরসভার চারিআনিপাড়া মহল্লায় তার বাসা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হয়ে গেলেও ঘটনাটি তার মনে এখনও অম্লান হয়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কিছু চমকপ্রদ ঘটনা জনকণ্ঠের কাছে তিনি তুলে ধরেন। সালাম ভূঁইয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালী শাসনক্ষমতা পেল না। আমি সে সময় করাচীতে আরব সাগরে ভাসমান মুনসিফ যুদ্ধজাহাজে কর্মরত। অনেক কষ্টে ২২ মার্চ আমি ছুটি পাই। ২৫ মার্চ সকাল ১০টায় বিমানের একটি টিকেট পেলাম। দুপুর ১টায় নামলাম ঢাকা বিমানবন্দরে। দেশের মাটিতে পা রাখার পর মনে আনন্দের শিহরণ জাগে। পাকিস্তান থেকে ফেরার সময় সেখানকার বাঙালী ভাইয়েরা বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে বলবেন আমরা অবরুদ্ধ। কথাটি জানাতে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ধানম-ির ৩২ নম্বরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে রওনা হই। গিয়ে দেখি চারপাশ লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি লে. এম এম রহমানকে দেখতে পাই। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। তাকে জানালাম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালীদের অবস্থার কথাসহ আরও কিছু তথ্য। সে সব কথা তিনি বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করার দায়িত্ব নিলেন। তখন আমি রাত সাড়ে নয়টার দিকে ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বের হয়ে দেখলাম ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাকার রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তখনও জানতাম না কী হতে চলেছে। মধ্যরাতে মারণাস্ত্রের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর। আকাশে চলছে স্টারসেল ফায়ারিং। একজন সামরিক ব্যক্তি হিসেবে বুঝতে পারলাম কী ঘটতে চলেছে। ২৬ মার্চ সকালে জানালার ফাঁক দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে পড়ে থাকা লাশের সারি দেখতে পাই। ঢাকা থেকে কোন মতে নিজ বাড়ি নান্দাইলে ফিরে গোপনে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকি। ১ জুন সিলেট সীমান্তের ওপারে মহেশখোলা মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে যাই। আমার সঙ্গে নান্দাইল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান, পুরুরা হাই স্কুলের শিক্ষক এএসএম আক্রাম হোসেন, মকতুল হোসেন, এবি সিদ্দিক ও মাজহারুল হক ফকির। সেখান থেকে বাঘমারা চলে আসি। ভারতের সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের লোকেরা পা-নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে আমাকে শনাক্ত করে ফেলে। বাঘমারা থেকে তোরায়। তোরায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ইন্সট্রাক্টরের দায়িত্ব পালন করি। পরে জানতে পারে গেরিলা কমান্ডো মেজর আবু তাহের ১১ নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০ আগস্ট আমি কালাইপাড়া ক্যাম্প ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগদান করি। সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য চাইনিজ অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জামালপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার যথাযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমার ওপর ন্যস্ত হয়। কামালপুর যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হওয়ার পর আমাকে ধানুয়া কামালপুর ক্যাম্পে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন লে. মাহফুজ। মেজর আবু তাহেরের পরিচালনায় গেরিলা বাহিনী, আত্মগাতী দলের আক্রমণ, রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখা এবং বিভিন্ন রণকৌশল অবলম্বন করে কামালপুরে পাক বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা হতো। ধানুয়া কামালপুর আমার এলাকা ছিল মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্ত লাইন হতে ধানুয়া কামালপুর সংলগ্ন দেওয়ানগঞ্জ রাস্তা পর্যন্ত। ২৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় কামালপুর পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে। আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অবস্থান নেই দেওয়ানগঞ্জ রাস্তায়। পাকবাহিনীর অপর একটি গ্রুপ আমাদের দিকে আক্রমণ শুরু করলে আমরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করি। ফায়ারিং চলতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ঐদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধের খবরাখবর নেয়ার জন্য আবু তাহের ধানুয়া কামালপুর এসে উপস্থিত হন। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারিকে ডেকে কিছু একটা উপদেশ দেন। সেই সঙ্গে আমাকেও কিছু নির্দেশ দিয়ে যান। আমাদের আক্রমণেই ওদের অনেক লোক মারা গেছে ও কিছু আহত হয়েছে। মেজর জিয়াউর রহমান ও ১১ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরকে নিয়ে আগের দিনের যুদ্ধের ফলাফল জানার জন্য আকস্মিক সফরে আসেন। তাহের আমাকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কামালপুরে মেজর আবু তাহেরের নির্দেশে আত্মঘাতী দল উল্কা ও ইউরেকা নামের দুটি দল গঠন করা হয়। উল্কা দলের দায়িত্ব পাই আমি। হারুন-অর রশিদ দায়িত্ব পালন করেন ইউরেকা দলের। আগস্ট হতে নবেম্বর পর্যন্ত কামালপুরের পরিবেশ বলতে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ লেগেই থাকত। আমি কামালপুর ক্যাম্পের সন্নিকটে আছি শুনে মেজর তাহের সেখানে চলে আসেন। তখন প্রায় সকাল ৮টা। তাহের আমার কাছে এসে প্রশ্ন করেন কি কি দখলে নিয়েছেন। সহযোদ্ধা নজরুলকে এমজি চেনের আকারে বুলেটের একখানা মালা তার গলায় পরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেই। বিজয় যখন সন্নিকটে তখন শত্রু পক্ষের অতর্কিত মর্টার শেলের আঘাতে সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের বাঁ পা সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর আমি পাশে থেকে এ দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। তাহেরকে আমার সীমান্তে মিত্র বাহিনীর এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেই। এই ঘটনায় আমরা ওই দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দেই। ২৪ নবেম্বর থেকে কামালপুর পাক সেনা ক্যাম্প অবরোধ করে রাখেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৩ ডিসেম্বর যৌথ কমান্ডের সিদ্ধান্তের বীর সেনানী আনিসুল হক সঞ্জুকে চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় পাক সেনা ক্যাম্পে। চিঠিতে লেখা ছিল তোমাদের চারদিকে যৌথ বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। বাঁচতে চাইলে আত্মসর্মপণ কর, তা না হলে মৃত্যু অবধারিত। অবশেষে পাঞ্জাবী সৈন্যের ১৬২ জনের একটি দল যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে ৪ ডিসেম্বর শনিবার পাক সেনাদের কবল থেকে কামালপুর মুক্ত হয়। এরপর সেখান থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টাঙ্গাইল ও শেরপুর মুক্ত করি। আমরা ১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে ময়মনসিংহে চলে আসি। ময়মনসিংহে এসে আমি খবর পাই আমার বাবা মোঃ শাহনেওয়াজ ভুইয়া তৎকালীন নান্দাইল থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও থানা মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক ১৭ নবেম্বর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীরা তাকে হত্যা করে। আর এই মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার দাদা ছাবিদ আলী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রাজাকার বাহিনী আমার বাড়িতে লুটপাট করে সর্বস্ব নিয়ে যায়। -মজিবুর রহমান ফয়সাল, নান্দাইল, ময়মনসিংহ থেকে
×