ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবাসের অন্তর্বেদনা স্বপ্নের নবনির্মাণ নাদিম ইকবালের তথ্যচিত্র

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

প্রবাসের অন্তর্বেদনা স্বপ্নের নবনির্মাণ  নাদিম ইকবালের তথ্যচিত্র

মোরসালিন মিজান ॥ নাদিম ইকবাল একটু নিভৃতচারী। চুপচাপ ধরনের। যা কথা, চলচ্চিত্রের ভাষায় বলেন। না, বাণিজ্যিক কিছু নয়। ডক্যুমেন্টারি ফিল্ম। সিরিয়াস ভাবনা থেকে ব্যতিক্রমী নির্মাণ। কোন একটি মেসেজ দেয়ার চেষ্টা। তরুণ পরিচালকের এই চেষ্টা প্রশংসিত হচ্ছে বৈকি। নাদিম কানাডায় বসবাস করেন। প্রবাসী। তবে তার দেশ ভাবনা বলতে একান্তই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নরম মাটিতেই যে নাড়ি পেঁাঁতা। হয়ত তাই নিজের দেশের ভাল যা, যা সুন্দর, তিনি আপন মনে খুঁজে বেড়ান। চলচ্চিত্রে নবনির্মাণ করেন। তুলে ধরেন বহির্বিশ্বের কাছে। উদাহরণ হতে পারে তার ‘বিদ্যাভুবন’ তথ্যচিত্রটি। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ঢাকা লিট ফেস্টে এটি দেখানো হয়। পরিচালক নিজেও আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন উৎসবে। এখন যাই যাই করছেন। ঢাকা ছাড়ার দু’দিন আগে কথা হয় তার সঙ্গে। নাদিম ইকবালকে বেশ সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়। স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির এত বড় মিলনায়তন। সবকটি আসন পূর্ণ ছিল। দর্শক আগ্রহ নিয়ে আমার ছবি দেখেছেন। অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। একজন পরিচালকের জন্য এর চেয়ে ভাল লাগার আর কী হতে পারে? অথচ বিষয় বিবেচনায় তথ্যচিত্রটি যথেষ্ট ভিন্ন ধারার। এতে অজপাড়া গাঁয়ের একটি স্কুলের গল্প। ব্যক্তি উদ্যোগে নেত্রকোনায় চালু করা স্কুলের নাম বিদ্যাভুবন। এ নামেই তথ্যচিত্র। এতে দেখা যায়, স্কুলটির স্পষ্টতই ব্যতিক্রমী পাঠদান। পাঠ্যপুস্তক আর মুখস্থবিদ্যার বাইরে গিয়ে আত্মোন্নয়নের সচেতন প্রয়াস নিয়েছেন স্থানীয় যুবক মামুন। বাসা বাড়িতে গিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খুঁজে আনছেন। গাড়ি ঘোড়া চড়ার জন্য যে লেখাপড়া, সেটিকে প্রত্যাখ্যান করে কচিকাঁচাদের ভেতরটা গড়ে দেয়ার কাজ করছেন। তাদের জীবনের গভীরতর বোধগুলোকে জাগিয়ে দিচ্ছেন। বাঁশ ও খড় দিয়ে নির্মিত অতি সাধারণ স্কুল ভবন ছেড়ে শিক্ষার্থীরা যেতে চায় না! রুটিন লেখাপড়া ছাড়াও এখানে শরীর চর্চা, সঙ্গীত, নাটকসহ অন্যান্য সৃজনশীল চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। উৎকর্ষ অর্জনের এ পথ সহজ নয়। অর্থের অভাব। পারিবারিক টানাপোড়েন। নানা সীমাবদ্ধতা। এ অবস্থায় শরীরের কিডনি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আবেগী ঘোষণা দেয় উদ্যোক্তা। একই ঘোষণা আসে অন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। পুরো বিষয়টি চমৎকারভাবে পর্দায় তুলে ধরেছেন নাদিম। তার নিজস্ব উপস্থাপনার গুণ দর্শককে গল্পের সঙ্গে খুব সহজেই কানেক্ট করে নেয়। কোন্ চিন্তা থেকে এমন বিষয় নির্বাচন? জানতে চাইলে নির্মাতা বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মন্দগুলোই বেশি তুলে ধরা হয়। অথচ কত ভাল আমাদের আছে! ভাল দেখাতেই এমন বিষয় নির্বাচন। অতি সাধারণ মানুষের মানবিক মহৎ অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখিয়েছি আমি। সেইসঙ্গে দর্শকের মধ্যে একটি আবেদন সৃষ্টি করতে চেয়েছি। তথ্যচিত্রের সিনেমাটোগ্রাফিও ভীষণ উপভোগ্য। কোন কোন ফ্রেম তো পেইন্টিংয়ের শিল্পমান নিয়ে দৃশ্যমান হয়। স্কুল দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশের মায়া ঘেরা গ্রাম, আলপথ, বৃক্ষরাজি দেখান পরিচালক। অবাক করে দিয়ে বলেন, সবই একা আমি করেছি। নিজেই অর্থ লগ্নি করেছি। ক্যামেরা চালিয়েছি। এডিটিংও আমার। এর আগে নাদিম ইকবাল নির্মাণ করেন ‘মাদার টাং’। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বাঙালীর আত্মত্যাগ এবং প্রবাস জীবনের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলোকে একসূত্রে গেঁথে এক ধরনের অন্তর্বেদনা ফুটিয়ে তোলেন তিনি। বিদেশে বড় হওয়া বাঙালী ছেলে-মেয়েরা কিভাবে নিজের মায়ের ভাষাকে ভুলে যাচ্ছে, কিভাবে অন্যের ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছে তারাÑ নাদিম ভারাক্রান্ত হৃদয়েই তা তুলে ধরেন। মাত্র ১২ মিনিটের নির্মাণ। তাতেই অধিকার করে নেয় দর্শকদের। তথ্যচিত্রে প্রধান চরিত্র হয়ে আসেন কবি আসাদ চৌধুরী ও তার নাতনি রাইদা ফাইরোজ মিষ্টি। মাতৃভাষা কেন্দ্রিক হওয়ায় দুই প্রজন্মের গল্প আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করে। সবার হয়ে ওঠে ডক্যুফিল্মটি। নাদিম জানান, নির্মাতার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন হলিউডের ইন্টারন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট এ্যাওয়ার্ড। ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়ে পেয়েছেন প্লাটিনাম এ্যাওয়ার্ড। কলকাতার সিআইসিএফএফ থেকে অর্জন করেছেন আউট সাইড এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড। আরও বেশ কিছু পুরস্কার তার পাওয়া হয়েছে। তবে পুরস্কারই শেষ কথা নয়। নাদিম বলেন, বিদেশীদের বড় অংশটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে জানে না। আমেরিকা, কানাডা, ডেনমার্ক, স্পেন, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, রুমানিয়া, মেক্সিকো, পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশে ছবিটি দেখিয়ে বাঙালীর ভাষা সংগ্রামের কথা জানানোর চেষ্টা করেছি আমি। ভবিষ্যতেও দেশকে মূল ধরে কাজ করে যেতে চান নাদিম। বলেন, ফিল্মের ওপর পড়া লেখা করতে কানাডায় এসেছিলাম। এখন পরিবার বন্ধুবান্ধব হয়েছে। তবে সময় সুযোগ মতো স্থায়ীভাবে দেশে ফিরতে চাই। কিছু কথা বলার আছে। চলচ্চিত্রের ভাষায় বলতে চাই আমি। সেইসঙ্গে মূল ধারার চলচ্চিত্রের কাজ করতে চান বলেও জানান তিনি।
×