ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত

একজন সফল ভাষাবিজ্ঞানী

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

একজন সফল ভাষাবিজ্ঞানী

এ বছর প্রবন্ধের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮) পান অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক (জন্ম ৩ নবেম্বর ১৯৪৮)। তিনি একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক-রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী। বাংলা একাডেমি অবশ্য নির্দিষ্ট করে জানায়নি কোন ক্ষেত্রে বা কোন প্রবন্ধের জন্য প্রাজ্ঞ-প্রবীণ এই প্রাবন্ধিককে পুরস্কৃত করা হয়। আমরা জানি, বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (প্র.প্র.২০১১) বইটি বাংলাদেশ ও ভারতের যে-একত্রিশজন ভাষাবিজ্ঞানী-গবেষকের প্রবন্ধে সমৃদ্ধ ড. মাহবুবুল হক তাঁদের অন্যতম। শুধু তাই নয় বইটির দু’জন সহ-সম্পাদকের একজনও তিনি। এটি প্রকাশের পর মাত্র দু’বছর সময়ের মধ্যেই অসীম অধ্যবসায় আর একনিষ্ঠতা নিয়ে ড. রফিকুল ইসলাম ও ড. পবিত্র সরকারের সাথে তিনি সম্পাদনা করেন প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪)। বলা বাহুল্য প্রথম গ্রন্থটি প-িত ও গবেষকগণের বিচারের উপযুক্ত হলেও সাধারণ পাঠক, ভাষা ব্যবহারকারী এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও উপযোগিতার ভিত্তিতে প্রণীত হয় দ্বিতীয় গ্রন্থটি; সম্পাদকত্রয় ‘এ গ্রন্থটি মূলত তিনজনের রচিত’ বললেওÑএঁরা সকলেই প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ-এর মূল লেখকদের কাছে ঋণ স্বীকার করেন। স্মরণ করিয়ে দেন এ গ্রন্থটি পূর্ববর্তী গ্রন্থটির হুবহু অনুসরণ নয়। এখানে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হকের মুক্ত চিন্তার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। অন্য সকল পরিচয় ছাপিয়ে আমাদের সামনে আসেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক বৈয়াকরণ, একজন মাতৃভাষা প্রেমিক ভাষাবিজ্ঞানী। উইকিপিডাতেও পাই: ‘মাহবুবুল হক হলেন একজন গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক’। ড. মাহবুবুল হক জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুর জেলার মধুখালীতে। তবে শৈশব থেকে বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় আধুনিক বাংলা কবিতা হলেও বিশ শতকেই দুই বাংলায় তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয় তাঁর বাংলা বানানের নিয়ম (১৯৯১) গ্রন্থটি। এর ভূমিকায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেন: ‘বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। বানানের নিয়মকানুন যে প্রতিদিন বদলাচ্ছে, তা নয়; বানান আয়ত্ত করার বিষয়ে আমাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলা বাড়ছে, বাড়ছে এক ধরনের হটকারিতাও।’ এই হটকারিতা হটাতে ড. মাহবুবুল হক সদা সচেষ্ট। আমাদের ঔদাসীন্য সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধে লেখেন, বাঙালির ভাব ও কাজে সমন্বয়ের অভাব। ড. মাহবুবুল হক এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, তিনি তাঁর মাতৃভাষা নিয়ে ভাবেন আবার কাজও করেন। বাংলা বানান নিয়ে তাঁর ভাবনা যদি হয় বাংলা বানানের নিয়ম, তবে তাঁর কাজ হচ্ছে খটকা বানান অভিধান (২০১৭)। প্রথমটি বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য, দ্বিতীয়টি বাংলা ভাষার কর্মীগণের নিমিত্তে। আগেরটি তাত্ত্বিক, পরেরটি প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: ‘সে বিদ্যা তোমার/ সম্পূর্ণ হবে না বশ; .../ শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।’ ড. মাহবুবুল হক ভাষাবিদ্যাকে বশ করতে সচেতনভাবে সদাব্যস্তÑপ্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪) সম্পাদনা তার প্রমাণ। বাংলা বানানের নিয়ম-এ তিনি ভাষা লেখতে শেখান, খটকা বানান অভিধান-এ এসে তিনি ভাষার পরিবর্তিত প্রয়োগ উপস্থাপন করেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতেÑযুক্তিনিষ্ঠ ভাষায়। মাহবুবুল হক কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসেবে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। বর্তমানে তিনি অধ্যাপক পদে চাকরি শেষে অবসরে আছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, সম্পাদনা, অনুবাদ ও পাঠ্যবই রচনা করে দুই বাংলায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন ড. মাহবুবুল হক। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও ¯œাতক পর্যায়ের কয়েকটি বাংলা পাঠ্য বইয়ের রচয়িতাও তিনি। আহ্বায়ক হিসেবে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১২ ও ২০১৩ শিক্ষাবর্ষের বাংলা শিক্ষাক্রম ও বাংলা পাঠ্যবই প্রণয়নে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে তাঁর। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির জন্য তাঁর লেখা বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি (২০০১) বইটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যম-িত। বইটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে বহুল জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এর ভাষা সহজ-সরল ও বিষয়ানুগ; সর্বোপরি নিষ্ঠাবান এক বৈয়াকরণের দীর্ঘদিন ভাষাবিজ্ঞান ও ব্যাকরণ পঠন-পাঠনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। তাঁর ব্যাকরণের আলোচনায় যেমন আছে যুক্তিনিষ্ঠতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা তেমনি আছে প্রচলিত প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক পরিভাষা-সংজ্ঞা গ্রহণের প্রাঞ্জল প্রবণতা। তিন প্রকার পুরুষের পরিবর্তে পাঁচ প্রকার পক্ষ ব্যবহার তার প্রমাণ। নির্মিতি অংশেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক এ ভাষাবিজ্ঞানীর ভাষা সাম্প্রদায়িকতা বর্জিত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমুজ্জ্বল। পত্রলিখন অংশে তাঁর কোনো পত্রের শীর্ষে তিনি ধর্মীয় কোন শব্দ ব্যবহার করেননি। যদিও এদেশে (সামরিক শাসকদের বন্দুকের নলের ভয়ে চালু হওয়া) এখনও আমরা প্রাতিষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ পত্রেও রাষ্ট্রধর্মের শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতে বাধ্য হই (মুখে যতই বলি ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার)। সংলাপ রচনায়ও তিনি: ‘Ñকেমন আছেন? Ñআলহামদুলিল্লাহ্’ জাতীয় সংলাপ পয়দা করেননি। ভাষণের শুরু করেছেন এভাবে: ‘শ্রদ্ধেয় সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি ও উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করছি।’ আর শেষ করেছেন এই বলে : ‘সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি আমার বক্তব্য। ধন্যবাদ। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। অথচ আমরা দেখি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে এমন অনেক ব্যক্তিও ইদানীং বক্তব্য শুরু করেন সামরিক ফরমানে সংবিধানে সংযুক্ত ধর্মীয় বাক্য উচ্চারণে আর শেষ করেন ‘আস্সালামুওয়ালাইকুম্’ জানিয়ে। বাজারে প্রচলিত বইগুলোও ওমোন উদাহরণে সয়লাব। অথচ আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক শিক্ষিত জাতি গড়বার। ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক সেই লক্ষ্যের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। শুধু গ্রন্থে ও শ্রেণিকক্ষে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও সদাচারণে তিনি অসাম্প্রদায়িক। ফোনে ধরেই তিনি ‘শুভ সকাল’ বা ‘শুভ সন্ধ্যা’ জানিয়েদেন; ‘আদাব/ স্লামালিকুম’ জানানোর সুযোগ দেন না। এভাবে তিনি তাঁর শিক্ষার্থী-সাথীদের মধ্যেও অসাম্প্রদায়িক ভাষাচর্চার বিস্তার ঘটান প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশ, ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তাঁর চল্লিশটির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: ‘তিনজন আধুনিক কবি’, ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’, ‘সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি’, ‘বইয়ের জগৎ: দৃষ্টিপাত ও অলোকপাত’, ‘বাংলা কবিতা : রঙে ও রেখায়’, ‘ভাষার লড়াই থেকে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ, ফোকলোর ও অন্যান্য’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ’, ‘বাংলা সাহিত্যের দিক-বিদিক’, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ ও ‘অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম’ ইত্যাদি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ আক্ষেপ করে লেখেন, ‘এদেশের মুসলমান এক সময় মুসলমান বাঙালি, তারপর বাঙালি মুসলমান, তারপর বাঙালি হয়েছিল; এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি মুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি, এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছে। ... ’ (প্রবচন: ৬২)। অথচ, প্রায় একই সময়ে ভাষাবিজ্ঞানী ড. মাহবুবুল হক তাঁর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন: মাতৃভাষা বাংলার প্রতি এক শ্রেণির বাঙালির অবজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা চর্চায় আমাদের অগ্রগতিও কম নয়। বাস্তবে, বাংলা ভাষা তাই নদী-দূষণ বা মৃত নদীর মতো হবার আতঙ্ক তো নেইই বরং বাংলা ভাষার প্রয়োগ আজ বিজ্ঞাপনে-বিনোদনে, মিডিয়ায় ও প্রাত্যহিক চর্চায় অপ্রতিরোধ্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে এবং বিভিন্ন দৈনিক-সাময়িকীতে তিনি বাংলা ভাষা চর্চার সম্ভাবনা-ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ প্রকাশের প্রয়াস চালান। বাংলা ভাষার অভিধান ও পরিভাষা প্রণয়ন, বাংলা বানান প্রমিতকরণ, বাংলা ভাষার বিশুদ্ধ প্রয়োগের প্রক্রিয়া, সংস্কৃত ও স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের প্রভাবমুক্ত বাংলা ব্যাকরণ রচনার প্রয়াসÑএ সব বাংলা ভাষা চর্চার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি রচনা করেন বাংলা ভাষা: কয়েকটি প্রসঙ্গ (২০০৪) নামক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ। গ্রন্থের ভূমিকায় প্রাজ্ঞ এ প্রাবন্ধিক বলেন: ‘গত শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণায় নতুনতর আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বাংলা বানান প্রমিতকরণ, অভিধান প্রণয়ন, ব্যাকরণ রচনা, ভাষা পরিকল্পনা, ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে। বানান প্রমিতকরণ ও অভিধান প্রণয়নে লক্ষণীয় অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। মূলত এসব দিকই আলোচিত হয়েছে এ বইয়ে সংকলিত আপাত-বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধগুলিতে।’ গ্রন্থের পনেরোটি প্রবন্ধ পাঁচটি বিষয়ে বিন্যস্ত। ‘অভিধান’ বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ। এগুলো হলো: ‘প্রথম বাংলা শব্দকোষ’, ‘বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধান : একটি মূল্যায়ন’ এবং ‘বাংলা একাডেমির অভিধান: পরিচিতি ও মূল্যায়ন’। এখানে গবেষক দেখান: ‘সর্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের টীকাসর্বস্ব (১১৫৯ খ্রি.) প্রথম বাংলা শব্দকোষের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য-চিহ্নিত’ (পৃ.১১)। তবে মনোএল-দা-আস্সুম্পসাঁও সংকলিত বাংলা ও পর্তুগিজ ভাষার শব্দকোষটি (১৭৪৩ খ্রি.) ‘রোমান হরফে লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধানের মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে’ (পৃ.১২)। আর অ্যান্থনি ডি. সুজা-ও ইঙ্গরাজি ও বাঙ্গালি বোকেবলরি (১৭৯৩) বাংলা হরফ ব্যবহার করে ছাপা প্রথম শব্দকোষ’ (পৃ. ১৪)। অভিধান আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন: ‘এখন আমরা অভিধান বলতে যা বুঝি, প্রথম দিককার বাংলা অভিধান সে-ধরনের ছিল না। সেগুলো মূলত ছিল শব্দকোষ’ (পৃ.১৪)। এভাবে তিনি বাংলাদেশে গত প্রায় অর্ধশতকের বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করেন স্বকীয় সাবলীল ভাষায়। ‘বানান’ বিষয় শিরোনামে সবচেয়ে বেশিÑছয়টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এগুলো হলো: ‘বাংলা ভাষার শৃঙ্খলা ও বাংলা বানানের প্রমিতকরণ’, ‘বাংলা বানান সংস্কার ও প্রমিতকরণের অর্ধশতক’, ‘বাংলা বানানের গতি-প্রকৃতি’, ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম প্রসঙ্গে’, ‘বাংলা বানানের সমস্যা’ এবং ‘বাংলা ভাষা ব্যবহারে সাধারণ অশুদ্ধি : দূরীকরণের উপায়’। এতে বাংলা বানান সম্পর্কে বাংলাদেশের একটি সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে। এখানে তিনি দেখান: ‘প্রমিত বাংলা বানানের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সমস্যা হলো, বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে এর লিপিপদ্ধতির অসঙ্গতি’ (পৃ.৬৬)। বাংলা লিপিপদ্ধতি বা হরফ আধিক্যজনিত সমস্যার উদাহরণও দেন তিনি। ‘যেমন: বাংলায় হ্রস্ব উ-কারের রয়েছে পাঁচটি বর্ণচিহ্ন। দেখা যাবে প্রচলিত রূপে তুলি, রুচি, শুভ, বস্তু, হুতাশন শব্দের প্রত্যেকটিতে উ-কারের চিহ্ন আলাদা আলাদা’ (পৃ.৬৭)। ‘ব্যাকরণ’ বিষয়ক একটি প্রবন্ধ: ‘বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণের সন্ধানে’। এতে তিনি মনোএল-দা-আস্সুম্পসাঁও থেকে শুরু করে জ্যোতিভূষণ চাকী’র বাংলাভাষার ব্যাকরণ (১৯৯৬) ও সুভাষ ভট্টার্যের বাঙালির ভাষা (২০০০) পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাকরণ ও বাংলা ভাষাতত্ত্ব চর্চার গবেষণা ও গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচয়-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেছেন। ‘ভাষা’ বিষয় শিরোনামে দীর্ঘ পরিসরে বাংলাদেশের ভাষাপরিস্থিতি বিশ্লেষিত হয়েছে পাঁচটি প্রবন্ধে। এগুলো হলো: ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষারীতির রূপ-রূপান্তর’, ‘বাংলা ভাষার উন্নয়ন’, ‘মাতৃভাষা : এই বিশে^’, ‘সংবাদপত্রের বাংলা ভাষা’ এবং ‘শব্দ ও বাক্যের শুদ্ধ প্রয়োগ’। ভাষার অপপ্রয়োগের বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি সমকালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বাক্যের উদাহরণ দিয়ে পদগুচ্ছ বিন্যাসে বিশৃঙ্খলাজনিত ত্রুটির কারণে দুর্বল বাক্যগুলোকে উন্নত বাক্যে রূপান্তর দেখিয়েছেন চমৎকার মুন্সীয়ানায়। ড. মাহবুবুল হক শিমুল বড়–য়াকে সাথে নিয়ে সম্পাদনা করেন চাটগাঁ ভাষার রূপ পরিচয় (২০১২)। সম্পাদকীয়তে তিনি চাটগাঁ ভাষা বিষয়ে সুধী পাঠক, আগ্রহী গবেষকও সংশ্লিষ্ট সবার মতামত প্রত্যাশা করেন। এ গ্রন্থে তাঁর ‘চাটগাঁ ভাষার অভিধান প্রণয়ন’ প্রবন্ধে ইতোমধ্যে প্রণিত চাচগাঁ ভাষার চারটি অভিধানের সীমাবদ্ধতা, সমস্যা, তার সমাধানের পন্থাও নির্দেশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে অপর ভাষাবিজ্ঞানীর মন্তব্য উল্লেখ্য: ‘চট্টগ্রামী ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত বিবরণ সংবলিত ভূমিকা ছাড়া চট্টগ্রামী বাংলার কোনো অভিধান সম্পূর্ণ নয় বলে আমাদের বিশ্বাস’ (আবুল কাসেম, ২০০৮:৬১)। তাই প্রাবন্ধিক ড. মাহবুবুল হক যথার্থই মনে করেন: ‘ভবিষ্যৎ অভিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রেও চাটগাঁ ভাষার বর্ণমালা হিসেবে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করাই সঙ্গত বলে মনে করি। তবে উচ্চারণ প্রমিতকরণের সুবিধার জন্যে সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক ধ্বনিলিপিতে ভুক্তিগুলির প্রতিলিপি দেখানো হলে ভালো হয়। ... চাটগাঁ ভাষার অভিধান প্রণয়ন একটি সুপরিকল্পনানির্ভর, শ্রমনিষ্ঠ, মাঠকর্মনির্ভর, গবেষণাধর্মী কাজ। ... এ কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত হবেন তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’(পৃ.- ১০৬-১০৭)। ড. মাহবুবুল হক আরও লিখেন: ‘ইতোমধ্যে চাটগাঁ ভাষার চারটি অভিধান প্রণীত হয়েছে। এগুলো হল আহমেদ আমিন চৌধুরী সংকলিত চট্টগ্রামী বাংলার শব্দসম্ভার (১৯৯৮), নূর মোহাম্মদ রফিক সম্পাদিত চট্টগ্রামের অঞ্চলিক ভাষার অভিধান (২০০১), আহমেদ আমিন চৌধুরী সংকলিত চট্টগ্রামী ভাষার অভিধান ও লোকাচার (২০০৯), মাহবুবুল হাসান সম্পাদিত চট্টগ্রামী বাংলার অভিধান (২০১০)। এসব অভিধান সংকলিত হওয়ার অনেক আগেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে (১৯৬৫) চাটগাঁ ভাষার অনেক শব্দ সংকলিত হয়েছে’ (পৃ. ১০৫Ñ১০৬)। এসব মন্তব্য থেকেও পাঠক প্রমাণ পাবেন ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনের। প্রাবন্ধিক ড. মাহবুবুল হক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণায় রত। অনেক গবেষকের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বর্তমান লেখকের পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থাকারে প্রকাশ এবং গ্রন্থের নতুন নাম নির্ধারণের কৃতিত্বও প্রাজ্ঞ এ ভাষাবিজ্ঞানীর। বেদনার বিষয় তিনি বর্তমানে বৃক্ক রোগে আক্রান্ত। তবু তাঁর মন-মনন থেমে নেই প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনায় ও গবেষণায়। গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক না হয়েওে তাঁকে দেখেছি অনেক গবেষককে বাসায় ডেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে আলোচনা করছেন, প্রেরণা দিচ্ছেন, ব্যক্তিগত দুষ্প্রাপ্য বই ধার দিয়ে সাহায্য করছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষজ্ঞের সাথে ফোনে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, আবার মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হলে নিজের সঙ্গে খেতে বসাচ্ছেন। এমন নিবেদিতপ্রাণ ভাষা-গবেষকের ৭১তম জন্মদিনে তাঁকে আবারও অভিবাদন। বাংলা ভাষা ও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ নিয়ে নিরলস গবেষণায় তিনি শতায়ু হোন; আরও আলোকিত করে চলুন বাংলা ভাষার অকর্ষিত-অনালোচিত অধ্যায়।
×