ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্মরণ ॥ সৃজন ও কর্মে শুধু নারী নয় সাধারণ মানুষেরও মুক্তি চেয়েছেন

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

স্মরণ ॥ সৃজন ও কর্মে শুধু নারী নয় সাধারণ মানুষেরও মুক্তি চেয়েছেন

সেই বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নারী প্রগতির এই অগ্রনায়ক অন্ধকার সমাজকে আলোর পথে নিয়ে আসতে যে অবিস্মরণীয় সৃজন ও কর্মযোগ সর্বসাধারণের সামনে হাজির করেন সময় ও কালের দীর্ঘ পরিবর্তনের পরও তার আবেদন কিছুমাত্র কমেনি। একজন সচেতন নারী হিসেবে প্রথমেই তাঁর দৃষ্টি ছিল সমাজের অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীর প্রতি। সুতরাং যেদিন সৃজনযজ্ঞে নিজের অভিগমনের দ্বার উন্মোচন করলেন সেদিন সবার আগে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, অসহায়, অবরোধবাসিনী, পশ্চাদপদ ও নিরক্ষর নারী সমাজ। পিছিয়ে পড়া এই সমাজটির দুঃখ-দুর্দশাকে প্রত্যক্ষভাবে নজরে আনতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল এই অবরুদ্ধ অন্ধকার জগত শুধুমাত্র নারীদের নয় সিংহভাগ উৎপাদক, নির্বিত্ত এবং হতদরিদ্র মানুষেরও। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নিপীড়িত অংশ হিসেবে নারীদের অসহায়ত্ব অনেক বেশি। অতি বাল্যকাল থেকে মেয়েদের তৈরি করা হয় পরের বাড়ির উপযুক্ত ঘরনি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। সেখানে শিক্ষা বলতে শুধু ধর্মীয় এবং গার্হস্থ্য কার্যক্রম। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া তো দূরের কথা অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত তারা পেত না। আর বিদ্যালয়? সে তো সুদূর পরাহত এক অজানা, অদৃশ্য জগত যার ছায়া মাড়ানো নিষেধই শুধু নয় কঠিন অর্গলে দ্বারও রুদ্ধ। সেই রুদ্ধ দরজায় করাঘাত করা নিষ্ফল আবেদন ছাড়া অন্য কিছু নয়। সুতরাং অসহায় ও পর্দার অন্তরালে থাকা মেয়েদের ঘর থেকে বাইরে পা রাখতে শিক্ষাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বিবেচনায় বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষাকেই সামনে নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর হলেন। এর জন্য দরকার পারিবারিক উপযুক্ত পরিবেশ যেখান থেকে অবোধ বালিকারা সামাজিক অভিশাপের শৃঙ্খলে বাধা না পড়ে অবাধ ও মুক্ত জগতে শিক্ষার মতো অতি আব্যশিক পর্যায়ে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। সেই লক্ষ্যে তার বহুমাত্রিক সৃজন ও কর্মশক্তিকে প্রয়োগ করতে দৃঢ়চিত্তে সামনে এগিয়েই গেছেন। তবে স্ত্রী-শিক্ষা যে সমাজে নির্বিঘেœ, নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাবে সে ব্যাপারেও বেগম রোকেয়ার সংশয় ছিল। তার মতে, ‘স্ত্রী শিক্ষা শব্দ গুনলেই শিক্ষার কুফলের একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়া ওঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজে অম্লান বদলে ক্ষমা করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্ত মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোন কাল্পিত দোষ শতগুণে বাড়াইয়া সে বেচারীর ওই শিক্ষার ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে ‘স্ত্রী শিক্ষাকে নমস্কার।’ তার পরও নারী শিক্ষার এই পথিকৃৎ সমাজের সমস্ত রক্ষণশীল কূপম-ূকতাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষার আলোকিত জগতে পা রাখার উদাত্ত আহ্বান জানান। তাঁর মতে এটা শুরু করতে হবে একেবারে পরিবার থেকে। তিনি নিজে যেমন করেছেন। পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবকদের উদ্দেশে যৌক্তিক আবেদন তুলে ধরে কন্যা সন্তানদের শিক্ষা বিস্তারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে অভিমত ব্যক্ত করেন একজন কন্যাশিশুকে বাল্য বয়সে বিয়ে দিতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয় তার অর্ধেক মূল্যে মেয়েটিকে শিক্ষার আলো দেয়া যে কোন বাবা-মায়ের আয়ত্তের মধ্যেই থাকে। এতে অবোধ বালিকারা শিক্ষার্জন করে একটি সম্মানজনক পেশায় নিজেকে দাঁড়ও করাতে পারে। আর এক স্বাবলম্বী মেয়ে কোন অংশেই একজন পুরুষের চাইতে খাটো হতে পারে না। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাই নারীদের অন্যের অধীনে রাখতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। অর্ধাংশ এই গোষ্ঠী শিক্ষিত হয়ে একটি পেশাকে বরণ করতে পারলে সে শুধু নিজেই তৈরি হবে না পাশাপাশি সমাজকেও নানা মাত্রিকে এগিয়ে দেবে। সমাজ সচেতন এই বিচক্ষণ নারী ব্যক্তিত্ব সুচিন্তিত ধারণা ব্যক্ত করেন যে সমাজের দুটো চাকাই যদি সমানভাবে গতিশীল না হয়, কোন কারণে একটি যদি পেছনে পড়ে থাকে তাহলে পদে পদে হোঁচট খেতেই হবে। তাই সেই অসম সামাজিক পশ্চাদবর্তিতা থেকে বঙ্গললনাদের বের হয়ে আসতেই হবে। তা না হলে যথার্থ মুক্তির নিশানা কারও সামনেই প্রদর্শিত হবে না। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রতি বেগম রোকেয়ার দরদ ছিল অপরিসীম। নিজের ভাষা ও মাতৃভূমিকে ভালবাসতেন সবচেয়ে বেশি। সেই কারণে দেশের জনগোষ্ঠীও ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। বিশেষ করে কৃষিনির্ভর আমাদের এই বাংলায় চাষাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে উদয়াস্ত শ্রম বিনিয়োগ তাকেও অত্যন্ত সহানুভূতির আলোকে প্রত্যক্ষ করে তাদের শারীরিক খাটা-খাটনিকে উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু সমাজে তার যথার্থ মূল্যমান না হওয়ায় ক্ষুব্ধ চিত্তে অসন্তোষও প্রকাশ করেন। ‘চাষার দুঃখ’ প্রবন্ধে সে আক্ষেপের সুর শোনা যায়Ñ ‘আমাদের বঙ্গভূমি সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা তবু চাষার উদরে অন্ন নাই কেন? কৃষক কন্যা জরিমনের মাথায় বেশ ঘন ও লম্বা চুল ছিল। তার মাথায় প্রায় আধপোয়া তেল লাগিত। সেই জন্য যেদিন জরিমন মাথা ঘষিত, সেদিন তার মা তাকে রাজবাড়ী লইয়া আসিত, আমরা তাকে তৈল দিতাম। হা অদৃষ্ট! যখন দুই গ-া পয়সায় এক সের তেল পাওয়া যাইত, তখনও জরিমনের মাতা কন্যার জন্য এক পয়সার তেল জুটাইতে পারিত না।’ জনদরদী বেগম রোকেয়া বাংলার কৃষক সমাজের যে দুর্দশার চিত্র স্পষ্ট করেন গ্রামবাংলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেটাই ছিল সমকালীন সমাজের বাস্তব প্রতিবেদন। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরুর প্রচলিত প্রবাদ হয়তবা সেই পুরাকালের। তাঁর সময়েও তিনি বাংলার এমন সম্পদ দেখতে পারেননি পাশাপাশি তিনি এও দেখেছেন নারী-পুরুষের শ্রম-মূল্যের বিভাজন। বেগম রোকেয়াও বিশ্বাস করতেন শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নির্বিত্তরাই শোষিত কিংবা লাঞ্ছিত হয় তারা নারী-পুরুষ যাই হোক না কেন। আবার সেখানেও পিছিয়ে পড়া অংশ হিসেবে নারীদের অবস্থা আরও শোচনীয়। দেশের মাটি আর মানুষকে একান্ত আপনজন বিবেচনায় তাদের সপক্ষে দৃঢ়কণ্ঠে অভিমত ব্যক্ত করতে এই দুঃসাহসী, অকুতোভয় নারীকে একবারও ভাবতে হয়নি। মাতৃভাষাকেও অন্তর নিঃসৃত অর্ঘ্যে সব সময়ই পূজা করতেন। তৎকালীন অভিজাত মুসলিম পরিবারের ঐতিহ্যিক ভাষা ছিল উর্দু। বেগম রোকেয়া শুধু সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তানই নন উর্দুভাষী স্বামীর জীবন সঙ্গীও বটে। সে মাত্রায়ও বাংলা ভাষার চর্চা ছিল নিয়মিত এবং প্রতিদিনের জীবন প্রবাহের অনুষঙ্গ। বেগম রোকেয়ার জবানিতেই শোনা যাক সেই দামী বয়ান বোনকে লেখা এক পত্রে আপাজান, আমি শৈশবে তোমারই স্নেহের প্রসাদের বর্ণপরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দু ও ফার্সী পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাংলা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাংলা পড়ার অনুকূলে ছিলে। আমার বিবাহের পর তুমিই আশঙ্কা করিয়াছিলে যে আমি বাংলা ভাষা একেবারে ভুলিয়া যাইব। চৌদ্দ বছর ভগলপুরে থাকিয়া, বঙ্গ ভাষায় কথাবার্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও যে বঙ্গভাষা ভুুলি নাই। তাহা কেবল তোমারই আশীর্বাদে। অতঃপর কলকাতায় আসিয়া ১১ বছর যাবত এই উর্দু স্কুল পরিচালনা করিতেছি। এখানেও সকলেইÑ পরিচারিকা, ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ইত্যাদি উর্দুভাষিণী। প্রাতঃকাল হতে রাত্রি পর্যন্ত উর্দু ভাষাতেই কথা কহিতে হয়। আবার বলি এতখানি অত্যাচারেও যে বঙ্গভাষা ভুলিয়া যাই নাই, তাহা বোধহয় তোমারই আশীর্বাদের কল্যাণে।’ আধুনিক স্বশিক্ষিতা বেগম রোকেয়ার ইংরেজীতে অনেক রচনা এবং চিঠিপত্র আছে কিন্তু উর্দুতে তেমন কোন নিদর্শন আছে কিনা রোকেয়া রচনাবলীতে তা পাওয়া যায় না। ইংরেজী ভাষায় সুপ-িত এই মহীয়সী নারী আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেই সময়ের একজন নিবেদিত জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যা তার সৃজনকর্মকে নানা মাত্রিকে উদ্দীপ্ত করে।
×