ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

চলে গেলেন চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০৭:২০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৮

চলে গেলেন চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন

ছোট বেলায় আঁকাআঁকির মাধ্যমে রঙের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় তাঁর। ভর্তি হয়েছিলেন বুয়েটের স্থাপত্য বিদ্যা বিভাগে, কিন্তু স্থপতি হওয়ার পাট না চুকিয়েই সিনেমাটোগ্রাফি পড়তে চলে যান পুনেতে। ক্যামেরা হাতে কাজ করেছেন ‘সূর্যদীঘলবাড়ী’ ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ এর মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি আর কেউ নন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর পুরনো ঢাকার আগানবাব দেউড়িতে। তার বাবা কাজ করতেন সিনেমা অফিসে। শৈশবে তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়া লেখা চালিয়ে যান। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র দুই ডলার দিয়ে কেনা প্রথম ক্যামেরা দিয়ে তার আলোকচিত্রী জীবনের শুরু। প্রথম সাত বছর ধার করা ক্যামেরা আর চলচ্চিত্রের ধারকরা ফিল্ম দিয়ে তিনি কাজ করেন। ঐ ফিল্মগুলো ছিল সাদা কালো। তিনি ৩৬ টাকা ব্যয়ে রঙিন ছবি তোলা শুরু“করেন ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী ২০ বছর আলোক চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ কে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। ক্যামেরা হাতে কাজ করেছেন সূর্যদীঘল বাড়ী, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। চিত্র গ্রাহক পরিচয়ের চেয়ে ও তিনি খ্যাতি মান ছিলেন আলোক চিত্রী হিসেবে। দেশের বাইরেও তার সে খ্যাতি আছে। তার হাত ধরেই এদেশে তৈরি হয়েছে অসংখ্য আলোকচিত্রী। এই গুণী জন গত ১ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন। আনোয়ার হোসেনের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো হলো- সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯), এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০), পুরস্কার (১৯৮৩), অন্যজীবন (১৯৯৫) ও লালসালু (২০০১)। দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করে আসছেন। তিনি সে দেশের নাগরিকও। বিয়ে করেছেন একজন ফ্রান্সের মেয়েকে। আনোয়ার হোসেনের সংসারে স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে আকাশ ও মেঘ দূত আছে। দেশের প্রতি ভালবাসার টানে ফ্রান্সের নাগরিক হয়েও পর দেশ ছেড়ে নিজের জন্মভূমিতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। দেশের মাটিতেই ঘুমাতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হলো দেশেই। বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোক চিত্রী, পাঁচ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্র গ্রাহক। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাপানের আশাহি পেইন্টিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া আনোয়ার হোসেন ১৯৭৮ সালে কানাডায় কমনওলেথ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ছয়টি মেডেল জয় করেন। এরপর চার দশকে ৬০টির মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কার জমে এই আলোকচিত্রীর ঝুলিতে। তার এই অকাল প্রয়াণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই গণমাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নাসির আলী মামুন বলেন, একাত্তরে তিনি অসীম সাহসিকতায় ধারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ সব আলোকচিত্র। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর হাতে রাইফেল আর কাশফুল চেপে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ছবিটি তুলেছিলেন এক কথায় তা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধনির্ভর তার এমন অনেক অসাধারণ ছবি আছে, যা আমাদের দেখা হয়নি। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফিতে যখন যুক্ত হলেন, সেখানেও সৃষ্টি করলেন নতুন ধারা। অথচ এমন একজন গুণী অবহেলিত হয়েছেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আনোয়ার হোসেন সাদা-কালো ছবিতেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথাকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসেবে গল্পকে অতিক্রম করে যেন কবিতা হয়ে উঠত তার ধারণকৃত দৃশ্য। সেই চিত্রময়তার কারণে ছবির গল্প পেত মহাকাব্যিক রূপ। তাই এ দেশের মাটি, মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্পের কথা বললে আনোয়ার হোসেনের কথা বলতে হবে। নৃত্যশিল্পী আমানুল হক বলেন, আনোয়ার হোসেনের ছবি কথা বলত। অনেক সময় চলচ্চিত্রের সঙ্গীত বা সংলাপকে ছাপিয়ে অনবদ্য হয়ে উঠত তার ক্যামেরাবন্দী দৃশ্য। চিত্রসমালোচক মইনুদ্দীন খালেদ বলেন, আনোয়ার হোসেন ছিলেন ক্যামেরা হাতের মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছেন। কিন্তু সে কথা তেমনভাবে আমরা বলিনি কখনও। আর বৈশ্বিক আলোকচিত্রের প্রেক্ষাপটে আনোয়ার হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের দূত।
×