ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যশোর হানাদার মুক্ত দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৮

যশোর হানাদার মুক্ত দিবস আজ

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ খাবার টেবিলে খাবার সাজানো। উনুনে কড়াইতে তরকারি তখনও গরম। খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পাক আর্মি। কিন্তু সেগুলো খাবার সময় তারা পাননি। তার আগেই যশোরের চৌগাছা দিয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী ঢুকে পড়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে তারা এরকম দেখতে পাই। এদিন দুপুরের পরপরই যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। প্রথম শত্রুমুক্ত হয় যশোর জেলা। যশোরেই প্রথম উঠেছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। এ দিবসে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহরের কালেক্টরেট চত্বর থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়ে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অপর্ণ করবেন সর্বস্তরের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) বৃহত্তর যশোর জেলার (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও নড়াইল) উপ-অধিনায়ক রবিউল আলম জানান, ’৭১ সালের ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ- যুদ্ধ হয়। এ সময় মিত্রবাহিনীও সীমান্ত এলাকা থেকে যশোর সেনানিবাসসহ পাক আর্মিদের বিভিন্ন স্থাপনায় বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পর্যদস্তু পাকবাহিনী ৫ ডিসেম্বর থেকে পলায়ন শুরু করে। যশোর সেনানিবাস ছেড়ে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে খুলনার গিলাতলা সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। পলায়নকালে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর শহরতলীর রাজারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তাদের প্রচ- লড়াই হয়। ৬ ডিসেম্বর বিকেলের আগে যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় পাক হানাদাররা। বিকেলে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সেনানিবাসে প্রবেশ করে দখল নেয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুক্তির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধা-জনতার ঢল নামে শহরে। পাড়া মহল্লায়ও চলে খ- খ- আনন্দ মিছিল। মুক্তির আনন্দে ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে ফেটে পড়ে গোটা জেলার মানুষ। থাকে ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জননেতা মশিয়ূর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মেহেরপুর সংবাদদাতা মেহেরপুর থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর। মেহেরপুর মুক্ত দিবস। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে দাঁড়াতে না পেরে ৫ ডিসেম্বর রাতারাতি হানাদার বাহিনীরা মেহেরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। আনন্দ আর উল্লাস করতে করতে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এই দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে স্বাধীনতার সূতিকাগার মুজিবনগর তথা মেহেরপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন এসডিও তৌফিক এলাহির সক্রিয় ভূমিকায় আনসার-মুজাহিদদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। ভারতের শিকারপুরে প্রশিক্ষণ শেষে এ বাহিনী মেহেরপুর প্রবেশ করে। একই দিনে মেহেরপুর মুক্ত করার জন্য চারদিক থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। পাকবাহিনী আগেই এ খবর জানতে পেরে ৫ ডিসেম্বর রাতে মেহেরপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়। হানাদারবাহিনী চলে যাওয়ার সময় মেহেরপুর ওয়াপদা, দ্বিনদত্ত ব্রিজসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয়। পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গার দিকে পালিয়ে গেলে মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা বলতে বলতে শহরে প্রবেশ করে। মুক্ত হয় মেহেরপুর। ডোমার স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর নীলফামারীর ডোমার উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়। উড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের পতাকা হাতে সব শ্রেণীর মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। জয়বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধুর স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস কম্পিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা বোড়াগাড়ী হাসপাতালের উত্তরদিকে হলদিয়াবন ও বুদলিরপাড় গ্রামে অবস্থান নিয়ে পাক সেনাদের প্রতিহত করতে শুরু করে। দুপক্ষের মধ্যে চলে তুমুল গোলাগুলি। এতে ৩ জন পাক সেনা মারা যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে পাক বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে পিছু হঠতে শুরু করে। ৫ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যাতে ডোমারে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বোড়াগাড়ী ব্রিজটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। রাতে বোড়াগাড়ীর উত্তরপাড়ায় পাক বাহিনী হামলা চালিয়ে ৭ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ৬ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খাদিমুল বাশার, ফ্লাইট লে. ইকবাল, মেজর ছাতোয়াল ও মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার আমিনার রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর সকালে ডোমার শহরে প্রবেশ করে ডোমার হানাদার মুক্ত করে। শেরপুরের শ্রীবরদী নিজস্ব সংবাদদাতা শেরপুর থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর। শেরপুরের শ্রীবরদী মুক্ত দিবস। একাত্তরের এদিনে পরাজিত হয় পাক হানাদার বাহিনী। এ যুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হন শ্রীবরদী অঞ্চলের ৩১ মুক্তিযোদ্ধা। নির্বিচারে হত্যার শিকার হয় অনেক গ্রামবাসী। কিন্তু বিজয়ের ৪৭ বছর পরও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি উপজেলার বিভিন্ন বধ্যভূমি। জানা যায়, ৫ ডিসেম্বর রাতে কামালপুর থেকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বকশীগঞ্জ হয়ে পাকিস্তানী মেজর আইয়ুব জামালপুরে যাবেÑ এ খবর ছড়িয়ে পড়ে শ্রীবরদীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। এজন্য তারা স্থানীয় টিকরকান্দি এলাকায় সম্মুুখ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। মেজর আইয়ুব সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে সেই রাস্তায় যাওয়ার পথে শুরু হয় যুদ্ধ। স্থলমাইন বিস্ফোরণ আর গুলির বিনিময়ের মধ্যে পরাজিত হয় মেজর আইয়ুবসহ পাক সেনারা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভোরে শত শত লোক বকশীগঞ্জ সড়কে গিয়ে জড়ো হয়। সবার কণ্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। সেখান থেকে দলে দলে উচ্ছসিত মানুষ আর মুক্তিযোদ্ধারা যায় শ্রীবরদী বাজারের পুরাতন হাসপাতাল মাঠে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ওইসব মুক্তিকামী মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধারা। লালমনিরহাট নিজস্ব সংবাদদাতা লালমনিরহাট থেকে জানান, আজ ৬ ডিসেম্বর। লালমনিরহাট হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে লালমনিরহাট পাক হানাদার মুক্ত হয়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা লালমনিরহাট শহরকে পাক হানাদার মুক্ত করতে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ পরিচালনা করে। মিত্রবাহিনী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়্। তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পাক হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স ও তাদের দোসর অবাঙালীরা দুটি স্পেশাল ট্রেনযোগে রংপুর ও সৈয়দপুরে পালিয়ে যায়।
×