ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ প্রশাসনকে চাপে রাখার কৌশল বিএনপির

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

পুলিশ প্রশাসনকে চাপে রাখার কৌশল বিএনপির

শংকর কুমার দে ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলে পুলিশ প্রশাসনকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার মতো নীতি অবলম্বন করে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কি কি অভিযোগ আনা যায়, দায়ী করা যায় কাকে, কিভাবে দুর্বল করা যায়, মাঠ পর্যায়ে পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার নীতি অবলম্বন করছে দলটি। পুলিশ কর্মকর্তারা হয়রানি, নির্যাতন, গ্রেফতার করছে, এমন অভিযোগ তুলে বিএনপি দলীয় বিভিন্ন মামলার আসামি, গ্রেফতারি পরোয়ানার (ওয়ারেন্ট) আসামি, সন্ত্রাসী, অপরাধীরা গ্রেফতার এড়াচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারাও বিএনপি-জামায়াতের দলভুক্ত বিভিন্ন মামলার আসামি, অপরাধী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজসহ দাগি অপরাধী-আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে ইতঃস্তত দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ জানাচ্ছে নির্বাচন কমিশনে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ইতোমধ্যেই নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) আনিসুর রহমানকে প্রত্যাহার করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার পুলিশ কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলে তাকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির দাবির মুখে ইতোমধ্যেই আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে বদলি আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছে বিএনপি। পুলিশ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দাগি অপরাধী, ওয়ারেন্টের আসামি, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ গ্রেফতার করলেই পুলিশের বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে নানা অভিযোগ তুলে বদলি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অভিযোগকারীদের বক্তব্যের ধরন, বিএনপির অভিযোগের মাত্রা বা দায়িত্বহীন উক্তিতে মনে হয় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবর্তে অন্য কিছু চায় বিএনপি। জঙ্গী-জামায়াতকে দিয়ে পুরনো প্রতিশোধের পুনরায় বদলা নিতে চায়। স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, উগ্র মৌলবাদী, দুর্নীতিবাজ, বিভিন্ন মামলার আসামিদের নিয়ে জোট গঠন করে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে বিএনপি। অথচ বিএনপি দোষ চাপাচ্ছে পুলিশের ওপর। বিএনপির কাছ থেকে এমন নিম্নমানের অভিযোগ আসার মাধ্যমে আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে তৎপর দলটি। নমুনা হিসাবে, ২০০১ সালের নির্বাচনকে ভিত্তি ধরে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি, যাদের অনেকেই সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়েছিল। এমনকি ২০১৩-১৪ সালে যারা জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যায় তারাই বেশি। বিএনপি শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে ২৫টি ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছে। এর সঙ্গে জামায়াত আরও ২২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। বিএনপি যেসব জামায়াতের প্রার্থীর ধানের শীষ মার্কা দিতে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই যুদ্ধাপরাধীর মামলার রায় ঘোষণা ও রায়ে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে নাশকতা-নৈরাজ্য সৃষ্টির মামলার আসামি। নির্বাচনী মাঠে বিএনপি-জামায়াতের রহস্যময় আচরণ আবারও সহিংস রাজনীতির কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জনপ্রশাসন ও পুলিশের উর্ধতন ৯২ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাদের এই দাবি পূরণ যে সম্ভব না তা বিএনপিও ভালভাবেই জানে। তারপরও একের পর এক অভিযোগ করা অব্যাহত আছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, বিএনপির প্যাডে মির্জা ফখরুলের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে দেয়া বদলির একটি তালিকায় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের বদলি চাওয়া হয়েছে এবং যার বদলি চাওয়া হয়েছে চিঠিটি তার হাতেই দেয়া হয়েছে। যার বদলি চাওয়া হয়েছে তার কাছে বদলির চিঠি দেয়াটা কি প্রমাণ করে? আসলেই কি তার বদলি চাওয়া হয়েছে, নাকি বদলি চাওয়ার নামে নানা ইস্যু সামনে এনে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে বিএনপি? পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ সুপার পদে আছেন এমন ৭০ জন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহার চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। শুধু তাই নয়, জনপ্রশাসনের কয়েকজন সচিব, জ্যেষ্ঠ কয়েক কর্মকর্তা ও কয়েকজন জেলা প্রশাসকের নামসহ আরও ২২ জন রয়েছেন তাদের চিঠিতে বদলি করার দাবির তালিকায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই ৯২ জন যদি আওয়ামী লীগপন্থী হন তবে ৯২ জনের বাইরে যারা আছেন তারা কী বিএনপি-জামায়াতপন্থী? গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ৩২০ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কিন্তু ৩২০ ছাত্রদল শিবির ক্যাডার চাকরি করেছেন, যাদের অনেকেই এখনও বহাল তবিয়তে। এখন যদি তাদের বাদ দেয়ার দাবি তোলা হয়? ২০১৩-২০১৪ সালে নির্বাচন ঘিরে কঠিন অবস্থা শুরু হয়েছিল। খুন-হত্যা-পেট্রোলবোমা-অবরোধ সন্ত্রাসের সময়ে মাঠে ছিল পুলিশই। তারা কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে, আহত-পঙ্গু হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যারা এখনই আসামি বানাতে চায়, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যারা এখনই ঢালাওভাবে তালিকা করে মাঠে নামছে তাদের মতলবটা কী? নির্বাচনের পরিবেশ অস্থিতিশীল, অশান্ত করে তোলার অন্য হিসেব না তো এমন প্রশ্ন গোয়েন্দা কর্মকর্তার।
×