ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পথ খুঁজছে বিএনপি। প্রতিদিন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করছে। সেই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ পর্যবেক্ষণে সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিকূল মনে করলে শেষ দিকে গিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে দলটি। খোদ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ভেতরে ভেতরে এমন একটি গুঞ্জন চলছে। তবে কৌশলগত কারণে এ বিষয়ে দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। নিরপেক্ষ সরকার ও মুক্ত খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোন অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এমনটি বরাবরই বলে আসছিলেন দলটির সিনিয়র নেতারা। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে নানা শর্ত দিয়ে আসছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যান। অবশ্য তার ২ দিন আগে দলের নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি ছ’টি শর্ত দিয়ে তা মানা না হলে নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিত দেন। পরে বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে যেতে পাঁচটি শর্তের কথা জানান। অবশ্য এক পর্যায়ে নির্বাচনের তফসিলের আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশ থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭ দফা দাবি পেশ করেন। ৭ দফা দাবি পেশের পর বিএনপি সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনে তোড়জোড় শুরু করে। এক পর্যায়ে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু এ জন্য বিএনপিকে প্রকাশ্যে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের দাবি জানান অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করায় যুক্তফ্রন্ট বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন থেকে দূরে সরে গিয়ে আলাদা নির্বাচনী জোট গঠন করে। পরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে মিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। পরে অবশ্য কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও এ জোটে যোগ দেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে অংশ নেন বিএনপিসহ জোটের সিনিয়র নেতরা। সংলাপেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ৭ দফা দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া বিএনপি নেতাদের নামে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক মামলা দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে তা বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক মামলার তালিকা দিতে বললে দ্বিতীয় দফা সংলাপকালে বিএনপি সহস্রাধিক মামলার একটি তালিকা দেয় এবং পরে আরও সহস্রাধিক মামলার আরেক তালিকা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে জমা দেয়। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের নামে মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগ আনতে থাকে। এ ছাড়া নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা হয়নি বলেও তারা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অভিযোগ করেন। পাশাপাশি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে এ ধরনের অভিযোগ করতে থাকেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপি আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নড়েচড়ে বসে। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর পর একের পর এক বিভিন্ন মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের অনেক নেতাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তারপরও তারা নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র দাখিল করে। তবে খালেদা জিয়াসহ এত নেতা নির্বাচনে অযোগ্য হলে দল নির্বাচনে যাবে কি না এ বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলতে থাকে। সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইকালে খালেদা জিয়াসহ দলের ১৪১ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় নির্বাচন বর্জনের বিষয়টি আলোচনায় আরও প্রাধান্য পায়। ২ ডিসেম্বর রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ অভিযোগ করেন ২০ দলীয় জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি জোটের অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনে টিকে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। তার এ বক্তব্য থেকে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। আর নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলের মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রতিদিনই অভিযোগ করছেন বিএনপিকে ছাড়া একতরফা নির্বাচন করতেই খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে অভিযোগের শেষ নেই বিএনপির। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে অভিযোগের পর অভিযোগ। নির্বাচন কমিশনে গিয়ে করছে অভিযোগ, সংবাদ সম্মেলনে করছে অভিযোগ এমনকি বিবৃতি দিয়েও অভিযোগ করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করায় সব দিক থেকে অধিক সুবিধা পাচ্ছে। আর বিএনপি বিরোধী দলে থাকায় এবং দলের অনেক নেতাকর্মীর নামে মামলা থাকায় বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ৭ দফা দাবি দিয়েছিল তার একটিও মানা হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয় এ নিয়ে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেই আশঙ্কা রয়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির দফায় দফায় অভিযোগ একটি রাজনৈতিক কৌশল। এ কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনের পরিবেশ নিজেদের অনুকূলে রাখতে চায় দলটি। তবে বিএনপি নেতারা মুখে বলার সময় যেভাবে অভিযোগের কথা বলেন বাস্তবে নির্বাচন কমিশনে সুনির্দিষ্ট করে এত অভিযোগের কথা তুলে ধরতে পারছেন না। এর ফলে বিএনপির অভিযোগের বিষয়টি এখন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। তবে অভিজ্ঞ মহলের মতে যেভাবে বিএনপি একের পর এক নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করছে, তাতে শেষ পর্যন্ত এ দলটি নির্বাচনে থাকে কি না এমন সন্দেহ জনমনে থাকতেই পারে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বিএনপির যে ১৪১ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসনে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তিনটি আসনেই তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে মামলায় ২ বছরের বেশি সাজা থাকার কারণে। বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির অন্য ২ প্রার্থীর মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়েছে। এরকমভাবে সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ছ’টি আসনে বিএনপির এখন কোন প্রার্থীই নেই। মামলায় সাজা, ঋণখেলাপী ও বিল খেলাপীসহ বিভিন্ন কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া বিএনপির ১৪১ নেতার মধ্যে খালেদা জিয়া ছাড়াও বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা-১ বগুড়া-৭, মানিকগঞ্জ-২, জামালপুর-৪, শরীয়তপুর-১ ও রংপুর-৫ এ ছ’টি আসনে বিএনপির কোন প্রার্থীরই মনোনয়নপত্র বৈধ হয়নি। ফলে এ ছ’টি সংসদীয় আসনে বিএনপির কোন প্রার্থী নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বহু আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে নানামুখী চেষ্টা তদবির চালিয়েছে বিএনপি। এ জন্য দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহলের কাছেও দৌড়ঝাঁপ চালিয়েছে। তারপরও শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেনি। এর পর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে শামিল হয়ে নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। এ জোটসহ ২০ দলীয় জোটের সকল শরিক দল এবার বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে এ জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তিনিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পক্ষে যান কি না এমন কথাবার্তাও বিভিন্ন মহলে রয়েছে। সূত্র জানায়, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে যায় সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে ২০১৩ ও ২০১৫ সালের মতো আবারও কঠোর আন্দোলনে যেতে পারে। এমন আন্দোলনের জন্য সর্বস্তরের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করতে যথাসময়ে হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানা গেছে। তবে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই এ ধরনের আন্দোলনে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদেরও আন্দোলনের বিষয়ে কঠোর আপত্তি রয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে ৭ দফা দাবি করেছিল তার মধ্যে রয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনকালে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করা, সবার জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্য ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অবাধ সুযোগ রাখা, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ না করা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মামলার নামে হয়রানি না করা। বিএনপি নেতাদের মতে এসব দাবির একটিও পূরণ করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে বিএনপি মনে করে কোনভাবে নির্বাচন কমিশন মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকলে আর সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল ভাল করবে। কিন্তু এখনও ভাল নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই শেষ পর্যন্ত বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে কি না এ নিয়ে এখনই দলের ভেতর আলোপ-আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যদি আবারও ৫ জানুয়ারির মতো একটি নির্বাচন করতে চায় তাহলে বিএনপি কিভাবে নির্বাচনে থাকবে। সে ক্ষেত্রে রাজপথে আন্দোলন করা ছাড়া বিএনপির সামনে আর কোন পথ থাকবে না।
×