ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অরিত্রীর আত্মহত্যা- তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন ॥ রহস্য উদ্ঘাটনে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ হাইকোর্টের

ভিকারুননিসা বিক্ষোভে উত্তাল, প্রভাতী শাখা প্রধান সাসপেন্ড

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ভিকারুননিসা বিক্ষোভে উত্তাল, প্রভাতী শাখা প্রধান সাসপেন্ড

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পিতাকে অপমান করার জেরে অভিমানে ভিকারুননিসা স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় দিনভর উত্তাল ছিল স্কুল প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকা। শিক্ষার্থীরা বেইলী রোডের স্কুলের প্রধান শাখার মূল ফটকের সামনের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা বুধবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রভাতী শাখার শাখা প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনা তদন্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উচ্চ আদালত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। কমিটিকে একমাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে বিক্ষোভের কারণে যেসব শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারেনি, তাদের পরীক্ষা পরে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। যেভাবে অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে ॥ গত ৩ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানী ঢাকার শান্তিনগরের নিজ বাসা থেকে অরিত্রী অধিকারীর (১৫) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অরিত্রী ইংলিশ ভার্সনের ছাত্রী ছিল। তার বাবা দিলীপ অধিকারী। দুই মেয়ে অরিত্রী ও ঐন্দ্রিলা। এদের মা বিউটি অধিকারী। পরিবারটি শান্তিনগরের একটি বহুতল বাড়ির সপ্তম তলায় বসবাস করে। অরিত্রীর পিতা কাস্টমসের সিএন্ডএফ ব্যবসা করেন। ছোট মেয়ে ঐন্দ্রিলা একই স্কুলের শিক্ষার্থী। অরিত্রীর বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। গত ২ ডিসেম্বর তার ইতিহাস পরীক্ষা ছিল। স্কুলে মোবাইল নেয়া নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সে মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়েছিল। পরে মোবাইলটি জব্দ করেন শিক্ষকরা। তাকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়া হয়। গত ৩ ডিসেম্বর সকালে পরীক্ষা দেয়ার জন্য স্কুলে যায় অরিত্রী। কিন্তু তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি শিক্ষকরা। স্কুল কর্তৃপক্ষ তার বাবা ও মাকে ডেকে পাঠায়। অরিত্রীর বাবা ও মা স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপালের কক্ষে যান। ভাইস প্রিন্সিপাল অভিযোগ করেন, অরিত্রী মোবাইলে নকল করছিল। এ ঘটনায় অরিত্রীর বাবা-মা ক্ষমা চান। এরপর তাদের প্রিন্সিপালের রুমে পাঠানো হয়। তারা প্রিন্সিপালের কাছেও ক্ষমা চান। কিন্তু প্রিন্সিপাল সদয় হননি। একপর্যায়ে তারা পায়ে ধরে ক্ষমা চান। প্রিন্সিপাল তাদের বেরিয়ে যেতে হুকুম দেন। সেইসঙ্গে অরিত্রীকে টিসি (ছাড়পত্র) দেয়ারও মৌখিক নির্দেশ দেন। স্কুল থেকে বেরিয়ে অরিত্রীর বাবা মেয়ে ও স্ত্রীকে বাসায় নামিয়ে দেন। পরে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে তিনি তদ্বির শুরু করেন। এরই মধ্যে বাসা থেকে তাকে জানায়, অরিত্রী রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। পরে দরজা ভেঙ্গে অরিত্রীকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। নেয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষণে সব শেষ। ছাত্রীদের বিক্ষোভ ॥ এমন ঘটনার জেরে মঙ্গলবার সকাল থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সকাল আটটায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষা দিতে আসে। তারা পরীক্ষার হলে না গিয়ে গেটের সামনে অবস্থান নেয়। তারা অরিত্রী মানসিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ তোলে। এরপরই শুরু হয় বিক্ষোভ। শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে অভিভাবক ও শিক্ষক এবং গবর্নিং বডির সদস্যরা সেখানে হাজির হন। তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেয়ায়। পরীক্ষা শেষে তারা আবার আন্দোলনে নামে। এক শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত ॥ এমন ঘটনার জেরে স্কুলটির প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এমন ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের জানায়। আন্দোলনে অধিকাংশ অভিভাবকের সায় ॥ শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পরেও আন্দোলন থামেনি। আন্দোলনকারীরা সাময়িক বরখাস্ত মানতে নারাজ। তারা ওই শিক্ষকের স্থায়ী বহিষ্কার দাবি করেন। সেই সঙ্গে প্রিন্সিপালের অপসারণ দাবি করেন। এছাড়া অরিত্রী মৃত্যুর ঘটনাটি হত্যা দাবি করে তারা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক দাবি করে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে। বুধবার সকাল দশটায় আবারও আন্দোলনে নামবে বলেও শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলন যৌক্তিক বলে দাবি করেছেন অনেক অভিভাবক। কথা প্রসঙ্গে তারা বলছিলেন, এখন আর আগের মতো স্কুলটিতে পড়াশোনা হয় না। স্কুলটি পড়াশোনা এখন অনেকটাই কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পুরোপুরি কোর্স শেষ করে না। অভিভাবকদের খুবই নোংরা ভাষায় অপমান অপদস্ত করে। যা খুবই অপমানজনক। পিতার অপমান সইতে না পেরে একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার দায় পিতার নয়, তার শিক্ষকদের। শিক্ষকরা কেমন শিক্ষা দিল যে, শিক্ষার্থীরা নকল করে? শিক্ষার্থীদের এমন শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা নকল না করে। এ দায় শুধু অভিভাবকের নয়। এ জন্য শিক্ষকরাই বেশি দায়ী। আন্দোলনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারেনি। স্কুলের তরফ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন ॥ এমন ঘটনার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল নাজনীন ফেরদাউস সাংবাদিকদের বলেন, তারা ঘটনাটি তদন্ত করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটিকে তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে অভিযুক্ত জিন্নাত আরাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভিকারুননিসা স্কুলের অনেক শাখা, পরীক্ষা স্থগিত করলে, তার শিডিউল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়নি। তবে যারা পরীক্ষা দেয়নি, তাদের পরীক্ষা পরে নেয়া হবে। বিক্ষোভকারীদের সান্ত¡না দিলেন শিক্ষামন্ত্রী ॥ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় বিক্ষোভ চলাকালে সকালেই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিকারুননিসা স্কুল ক্যাম্পাসে যান। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পড়েন। তারপরেও তিনি তাদের সান্ত¡না দেন। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী এমনি এমনি মারা যায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন ॥ বিষয়টি তদন্ত করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফ রয়েছেন তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন, উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) শাখায়েত হোসেন এবং ঢাকা জেলার শিক্ষা অফিসার বেনজীর আহমদ। আগামী ৩ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেন। আর অভিভাবকদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব, সহকারী সচিব, মাউশির মহাপরিচালক কথা বলেন। হাইকোর্টের নির্দেশ ॥ অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা মঙ্গলবার হাইকোর্টের নজরে আসে। এরপর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটিতে আরও থাকবেন একজন মনোবিদ, একজন আইনজ্ঞ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি ও একজন শিক্ষাবিদ। এ ছাড়াও আত্মহত্যার ঘটনা রোধে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য ৫ সদস্যের একটি জাতীয় কাউন্সিলিং কমিটি গঠন এবং একটি নীতিমালা নির্ধারণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অনিক আর হক, আনুনন নাহার সিদ্দিকা। অনিক আর হক বলেন, এ ধরনের ঘটনা দেশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। তাই শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালে তাদের কাউন্সিলিং এবং শিক্ষকদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন করে কাউন্সিলর নিয়োগের পদ তৈরি এবং নিয়োগের বিষয়গুলো তুলে ধরে একটি নীতিমালা তৈরি করার প্রয়োজন। অধ্যক্ষসহ ৩ শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা ॥ বিডিনিউজ জানায়, আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন অরিত্রী অধিকারীর বাবা। মেয়েটির বাবা দিলীপ অধিকারী মঙ্গলবার রাতে মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন বলে ডিএমপির মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার মিশু বিশ্বাস জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।’ অরিত্রীর পিসতুতো ভাই ব্যারিস্টার সৌমিত্র সরকার জানান, মামলায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক জিন্নাত আরা এবং শ্রেণী শিক্ষক হাসনা হেনাকে আসামি করা হয়েছে।
×