ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাশোগি হত্যার শিকড় সৌদি রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বে

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

খাশোগি হত্যার শিকড় সৌদি রাজ পরিবারের দ্বন্দ্বে

(শেষাংশ) আবদুল্লাহ ক্লান গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈদেশিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। বিশেষ করে এশিয়ায়। ২০১৬ সালে সেগুলোও এমবিএসের এজেন্ডায় উত্তরোত্তর জড়িয়ে যায়। ফলে এ নিয়েও রাজ পরিবারের দ্বন্দ্ব বাড়ে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সাংহাইয়ে এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ফোরামে প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহর যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেখানে সিল্ক রোড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন নামক এক উন্নয়ন তহবিলে তিনি ১ কোটি ডলার বিনিয়োগে রাজিও হয়েছিলেন। তার ওই সফরের ক্ষেত্র প্রস্তুতে ওবায়েদ আগস্টের প্রথমদিকে বেজিং যান। সেখানে তিনি চীনের বিনিয়োগ গ্রুপের কাছে মোহম্মদ বিন সালমানের বিরাষ্ট্রীয়করণ গ্রুপের সমালোচনা করে আবদুল্লাহ ও আগের বাদশাহরা যে ঐতিহ্যগত সৌদি ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রেখেছিল, তার প্রতি চীনাদের সমর্থন কামনা করেন। আব্দুল্লাহ ক্লানের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা ওবায়েদের এই সমালোচনার কথা রিয়াদে পৌঁছে গিয়ে থাকবে। সপ্তাহখানেক পর তিনি সৌদি নম্বর থেকে একের পর এক রহস্যময় কল পেতে থাকেন। সেগুলোর উত্তর তিনি দেননি। শেষে সৌদি গোয়েন্দা প্রধান তাকে টেলিফোনে দেশে ফিরে আসতে বলেন। ওবায়েদ তখন প্রিন্স তুর্কির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তুর্কি তাকে চীনে থেকে যেতে বলেন। কারণ সেপ্টেম্বরে তিনি সে দেশে যাচ্ছেন। এদিকে ২১ আগস্ট সিল্ক রোড ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের প্রধান শান লী ওবায়েদকে বেজিংয়ে তাদের প্রধান কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান। ২৫ আগস্ট তিনি সাংহাই থেকে প্রাইভেট জেটে বেজিং যান। বিমানটি সেখানে নামার পর ওটাকে বিমানবন্দরের সুদূর এক প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। কাছাকাছি আরেকটি প্লেন দাঁড়ানো ছিল, যেটার লেজের মার্কিং দেখে বোঝা যায় ওটা সৌদি বিমান। এরপর যেসব ঘটনা ঘটে সংক্ষেপে তা এই : ওবায়েদ প্লেন থেকে নেমে এলে ৪০ জনেরও বেশি সাদা পোশাকের চৈনিক নিজেদের চীনা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাকে ঘিরে ধরে মাথা ও শরীর একটা ব্যাগে শক্ত করে ঢেকে এক জাযগায় নিয়ে যায়। সেখানে চেয়ারের সঙ্গে হাতকড়া বাধা অবস্থায় চলে জিজ্ঞাসাবাদ, যার মূল কথাগুলো ছিল এই যে, ওবায়েদ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অর্থের যোগানদাতা। আগামী মাসে চীনের হ্যাংচাউয়ে জি-২০ এর যে শীর্ষ বৈঠক হতে যাচ্ছে, সেটা বানচাল করতে পাকিস্তানী জঙ্গীদের ষড়যন্ত্রের আয়োজক হিসেবে কাজ করছে সে। সেই পাকিস্তানী জঙ্গীদের কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। দীর্ঘক্ষণ ও বেদনাদায়ক জেরায় ওবায়েদ বার বার বলে, সে এসব কিছুই জানে না। তারা ভুল লোককে ধরেছে। সৌভাগ্যক্রমে জেরাকারীরা ওবায়েদের আইপ্যাড ও সেলফোন পরীক্ষা করে দেখে এবং নিজস্ব সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী যাচাই করে। তারা বুঝতে পারে যে, বাস্তবিকই ভুল হয়েছে। সৌদি কর্মকর্তারা ওবায়েদ সম্পর্কে তাদের ভুল তথ্য দিয়েছে, যাতে তাকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে গ্রেফতার করে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। চীনের এক শীর্ষ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা পরে গোটা ব্যাপারটা ওবায়েদের কাছে ব্যাখ্যা করে বলেন : ‘আপনি আপনার দেশের দুই শক্তিধর শাহজাদার মধ্যকার ক্ষমতার লড়াইয়ে ফেঁসে গেছেন।’ তাদের ভুল তথ্য দিয়ে প্রতারিত করা হয়েছে, এই কারণে রুষ্ট হয়ে চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দ্রুত ওবায়েদের সাংহাইয়ে ফিরে যাওয়ার এবং চীনে বাকি দিনগুলো অবস্থানকালে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। ওদিকে সৌদি যেসব কর্মকর্তা আশা করেছিল যে, বেজিং থেকে তারা ওবায়েদকে ছিনিয়ে আনতে পারবে, তারা তাকে হাতের মুঠো থেকে ফসকে যেতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সাংহাইয়ে থাকতে থাকতে ওবায়েদ সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের উপপ্রধান জেনারেল ইউসুফ বিন আলী আল-ইদ্রিসীর কাছ থেকে টেলিফোন কল পান। বলা হয়, তাকে নেয়ার জন্য একটি সৌদি বিমান পাঠানো হয়েছে। তিনি যেন ওই বিমানে চীন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ওবায়েদ আবার প্রিন্স তুর্কির দ্বারস্থ হন। তুর্কি জেনারেল ইদ্রিসীকে জিজ্ঞেস করেন, কার পক্ষ থেকে তিনি ওবায়েদকে এই নির্দেশ দিয়েছেন? ইদ্রিসী দ্ব্যর্থবোধক জবাব দেন। ফলে ওবায়েদ বিশেষ নিরাপত্তায় সাংহাইয়ে থেকে যান। তার সুইস পাসপোর্ট থাকায় এক পর্যায়ে তিনি নিরাপদে জেনেভায় পাড়ি জমান। শোনা যায়, ওবায়েদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ইদ্রিসীর বিব্রতকর রকমের ব্যর্থতার খবর জেনে মোহম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। পরে ইদ্রিসীকে সরিয়ে দিয়ে গোয়েন্দা উপপ্রধান হিসেবে বসানো হয় জেনারেল আহমদ আল-আসিরিকে। এই আসিরি ইস্তানবুুলে খাশোগি হত্যার পরিকল্পনার সাহায্য করেছিল বলে সন্দেহ করে সৌদিরা পরবর্তীতে তাকে চাকরিচ্যুত করে। যাই হোক, ওবায়েদের ঘটনা থেকে যুবরাজ মোহম্মদ ও তার পারিষদরা স্বভাবতই কোন শিক্ষা নেয়নি। অনুমিত শত্রুদের প্রতি সন্দেহ ও সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করার আকাক্সক্ষা আরও গভীরতর হয়েছিল মাত্র। ২০১৭ সালের বসন্ত থেকে তারা বিরুদ্ধবাদীদের আহরণ ও তাদের গোপন স্থানে আটকে রাখার এক গোপন কার্যক্রম চালু করে। সেই কার্যক্রমে যুক্ত ছিল ‘টাইগার টিম’ নামে একটি বিশেষ দল, যার প্রধান ছিলেন কাহতানি। টাইগার টিম রাজ দরবারের সেন্টার ফর স্টাডিজ এ্যান্ড মিডিয়া এ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করত। মোহম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের উদ্যোগ জোরদার রূপ নেয় গত বছরের মাঝামাঝির দিকে। এ সময় যুবরাজ নায়েফ নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা করতে থাকেন। জুন মাসে তাকে অবমাননাকরভাবে সরিয়ে যুবরাজ করা হয় মোহম্মদ বিন সালমানকে। ট্রাম্প জামাতা কুশনারের রিয়াদ সফরের এক সপ্তাহ পর নয়া যুবরাজ মোহম্মদ ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু করেন শত্রুদের বিরুদ্ধে, যার শুরু হয় তুর্কি বিন আবদুল্লাহকে দিয়ে। রাজ পরিবারের এই ক্ষমতারদ্বন্দ্ব থেকে জন্ম হয়েছিল এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মনোভাব। সেখানে কোন ধরনের অনধিকার চর্চা বা সমালোচনা বরদাশত করা হয় না এবং যার পরিণতিতে খাশোগিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে ওবায়েদের ঘটনার সঙ্গে খাশোগি হত্যাকা-ের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে, যদিও ওবায়েদ জেনেভায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে পেরেছেন। নইলে তাকেও খাশোগির মতো একই ভাগ্য বরণ করতে হতো। দুটো ক্ষেত্রেই সৌদি শাসকগোষ্ঠী তাদের সমালোচকদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। প্রথম দিকের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা বেআইনী গোপন অভিযান চালায়। প্রতিটি অভিযানই গোয়েন্দা বাহিনীর উপ প্রধানের নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিল এবং রাজ দরবারের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গোয়েন্দা উপপ্রধান বলির পাঁঠা হিসেবে পরিগণিত হয়। দুটো ঘটনার কোনটিতেই যুবরাজ মোহম্মদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করার মতো অকাট্য কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যদিও এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। ওবায়েদ ও খাশোগি উভয়ের ক্ষেত্রে অভিযানের আয়োজন করেছিল রাজ দরবারের ভেতরকার একটি বিশেষ সেল। সেখানে কাহতানি ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক, সৌদি গোয়েন্দা সার্ভিসগুলো নয়। খাশোগি হত্যাকা-ে ১৮ জন সৌদিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন মাহের মুতরেব। সাবেক এই গোয়েন্দা অফিসার এক সময় যুবরাজ মোহম্মদের দেহরক্ষী ছিলেন। খাশোগিকে যে দলটি হত্যা করেছিল তিনি সেই দলের প্রধান ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। কাহতানি ও আসিরিকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মার্কিন এক তদন্তে বলা হয়, কাহতানি ছিলেন খাশোগি হত্যা অভিযানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অংশ এবং মুতরেব সেই অভিযানের সমন্বয় ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। খাশোগি হত্যায় বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও ধিক্কার উঠেছে। সবাই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে যুবরাজ মোহম্মদের প্রতি। তবে তার সংশ্লিষ্টতার এখন পর্যন্ত অকাট্য কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, এই হত্যাকা-কে ঘিরে দুটো দিন যুবরাজ মোহম্মদের সঙ্গে কাহতানির বেশ কিছু বার্তা বিনিময় হয়েছে। সেই বার্তাগুলো প্রকাশ না পেলে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয়া হয়তো অসম্ভবই হবে। আর এভাবেই তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবেন। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত ডেভিড ইগনাটিযুসের ‘দি খাশোগি কিলিং হ্যাড রুটস ইন এ কাটথ্রোট সৌদি ফ্যামিলি ফিউড,’ ‘দি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স জাস্ট মেইড এ ভেরি রিস্কি পাওয়ার প্লে,’ ‘সৌদি রয়াল ফ্যামিলি সার্কেলস ইটস ওয়াগনস ইন দ্য খাশোগি ক্রাইসিস,’ ‘হোয়াই ওয়াজ এমবিএস সো এফ্রেইড অব জামাল খাশোগি’, ‘উই আর জামাল খাশোগিজ ডটার্স, উই প্রমিস’ হিজ লাইট উইল নেভার ফেড’ নিবন্ধাবলী অবলম্বনে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
×