ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

নিরাপদ সড়ক নিয়ে আরও কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

নিরাপদ সড়ক নিয়ে আরও কিছু কথা

ঢাকাসহ যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য গাড়ি মেরামত সার্ভিসিং সেন্টার। এই সমস্ত ওয়ার্কশপে গাড়ি মেরামতের জন্য অনেকেই যান, কিন্তু গাড়ি মেরামত করার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বা দক্ষতা তাদের আছে কিনা তা কেউই জানেন না। এই সকল ছোট ছোট ওয়ার্কশপ ৫০ টাকা ফিস জমা দিয়ে মিউনিসিপালিটি থেকে একটা ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা শুরু করে দেন। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাড়ির ত্রুটি ঠিকমতো সারাতে পারেন না। ত্রুটিই রয়েই যায়। এই ত্রুটিপূর্ণ গাড়িই সড়কে চলে। এই ওয়ার্কশপগুলোকে ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার পূর্বে একটি নীতিমালা অনুযায়ী সকল শর্ত যাচাই করা প্রয়োজন। সকল যাত্রীবাহী বাস হবে একই সাইজের একই পরিমাণ যাত্রীর বসার সিট সম্পন্ন গাড়ি ভবিষ্যতে সড়কে নামার জন্য নিয়ম করতে হবে। দেশের দূরপাল্লার সড়কে একই সাইজের এবং সমান সংখ্যক যাত্রী বহন বা ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বাস চলবে। ছোট আকারের বাস চলাচল বন্ধ করা দরকার। ট্রেনিংবিহীন কোন হেলপার বাসে নিয়োগ দেয়া যাবে না। এদের ট্রেডিং কারিকুলাম বিআরটিএকে তৈরি করে দিতে হবে এবং কোথায় কিভাবে কয়দিনের প্রশিক্ষণ হবে তার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে ড্রাইভার ট্রেনিং হবে, সেখানেই হেলপারদেরও ট্রেনিং হলে ভাল হয়। শুধু যানবাহন ড্রাইভার, পথিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নন। সড়কের অবস্থা কালভার্ট ব্রিজের রেলিং, রাস্তার চেয়ে ব্রিজের সাইজ অনেক ছোট, যথোপযুক্ত স্থানে দিক-নির্দেশনা না থাকায় ড্রাইভারগণ বুঝতে পারেন না কোথায় কত মাইল স্পিডে গাড়ি চালানো দরকার। তাই দিক-নির্দেশনামূলক সাইন লাগানো প্রয়োজন এবং নিয়মিত সাইনগুলো ঠিক আছে কিনা তা নজরদারি করা দরকার। পুরনো হওয়া ব্রিজের রেলিং মেরামত করা জরুরী। ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকায় বাস টার্মিনালের প্রয়োজন নেই। শহরের বাইরে যে কোন উপযুক্ত স্থানে বাস ডিপো তৈরি করে সেখানে সব বাসগুলো থাকবে। শুধু সময়মতো রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে। গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালীসহ ছোটখাটো রাস্তার পাশে যদি কোন বাস টার্মিনাল থাকে, সেগুলো শহরের বাইরে সরিয়ে দিলে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হবে না, কোনও অনাকাক্সিক্ষত মানুষের জটলা কমবে। শুধু গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী যেখানে বর্তমানে টার্মিনাল আছে, সেই জায়গাগুলো ঠিক সময়ে রাস্তার পাশে বাস থাকবে এবং সময় হলে চলে যাবে। তবে ছিনতাই, রাহাজানিও কমবে। রাস্তার ওপর জায়গায় জায়গায় প্যাসেঞ্জার শেড তৈরি করে দিতে হবে। বাস টিকেট বাস কোম্পানির অফিস থেকে ক্রয় করবে প্যাসেঞ্জাররা অথবা অনলাইন-এর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটা যাত্রী ছাউনি শেডে লেখা থাকবে কোন বাস কখন আসবে-যাবে। দু’দিক থেকে যাত্রীগণ বুঝতে পারেন কোন শেডে তাকে দাঁড়াতে হবে। ট্রাফিক রোল, রোড সেফ্টি ইত্যাদি বিষয় হাইস্কুলে এবং কলেজ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা কোর্সে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ট্রাফিক রুলস্ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা পাওয়ার জন্য শিক্ষা উপকরণ বা পুস্তিকা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রকাশ করে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তার কারণ জীবনের নিরাপত্তা আগে প্রয়োজন। বড় হয়ে যাতে সঠিক ড্রাইভিং শিখে সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাতে পারে। উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিজের নিরাপত্তা। তাই বিষয়টিকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এই ব্যাপারে দেশে কর্মরত জাতীয় পর্যায়ের এনজিওর মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা বা মটিভেট করার ব্যপক কর্মসূচী হাতে নেয়া যেতে পারে। তারা বিআরটিএর সঙ্গে যৌথভাবে ড্রাইভার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে চালাতে পারে। কারিতাস বাংলাদেশের এইরকম একটি প্রকল্প বা ট্রেনিং সেন্টার আছে যার নাম মট্স। সাড়ে এগারো পল্লবী অবস্থিত মিরপুরে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ড্রাইভার প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে ব্র্যাক, কারিতাস, আরডিআরএস এবং সরকারী বিভাগের মধ্যে বিআরটিএ, রোড এ্যান্ড হাইওয়ে মিলে যৌথভাবে যদি একটি ৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন, তা হলে বাংলাদেশে আর রোড ক্রাশ হবে না। উপজেলা হচ্ছে দেশের একমাত্র পরিষদ যেখান থেকে ৪৯২টি উপজেলা থেকে গ্রামের জনসাধারণের কাছে সরকারী সেবা পৌঁছে দেয়া হয়। এটা হচ্ছে দেশের উন্নয়নের ভিত্তি বা তৃণমূল পর্যায়। দুর্ঘটনায় যদি মানুষ মারা যায়, তাহলে উন্নয়নের সুফল কিভাবে মানুষের কাছে পৌঁছবে, তাই সকল উন্নয়নের আগে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মানুষের জীবনের যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে তো সকল জনসাধারণকে নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে। যে যে সংস্থাগুলো মিলে যেটা পরিকল্পনা করবে, তারা আলাদাভাবে তাদের দায়িত্ব চিহ্নিত করে দিতে হবে। যে বিষয়গুলো ঐ মিলিত উদ্যোগে থাকবে তা হলোÑ ১. ট্রাফিক আইন সম্পর্কে দেশের সকল মানুষকে ধারণা দেয়া, ২. ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালানো, ড্রাইভার রিক্রুট করা, ৩. প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে তাদেরকে সড়কে নামানো, ৪. বাংলাদেশ সরকার ড্রাইভার প্রশিক্ষণের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন, ৫. ট্রাফিক আইনসহ যাবতীয় শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে কারিকুলাম ডেভেলপ করবে এবং সঙ্গে পরীক্ষা করে তা চূড়ান্তরূপ দেয়া, ৬. দেশের সকল হাইওয়ে, জেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত সড়কসহ সকল সড়কে যতরকম সাইন তৈরি করবেন এবং যথাস্থানে স্থাপন করবেন, ৭. রোড এ্যান্ড হাইওয়ে রাস্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, চোর-ডাকাত যাতে সমস্যা সৃষ্টি না করতে পারে, ৮. দূরপাল্লার রাস্তায় টহল পুলিশ থাকবে, তাদের জন্য দূরপাল্লার রাস্তার মাঝখানে পুলিশ ছাউনি তৈরি করে দিতে হবে। বিআরটিসিকে আরও সম্প্রসারিত করা দরকার এবং মফস্বল পর্যন্ত ইহার সার্ভিস সম্প্রসারণ করতে হবে। বিআরটিসির সেবা খুবই সন্তোষজনক। তাই এই সেবা সম্প্রসারণ করতে এবং আরও লোকবল ও অবকাঠামো তৈরি করে আরও অধিক বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি না করে দেশের চট্টগ্রামে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের মতো বাস তৈরির ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করে এটাকে সাসটেনেইবল করা যাবে কি-না তা সম্ভাব্যতা স্টাডি করে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। অথবা বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে চট্টগ্রাম বা অন্য কোন জেলাতে এ রকম ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করা যায় কিনা তা সরকারের নীতি নির্ধারণী কর্তৃপক্ষকে ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে দেশের সকল উপজেলা চেয়ারম্যানকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দিতে হবে তারা তাদের এলাকার রাস্তাতে যাতে জনসাধারণ গরু-ছাগল বেঁধে গাড়ি চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি না করে- সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মফস্বলে যে কোন কর্মসূচীতে বেশিরভাগ জনসাধারণ সংযুক্ত করতে হলে উপজেলা পরিষদই হচ্ছে একমাত্র ক্ষমতা বা প্রভাবশালী সংস্থা, যাদের সঙ্গে দেশের গ্রাম পর্যায়ে জন সাধারণের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। যে কোন সময় যে কোন রাজনৈতিক দল মিছিল করতে পারবে না। মিছিল চললে যানজটে ঢাকা শহর সয়লাব হয়ে যায়। যদি মিছিল করতে হয়, আগে থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে এবং তার সঙ্গে কোনদিকে মিছিল যাবে, কোথায়, কখন শেষ হবে তার প্ল্যান আগে থেকে জমা দেয়া লাগবে। রাস্তার অবস্থা দেখে গাড়ির গতি সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে। রাস্তার দু’ধারে সাইনবোডে উল্লেখ করে ঝুলাতে হবে। স্কুলের সামনে একরকম গতি, বাজারের সামনে এক রকম গতি ও ব্রিজের সামনে এক রকম গতি নির্ধারণ করে দিতে হবে-যা সকল গাড়ির চালক মেনে চলবে। গতি সীমিত করা সকলে মানছেন কিনা তা সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে এবং পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। কোন অবস্থাতেই যানজট বা জনগণের চলাচলে বিঘœ ঘটানো যাবে না। বাসের মধ্যে যাত্রীদের সকলে সিট বেল্ট বাঁধার ব্যবস্থা করা দরকার। গাড়ি চলাকালীন কোন ড্রাইভারের কানে ফোন ধরা যাবে না। ফোন থাকতে পারে হেলপারের কাছে। হেলপার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে না। চলন্তগাড়ির দরজা অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। দরজা ড্রাইভারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। হেলপারের জন্য বাসের পেছনে একটি সিট আলাদা থাকবে। রাস্তার মাঝখানে যাত্রী ওঠানামা করা আইনত নিষিদ্ধ থাকবে। গাড়ির ড্রাইভারদের প্যান্ট-শার্ট পরে গাড়ি চালাতে হবে। ঢিলেঢালা কাপড় পরে গাড়ি চালালে যে কোনভাবে গিয়ারের সঙ্গে লেগে গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ড্রাইভারের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ড্রাইভারকে আশ্বস্ত করতে হবে, হাল্কা বা তুচ্ছ ঘটনার জন্য তার চাকরি যাবে না। প্রত্যেক ড্রাইভারকে মালিক কর্তৃক লিখিত নিয়োগপত্র দিতে হবে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অর্থাৎ দেশের যে সকল রাস্তার যতরকম কালভার্ট আছে, মেরামতযোগ্য ব্রিজ-কালভার্টগুলোকে পরীক্ষা করে অবস্থা বিশ্লেষণ করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে সেগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করা দরকার। রীতিমতো পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিংয়ের জন্য দায়িত্ব দিতে হবে একটি মনিটরিং কমিটিকে এবং তাদেরকে দায়ী থাকত হবে যদি কোন বিপদ ঘটে এই সকল পর্যায়ে। সারা দেশে রেলিংসহ অসংখ্য ব্রিজ আছে, যা ব্রিটিশ আমলের তৈরি মনে হয়, কোনও রেলিং অনেক পুরনো, কোন ব্রিজে রেলিং নেই, সকল ব্রিজগুলো পরিদর্শন করে এবং মূল্যায়ন করে সারাদেশে একই ডিজাইনের কালভার্ট, ব্রিজ তৈরি করা জরুরী। তবেই নিরাপদ সড়ক এবং সড়কে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। শুধু বক্তৃতা বিবৃতি আর ধর্মঘট করলে বাস্তবে কিছুই হবে না। আমরা যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেখে আসছি। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ধর্মঘট ডাকা হয় কিন্তু বাস্তবে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয় না সঠিকভাবে। শুধু সাময়িক চিকিৎসা করা হয়- এগুলো আর চলবে না। ডিজিটাল যুগে শুধু কথার ফুলঝুরি দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবে না। দেশের জনগণ এখন কাজ দেখতে চায়। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×