ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রদ্ধা ভালবাসায় শেষ বিদায় আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনকে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

শ্রদ্ধা ভালবাসায় শেষ বিদায় আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনকে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন যখন ফটোগ্রাফি শুরু করেন তখন অনেক বিখ্যাত আলোকচিত্রী ছিলেন। কিন্তু তার ক্যামেরায় বদলে গেল দেশের আলোকচিত্র ভুবন। প্রথমদিকে ল্যান্ডস্কেপের ছবি তুলতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ল্যান্ডস্কেপ থেকে ফিরলেন নগর জীবনে। নগরের সুখ-দুঃখসহ যাপিত জীবনের ছবি উঠে এলো তার ক্যামেরায়। হয়ে উঠলেন রাজধানীকেন্দ্রিক আলোকচিত্রের স্থপতি কিংবা রাজা। আর একাত্তরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করেও তিনি অসীম সাহসিকতায় ধারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ ছবি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুলেছিলেন সেসব আলোকচিত্র। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর হাতে রাইফেল ও মুখে কাশফুল চেপে রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ছবিটি তুলেছিলেন এককথায় তা অনন্য। মুক্তিযুদ্ধনির্ভর তার এমন অনেক অসাধারণ ছবি আছে যা আমাদের দেখা হয়নি। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফিতে যখন যুক্ত হয়েছেন সেখানেও সৃষ্টি করেছেন নতুন আঙ্গিক। অথচ এমন একজন গুণী মানুষ অবহেলিত হলেন। ৭০ বছরের জীবনে জোটেনি কোন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন পোর্ট্রেটের কবিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনোয়ার হোসেনের শ্রদ্ধাঞ্জলির অনুষ্ঠানে জনকণ্ঠের সঙ্গে এসব কথা বলেন নাসির আলী মামুন। সোমবার সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় বিদায় জানানো হলো বরেণ্য আলোকচিত্রী ও চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনকে। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘর থেকে সকাল সোয়া ১১টায় আনোয়ার হোসেনের শবদেহ নিয়ে আসা হয় শহীদ মিনারে। রাখা হয় মিনারের উল্টোপাশের গগন শিরীষ বৃক্ষছায়ায়। সেখানেই শিল্পীকে নিবেদন করা হয় ফুলেল ভালবাসা। আবার অনেকে শোকবইয়ে কালো হরফে জানিয়েছেন শিল্পীর প্রতি অনুরাগের কথা। সর্বসাধারণের সঙ্গে প্রখ্যাত আলোকচিত্রী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রকার, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক, চিত্রসমালোচক, অভিনয়শিল্পী, চিত্রশিল্পীসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ পুষ্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে জানিয়েছেন বিদায়ী ভালবাসা। সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত জানানো হয়েছে শ্রদ্ধা। এ সময় আনোয়ার হোসেনের পরিবারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ফ্রান্স থেকে আসা দুই ছেলে আকাশ ও মেঘদূত, ভাই আলী হোসেন, বোন খুশি ও মামাত ভাই ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। এক মিনিট নীরবতা পালনের মাধ্যমে শেষ হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। এরপর শিল্পীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর অনুষ্ঠিত জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এখানেই সমাহিত করা হয় আলোকচিত্রে বাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলা শিল্পী আনোয়ার হোসেনকে। কাল বুধবার বিকেলে জাতীয়ভাবে এই শিল্পীর স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবং শিল্পকলা একাডেমি। শ্রদ্ধা জানাতে আসা চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, যেসময় আনোয়ার হোসেন ছবি তোলা শুরু করেছিলেন সেসময় শিল্প হয়ে ওঠেনি আলোকচিত্র। তার সৃজনশীল ছবিগুলো আলোকচিত্রের শিল্পমান সম্পর্কে বদলে দেয় আমাদের ধারণা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তুলেছেন দুর্লভ ছবি। এছাড়া আলোকচিত্রের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের মাধ্যমে আনোয়ার হোসেন এদেশে এ শিল্পমাধ্যমটিকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। পাশাপাশি তিনি যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে সূর্যদীঘল বাড়ি চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হলেন সেখানেও দেখালেন দারুণ দক্ষতা। অনেকের মতোই শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন কালজয়ী চলচ্চিত্র সূর্যদীঘল বাড়ির নির্মাতা মসিহউদ্দীন শাকের। তিনি বলেন, আমি ও আনোয়ার হোসেন দুজনেই বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র ছিলাম। ছাত্রাবস্থাতেই দেখতাম ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত দেশের পথে-প্রান্তরে। ওই সময় ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে বৃত্তি দেয়ার ঘোষণা দিলে আমরা তাকে সেই বৃত্তি গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করি। পুনে থেকে সে যখন সিনেমাটোগ্রাফির ওপর পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে তখন আমরা সূর্যদীঘল বাড়ি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ওই ছবিতে তাকে চিত্রগ্রাহক হওয়ার অনুরোধ করলাম। কোনো টাকা-পয়সার হিসাব ছাড়াই সেও রাজি হয়ে গেল। শুটিং করার সময় দেখেছি সিনেমাটোগ্রাফির বিষয়ে কখনো আপস করত না। তার কম্পোজিশন সেন্স ছিল অসাধারণ। পাশাপাশি দৃশ্য ধারণে আলো-ছায়ার খেলাটা খুব বুঝতেন। নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মাধ্যমে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয়। আনোয়ার হোসেনের সাদা-কালো ছবি দেখে আমরা বিস্মিত হতাম। সাদা-কালো ছবিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথাকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রাহক হিসেবে গল্পকে অতিক্রম করে যেন কবিতা হয়ে উঠত তার ধারণকৃত দৃশ্যকল্প। সেই চিত্রময়তার কারণে ছবির গল্প পেত মহাকাব্যিক রূপ। দেশের মাটি, মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্পের কথা বললে আনোয়ার হোসেনের কথা বলতে হবে। আনোয়ার হোসেনকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, বর্ষীয়ান আলোকচিত্রী গোলাম মোস্তফা, শহীদুল আলম, চঞ্চল মাহমুদ, হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন, স্থপতি শাকুর মজিদ, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, চিত্র সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ম হামিদ, খ ম হারুন, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, অভিনয়শিল্পী শংকর সাঁওজাল, কণ্ঠশিল্পী সুমনা হক, আলিয়ঁস ফ্রঁসেসের পরিচালক অলিভার দিনতিঙ্গার, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকী, সাইদুল আনাম টুটুলসহ অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জানায় স্থপতি ইন্সটিটিউট, প্রাচ্যনাট, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফি সোসাইটি, দৃক ও পাঠশালা, মুভ্যিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, শর্ট ফিল্ম ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা ৭১, সেক্টর কমানন্ডার্স ফেরাম, বিডি ফটোগ্রাফার্স, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক এ্যাসোসিয়েশন, প্রথম আলো, চিত্রালী পাঠক-পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ, কাউন্টার ফটো স্টুডেন্ট ফোরাম, চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি, রণেশ দাসগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদ, বাংলা একাডেমী, আর্কিটেকচার এলামনাই এ্যাসোসিয়েশন অব বুয়েট, শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালযের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগ ও বেগ আর্ট ইন্সটিটিউট। গত ১ ডিসেম্বর সকালে রাজধানীর পান্থপথের একটি হোটেল থেকে আনোয়ার হোসেনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
×