ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাওলাদার বাদ রাঙ্গা জাপার মহাসচিব

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

হাওলাদার বাদ রাঙ্গা জাপার মহাসচিব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়েই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। সংবাদ সম্মেলনে সদ্য বিদায়ী মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তের কথা বলেছেন তিনি। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে কেউ যদি বাণিজ্য করে থাকেন তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ^াস দেন রাঙ্গা। এর আগে সোমবার সকালে জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হাওলাদারকে সরিয়ে রাঙ্গাকে নতুন মহাসচিব করে চিঠি দেন। বিকেলে ঢাকার বনানীতে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে করেন নতুন মহাসচিব। এরশাদ উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘দুই-এক দিনের’ মধ্যে বিদেশে যাবেন বলেও জানিয়ে তিনি বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ ‘অসুস্থ হয়ে’ হাসপাতালে ভর্তি থাকার মধ্যে তার ও মহাসচিব হাওলাদারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী। এরপর পটুয়াখালী-১ আসনে হাওলাদারের মনোনয়নপত্র বাতিলের পর সোমবার আকস্মিকভাবেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব পরিবর্তনের ঘোষণা আসে। এরশাদ দলীয় চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবলে হাওলাদারকে সরিয়ে সভাপতিম-লীর সদস্য রাঙ্গাকে মহাসচিব করেছেন বলে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় জানান। নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন এরশাদ। ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর পরই র‌্যাব তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেন সাবেক এই সামরিক শাসক। এরপর প্রধানন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান এরশাদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মহাজোট গঠনকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ ছিলেন তিনি। আলোচনা আছে দলের সংকটকালে কেন নিখোঁজ হন এরশাদ। তাছাড়া এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকটাই পর্দার অন্তরালে এরশাদের অবস্থান। এ নিয়ে আছে নানা জল্পনা কল্পনা। জাপা সূত্রগুলো বলছে, এবার দলীয় রাজনীতির শিকার হয়েছেন হাওলাদার। জাপার সুযোগ সন্ধানী নেতারা তাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন। এরশাদকে বাধ্য করেছেন তাকে দলের মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে দিতে। জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য এরশাদ, রওশন এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের পক্ষ থেকে তিনটি তালিকা হয়। যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের মধ্যে হাওলাদারের তালিকার বেশ কয়েকজন রয়েছে। এরমধ্যে এরশাদ ও হাওলাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন বেশ কয়েকজন নেতা। অনেকেই মনোনয়ন না পেয়ে দল থেকে পদত্যাগও করেছেন। এই সুযোগে রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত সরকারে থাকা মন্ত্রী ও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য হাওলাদারকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগে। যার নেপথ্যে রওশন এরশাদের ইন্ধন রয়েছে বলেও জানা গেছে। সংসদ সদস্যদের তালিকায় হাওলাদারের নাম থাকলেও রওশনপন্থীরা তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে অনেক আগে থেকেই। মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে শেষ পর্যন্ত এরশাদকে বাধ্য করা হয় হাওলাদারকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। যদিও জাপার অনেক শীর্ষ নেতাই বিষয়টিকে ভালভাবে দেখছেন না। এ নিয়ে দলের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি দেখা দিয়েছে। রংপুরের এমপি রাঙ্গা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীর বর্তমান সরকারে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন; তিনি রংপুর জেলা ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি তিনি। পরিবহন মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতিতে সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন রাঙ্গা। মহাসচিবের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গা মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, এই অভিযোগের প্রসঙ্গে সত্যতা, অসত্যতা রয়েছে। নানা বক্তব্য আছে। আমরা জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যরা গত রাতে আলোচনা করেছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জানান, জাতীয় পার্টির সভাপতিম-লীর সদস্যদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমন্বয় করে মহাজোট গঠনের মধ্য দিয়ে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। দলের মনোনয়নপত্র বিতরণের শেষে বেশ কজন নেতা অভিযোগ করেন, মোটা অঙ্কের টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। এই বাণিজ্যের অভিযোগের তীর ছিল জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ ও মহাসচিবের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেউ অভিযোগের প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন হাওলাদার। তিনি বলছিলেন, অভিযোগকারীরা কোন একটি পক্ষ থেকে টাকা খেয়ে দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ করছে। এই প্রসঙ্গে রাঙ্গা বলেন, মনোনয়ন নিতে এসে যারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, যারা টাকা-পয়সা নেয়ার অভিযোগ এনেছেন, তারা যদি আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানান, তবে আমরা ব্যবস্থা নেব। আমরা একটা কমিটি করে দেব। তারপর প্রেসিডিয়াম সদস্যরা তদন্ত করব। দোষী হলে আমরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। হাওলাদারকে ঠিক কোন কারণে মহাসচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে কোন বক্তব্য জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে আসেনি। কিছু স্পষ্ট করে কিছু না বললেও রাঙ্গা বলেন, আপনারা জানেন, ঋণখেলাপী হওয়ার কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। তার মনোনয়ন গৃহীত হয়নি। তবে মাননীয় চেয়ারম্যান তাকে কেন অব্যাহতি দিয়েছেন, তা তিনি বলবেন। হয়তো বা তিনি (হাওলাদার) পদ থেকে অব্যাহতি চাইতে নিজেও বলেছেন.......। ২০০১ এর নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একাংশ দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সন্তানতুল্য ও বিশ্বস্ত হাওলাদারকে মহাসচিব করেছিলেন এরশাদ। দলের মধ্যে টানাপড়েনে ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল তাকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলুকে মহাসচিব করেছিলেন এরশাদ। তবে তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ফের তাকে মহাসচিব পদে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকে জাপা চেয়ারম্যানের সঙ্গে মহাসচিবের মধুর সম্পর্কই প্রচলিত ছিল। সংবাদ সম্মেলনে মনোনয়ন বাণিজ্যের’ অভিযোগ তুলে জাতীয় পার্টির যারা পদত্যাগ করেছেন, তাদের দলে ফিরে আসার আহ্বান জানান নতুন মহাসচিব। রাঙ্গা বলেন, যেসব সাংসদ ও নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাদের বলব আপনারা ফিরে আসুন। চেয়ারম্যান স্যার আপনাদের সন্তানের মতো ভালবাসেন। পিতাই তো ধমক দেন... অভিমান না করে ফিরে আসুন আপনারা। রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টি থেকে তিনবার বহিষ্কৃত হলেও তিনি দল ছেড়ে চলে যাননি। পরে তিনি রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পান। টানা ১৫ বছর ধরে তিনি দলের সভাপতিম-লীর সদস্য। সংবাদ সম্মেলনে রাঙ্গা অভিযোগ করেন, জাতীয় পার্টি সংসদ নির্বাচনের আগে যখন সংগঠিত হয়ে উঠে, তখন দলের মধ্যে একটি ‘অশুভ শক্তি’ ঢুকে পড়ে। অশুভ শক্তি প্রতিহত করতেই দলে মহাসচিব পরিবর্তন বলেও জানান তিনি।
×