ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোজাম্মেল খান

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি

হ্যাঁ, এমন দেশ পৃথিবীর কোথাও নেই। আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক প্রয়াত লি কুয়ান ইউকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মাত্র ৩০ বছরে এই যে একটা গরিব দেশকে ধনী দেশে উন্নীত করলেন তার প্রধান ংবপৎবঃটা কি? লি কুয়ান ইউয়ের উত্তর ছিল, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সমস্ত সিঙ্গাপুরবাসী জাপানীদের পক্ষে দালালি করেছে, তাদের রাজনীতিতো দূরের কথা, তাদের কোন সরকারী চাকরিতেও নিয়োগ দেয়া হয়নি। এ মূলনীতিই আমাদের সফলতার মূল প্রতিপাদ্য।’ ॥ এক ॥ তাকিয়ে দেখুন বাংলাদেশের দিকে। ইউরোপের কোন দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত হলোকাস্টের (গণহত্যার) দায়ে নুরেমবার্গ আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারও জন্য যদি কোন রাজনৈতিক দল তাদের জাতীয় কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে, তাহলে সে দেশের আদালতের বাইরে জনতার আদালতে কি ওই দলের কোন অস্তিত্ব থাকবে? হ্যাঁ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌ) নামের কুখ্যাত এবং সবচেয়ে ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীর আন্তর্জাতিক আদালতে প্রদত্ত ফাঁসি কার্যকরের পর পরই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সাকার ‘মৃত্যুতে’ আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ‘সাকা ন্যায়বিচার পায়নি।’ সেই একই ধারাবাহিকতায় সেদিনও বিএনপির এক জাতীয় অনুষ্ঠানে দলটি তার জন্য শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে। জামায়াতে ইসলামীর বাইরে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত যে দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- হয়েছে, তাদের সন্তানরা বিএনপির অতি প্রিয়। বগুড়ার রাজাকার আলীমের ছেলে ফয়সল আলীম ইতোমধ্যেই নমিনেশন পেয়েছে। হ্যাঁ, এই সেই ফয়সল আলীম, যে ১৯৯৪ সালে টরন্টোতে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত এক বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে আমি যখন বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ করেছিলাম, তখন সে মাইকের তার খুলে দেয় এই বলে, ‘শেখ মুজিবের কথা শোনার জন্য আমরা এখানে আসিনি।’ স্থানীয় এক বিএনপি নেতা আমাকে বলেছিলেন বিগত বিএনপি দুঃশাসনের সময় সে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়েছে। কুখ্যাত সাকা চৌধুরীর পরিবারের অন্তত একজন সামিম কাদের চৌধুরী ইতোমধ্যেই নমিনেশন পেয়েছে। আরও দু-একজন পেতে পারে, যেহেতু লন্ডনে পলাতক ওই দলের নেতার ভাষায় ওই এলাকা ‘বিএনপির দুর্গ।’ তার বাবা গিয়াস কাদের চৌধুরী জেলে আছে শেখ হাসিনাকে এই বলে হুমকি দেয়ার কারণে, ‘আপনাকে আপনার বাবার চেয়েও করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে।’ এই দুর্বৃত্তদের কথা শুনে ভাবি, আমরা কি ’৭১ সালে পরাজিত হয়েছিলাম? এসব যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারবর্গ এবং সন্তানরা তাদের পিতার রাজনীতির শুধু ধারকই নন, তারা হলো, ‘বাবু যত কহে পারিষদরা বলে তার শত গুণ।’ এর বাইরে নির্বাচনে বগুড়া-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছে যুদ্ধাপরাধ মামলার পলাতক আসামি আব্দুল মোমিম তালুকদার খোকা। মোমিনের বাবা মৃত আব্দুল মজিদ তালুকদার মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল এবং বাবা-ছেলে দু’জনেই সে সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করে বলে তাদের বিরুদ্ধে মামলায় অভিযোগ আনা হয়। যুদ্ধাপরাধে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। ॥ দুই ॥ ড. কামাল হোসেন সাত দফা দাবি নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি যে দিয়েছিলেন, সেটা শুরু হয়েছিল এভাবে- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা।’ চিঠির প্রথম বাক্যে যে তিনটি স্বত:সিদ্ধ জাতির পিতা, ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম তার কোন একটির সঙ্গে কি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া (যিনি ১৫ আগস্ট তার কল্পিত জন্মদিন পালন করেন) এবং সব নীতির নির্ধারক দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং লন্ডনে পলাতক ২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চরম বেয়াদব (যে বঙ্গবন্ধুকে বলে পাকবন্ধু) ছেলে কি আদৌ স্বীকার করে? নিজের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দেশবাসীকে ১৯৭১ সালের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘দেশবাসী ১৯৭১ সালের মতো ঐক্যবদ্ধ’ থাকলে তিনি আজকে যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য গড়েছেন, তাদের বাক্সে কয়টা ভোট পড়বে সেটা অনুধাবনের জন্য কি অক্সফোর্ড থেকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রয়োজন আছে? ড. কামালের সংবাদ সম্মেলনের সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে একজন সংবাদপত্র পাঠকের মন্তব্য : ‘কামাল হোসেন সব সময় নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কাণ্ডারি বলেন। কিন্তু যে দলের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার জন্য দায়ী এবং যে দল ১৫ আগস্ট ঘটনার বেনিফিশিয়ারি, তারেক রহমান কিছুদিন আগেও বঙ্গবন্ধুকে পাকবন্ধু বলে কটাক্ষ করেছে, খালেদা জিয়া শোক দিবসে মিথ্যা জন্মদিনের নামে উপহাস করে, সে দলের সঙ্গে গিয়ে কামাল সাহেবের নিজেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষ বলাÑএটা একটা চরম প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।’ ড. কামাল হোসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পরিবর্তে বিশ্বাসযোগ্য কাউকে চান। যাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয় তাদের বলছি, বিএনপি আমলে নিয়োজিত ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রধান নির্বাচন কমিশনারদ্বয়ের একজনকে, এমএ আজিজ বা সাদেক সাহেবকে ফিরিয়ে আনলে কেমন হয়? ॥ তিন ॥ ’৭১ সালে স্বেচ্ছায় বা ঘটনাক্রমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেই মুক্তিযুদ্ধা হওয়া যায়? মুক্তিযুদ্ধ একটা আদর্শ, একটা চলমান প্রক্রিয়া, যার জন্য যুদ্ধ এখনও চলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কার্যকলাপের দিকে নজর দিলেই সেটা পরিষ্কার হবে। কামাল হোসেনের জামাতা ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড বার্গম্যানের সাজায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘অবমাননাকর’ বিবৃতি দেয়ায় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাজা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক আদালত। শাস্তি হিসেবে তাকে এক ঘণ্টা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এই জাফরুল্লাহ। ইনি সেই জাফরুল্লাহ যিনি বলেছিলেন ‘এ কাদের মোল্লা সে কাদের মোল্লা নয়।’ হ্যাঁ, এই সেই জাফরুল্লাহ যিনি কামারুজ্জামানকে ২০ মিনিট ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখাতে মনে আঘাত পেয়েছিলেন এবং সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার। ইনি সেই জাফরুল্লাহ সাকা চৌ-এর ফাঁসির আদেশ হলে বলেছিলেন, ‘সাকা ন্যায়বিচার পায়নি।’ যদিও ’৭১-এ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু আজকে মুক্তিযুদ্ধ হলে তিনি কোন দিকে অংশগ্রহণ করতেন, এ থেকে সেটা কি পরিষ্কার নয়? নিজেকে বঙ্গবন্ধুর ৪র্থ ছেলের দাবিদার বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আজকের দিন আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন। আমি আনন্দের সঙ্গে আজ আমার দলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান করছি।’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যে কোন বাঙালীর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আর একজন ‘বঙ্গবীরের’ শ্রেষ্ঠ দিন হয়ে গেল যেদিন রাজনীতির পচা নর্দমায় তিনি ঝাঁপ দিলেন সেদিন। তার মতে আওয়ামী লীগ ১৯টির বেশি আসন পাবে না। এমনকি শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ার আসনে ড. কামাল দাঁড়ালে তার কাছে হেরে যাবেন।’ এর কয়েকদিন আগেই ‘বঙ্গবন্ধুর ৪র্থ ছেলে’ ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের’ মিলনমেলায় প্রতিরোধ সংগ্রামীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করে বলেন, ‘বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বাধীন সরকার। এই সরকারকে বলতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করা ন্যায় না অন্যায়। তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে।’ ॥ চার ॥ জীবনে এমপি বা মন্ত্রী হওয়া কি খুবই প্রয়োজন? ‘ধানের শীষ প্রতীকে লড়তে যাচ্ছেন কিবরিয়া পুত্র রেজা’- খবরটা দেখে ওপরের প্রশ্নটা মনে এলো। ভাবছি তার কিংবদন্তি পিতার লাশ কি কবরে নড়ে উঠবে না ছেলেকে রাজনীতির নর্দমায় ঝাঁপ দিতে দেখে? প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যেরবাজারে এক জনসভা শেষে ফেরার সময় গ্রেনেড হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়া। অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার হত্যার বিচারের দাবিতে ‘শান্তির জন্যে নীলিমা’ নামের এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ কর্মসূচীর সূচনা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী আসমা কিবরিয়া। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা টরন্টোর কয়েকশো বাঙালী ২৫ ডিগ্রী হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রাকে অগ্রাহ্য করে মানববন্ধন করেছিলাম। করেছিলাম একাধিক প্রতিবাদ সভা আর আন্তর্জাতিক সেমিনার। নিজের পকেট থেকে ব্যয় করেছিলাম শত শত ডলার। এমপি হওয়ার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রেজা বলেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল হবিগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করার। আমি সেই স্বপ্ন এবার বাস্তবায়ন করতে চাই। কারণ, এলাকাটি অবহেলিত একটি জনপদ। এলাকার মানুষের জীবনমানে গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই।’ ড. রেজা কিবরিয়া : আপনি বিশ্ব সংস্থায় কর্মরত একজন অর্থনীতিবিদ, পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। আপনার ক্ষণজন্মা পিতা হবিগঞ্জ-১ আসনের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিতে এসেছিলেন না। বাংলাদেশ এবং সে দেশ সৃষ্টির মহানায়ক এবং মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করতেন বলেই তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন। আপনি রাজনীতির যে পঙ্কিলে নিজেকে নিমজ্জিত করতে যাচ্ছেন, তার সঙ্গে আপনার মহান পিতাকে সংশ্লিষ্ট করবেন না। তদুপরি সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মহান মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণকারী বঙ্গসন্তান আপনার মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে যে ‘শান্তির জন্য নীলিমা প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অনুভূতিতে আপনি যেভাবে আঘাত করলেন সেটা আপনি এমপি বা মন্ত্রী হয়ে কি দূরীভূত করতে পারবেন? ॥ পাঁচ ॥ আমার নিজের অজ্ঞতা যে, আমি ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ শহিদুল আলমকে জানতাম না। যদিও আমি সম্ভবত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে বিদেশী সংস্থা, পত্রিকা এবং ব্যক্তিসমূহ যে সব অপপ্রচার করেছে সেগুলো খণ্ডন করে ইংরেজীতে সবচেয়ে বেশি নিবন্ধ লিখেছি। তবে একটি সঙ্গত সামাজিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার প্রয়াসে একটা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তিনি যে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন (আমি জীবনে এই তাকে প্রথম দেখলাম ছবিতে) সেটা বাংলাদেশের কোন তৃতীয় শ্রেণীর রাজনীতিবিদের (কপাল কুঁচকানো রিজভীর মতো) কাছ থেকে আমরা অহরহ শুনে থাকি, কিন্তু কোন ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। কিছুদিন আগে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিপরীতে যে রাজনৈতিক শক্তি, তার মুক্তিতে তাদের উল্লাস খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার মহানায়ককে যারা নিরন্তর হৃদয়ে ধারণ করেন বলে মনে করা হয়, তাদের অনেককে আমি তার পক্ষ নিতে দেখেছি। সে সমস্ত বন্ধুর কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আপনারা কেউ কি এমন একটা উদাহরণ দিতে পারেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তিনি কোনদিন একটা কথা বলেছিলেন, লিখেছেন বা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের সবচেয়ে সরব কণ্ঠ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর লজ্জাজনক ভূমিকার ব্যাপারে কোন সমালোচনা করেছেন কি না। গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তিনি কোথায় ছিলেন বা তার ভূমিকা কি ছিল? বন্দী অবস্থায় তাকে নিয়ে লেখা কয়েকটি নিবন্ধ পড়ে যেটা জানলাম তার সারমর্ম হলো, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার প্রয়াসে যা কিছু করা দরকার, তার সব কিছুই তিনি করেছেন। তার ভাষায় ‘শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমার কারণে সেটি কক্ষচ্যুত হয়’ এ ধরনের বহুবিধ মিথ্যা তথ্য এবং বিশ্লেষণ, বিশেষ করে বিদেশী কিছু পত্রিকায় লিখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœত এবং বিতর্কিত করার সব ধরনের চেষ্টা তিনি করেছেন। ইউরোপের কোন দেশে নুরেমবার্গ বিচারের বিরুদ্ধে কেউ লিখলে তার বিচার হতো। আর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবিদার অনেক ব্যক্তি এবং সংবাদ মাধ্যম তাকে এক বিরাট ‘বীর’ বানানোর প্রয়াসে যা করেছেন, সেটা দেখে আবারও বলছি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি’। ॥ ছয় ॥ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে বাঙালী একমাত্র জাতি যে যুদ্ধ করে গণহত্যার শিকার হয়ে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। অথচ সে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে দুটো রাজনৈতিক শক্তি, যার একটাকে অভিহিত করা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ বলে। তাহলে অন্যটা কোন পক্ষের? এই অন্য পক্ষের প্রধান শক্তি বাংলাদেশের মানুষের স্বল্প স্মৃতিশক্তি। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপির চরম দুঃশাসনের কথা (২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞসহ) অনেক মানুষ ভুলে গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয় ঘোষণার পর পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান লতিফুর রহমান যখন গণভবনে বিজয় উল্লাসের নৈশভোজে লিপ্ত, তখন থেকেই বিএনপি সমর্থকরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর যে অত্যাচার আর হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়, তার সঙ্গে শুধু ’৭১-এ দখলদার বাহিনীর শাসনের তুলনা চলে। ’৯৩ হাজার ‘পাকিস্তানী’ সৈনিকের আত্মসমর্পণের স্মৃতি মুছে দেয়ার মানসে যিনি রেসকোর্সে শিশুপার্ক নির্মাণ করেন (প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্মৃতিকথায় বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং পরবরতীতে হাইকোর্টের রুলিং-এ সেটা বলা হয়েছে) তিনি সত্যিই কোন পক্ষের ছিলেন সেটা বোঝার জন্য কি কোন ইতিহাসবিদের বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে? ইতিহাস যদি তাকে সার্বিক চিহ্নিত করতে কার্পণ্য করে তবে সেটা হবে ইতিহাসের চরম ব্যর্থতা। বিএনপি নামক দলটি যতদিন জিয়া পরিবারের নেতৃত্ব মুক্ত না হবে, ততদিন ঐ দলটি ক্ষমতায় এলে আবার ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। তাই প্রকৃত বাঙালীর রক্ত যাদের ধমনীতে প্রবাহিত, তাদেরকে বলছি, ‘সাধু সাবধান’। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা তথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল বলেই ‘মিনি পাকিস্তান’ বানানোর প্রক্রিয়া রোধ করে আজকে বিশ্ব দরবারে বাঙালী এক গর্বিত জাতি। বিদেশে যে বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশের বাঙালী বসবাস করছি, তারা আজ বাঙালী পরিচয়ে সত্যিই গর্বিত। লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×