ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিনই নিশ্চিত হবে প্রার্থিতা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮

 মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিনই নিশ্চিত হবে প্রার্থিতা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় রাজনৈতিক জোট হলো মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একটির নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ আর অপরটির প্রধান দল বিএনপি। জোটের রাজনীতিতে মিল থাকলেও আসন ভগাভাগি নিয়ে মিলছে না। একেবারেই না। যা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। এখন মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নয় ডিসেম্বরেই পরিষ্কার হবে কে কোন আসনে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলেন। তাছাড়া জোটের শরিক দলগুলো কে কয়টা আসন পেল এও নিশ্চিত হওয়া যাবে মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে। অথচ সব দলের পক্ষ থেকেই প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মনোনয়ন দাখিল শেষে যাচাই-বাছাই চলছে। অথচ প্রার্থীদের অনেকেই বলতে পারছেন না শেষ পর্যন্ত তিনি দল বা জোটের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পাবেন। নাকি খবর হবে আপনার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করুন! অথচ বড় দলগুলো জোটের শরিকদের সঙ্গে চূড়ান্ত সমঝোতা ছাড়াই মনোনয়ন দিয়েছে। এতেই বিদ্রোহ দমাতে কষ্ট হচ্ছে। সব দলেই কমবেশি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চলছে ক্ষোভ বিক্ষোভসহ নানা প্রতিবাদী কর্মসূচী। যখন জোটের আসন ভাগাভাগির জন্য দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হবে তখন গৃহদাহ দমানো সব দলের কাছেই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও বড় দলগুলো বিদ্রোহ দমনে আগে থেকে নেতাকর্মীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৩১টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ২৮০টি আসনে ৮০০ জনকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে ২২০টি আসনে প্রার্থী দেয়া হয়েছে। দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়াও ২০ দলীয় জোটের শরিক, ১৪ দলের শরিক, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকেও প্রার্থী দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৭০টি আসন ছাড় দেয়া হতে পারে। এর কারণ হিসেবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবার জোটের পরিধি বেড়েছে। তাই শরিকদের জন্য আসন কমতে পারে। জানা গেছে, ১৪ দলের বাইরে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোট, নাজমুল হুদার দল, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক এ্যালায়েন্টসহ আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক মিত্র। সবাইকে খুশি রাখতে গিয়ে শরিকদের আসন কমতে পারে। বর্তমানে ১৪ দলের শরিকদের ১৭টি আসন রয়েছে। সংরক্ষিত মিলিয়ে জাতীয় পার্টির রয়েছে ৪০টি। যদিও জাপা এবারের নির্বাচনে ৭০টি আসন চেয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, জাপাকে সর্বোচ্চ ৪০টি আসনে ছাড় দিতে সম্মত তারা। এছাড়া যুক্তফ্রন্টকে ৭, ইসলামী ঐক্যজোট, তরিকত ফেডারেশকে দুটি করে চারটি আসন দেয়া হতে পারে। ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে ৫টি করে ১০টি আসন ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি জেপিকে ২টি, এলায়েন্সকে দুটি, নাজমুল হুদাকে একটি আসন ছাড় দেয়া হতে পারে। বাকি আর চারটি আসন হেভিওয়েট প্রার্থী বিবেচনায় শরিক নেতাদের জন্য ছাড় দেয়া হতে পারে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ২৭ দিন বাকি। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ চার সহস্রাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে থেকে প্রায় ২৩১টি আসনে দল মনোনীত প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ দিয়ে চিঠি দিয়েছে। এতে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষ, সড়ক অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর এমনকি গুলিবর্ষণের ঘটনা পর্যন্তও ঘটেছে। অনেক আসনেই মনোনয়নবঞ্চিতরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। অসংখ্য আসনেই নির্বাচনের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে থাকলেও এসব আসনে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এ সুযোগটি কাজে লাগতে চাইছে তারা। তবে বিষয়গুলো তীক্ষ্ন নজরদারি করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী কিংবা সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িত, তাদের তালিকা তৈরি করে নির্বাচনের আগেই জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পথে যাচ্ছে দলটি। জানা গেছে, কেন্দ্র থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। যারা দলের টিকেট পেয়েছেন তারাও বিদ্রোহীদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। তবে দলের হাইকমান্ড হিসেব কষছেন মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে কতজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। কোন পদ্ধতিতে তাদের বসিয়ে একক প্রার্থী রাখা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন দাখিলকারী একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হলে তাঁরা নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রকাশ করতে নারাজ। তাদের মতে, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার সবার রয়েছে। আমরা আশা করি পুনরায় মাঠ জরিপের মাধ্যমে সত্যিকারের জনপ্রিয় নেতাদের বেছে নিতে প্রার্থিতা মনোনয়নের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে। আগামী ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। সুতরাং এর আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি বিদ্রোহীদের। এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগে নিশ্চিত করে বলা যাবে না, কে বিদ্রোহী প্রার্থী। তবে এবারে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত পরিষ্কার ও কঠোর। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত কেউ অমান্য করলে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। আগের মতো বহিষ্কৃত কোন নেতাকে আর কোনদিন দলে ফিরিয়ে নেয়া হবে না। বিভিন্ন আসনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনশ’ আসনের মধ্যে এখনও প্রায় অর্ধশতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি কেন্দ্র কিছু আসনে প্রার্থী রদবদল করে, মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে সেজন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন দাখিল করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- নওগাঁ-২ ড. ইঞ্জিনিয়ার আখতারুল আলম, নওগাঁ-৪ এ্যাডভোকেট আব্দুল বাকী ও আফজাল হোসেন, নওগাঁ-৬ আনোয়ার হোসেন হেলাল, বগুড়া-২ মোস্তাফিজার রহমান মোস্তা ও আবুল কাশেম ফকির, বগুড়া-৪ কামাল উদ্দিন কবিরাজ ও অধ্যাপক আহছানুল হক, বগুড়া-৫ তাহরিনা জামান হিমিকা রাজশাহী-৫ ওবায়দুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, দিনাজপুর-২ আসনে মানবেন্দ্র রায়, কুড়িগ্রাম-১ আসনে ওসমান গণি, মেহেরপুর-১ আসনে এ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী, জয়নাল আবেদীন, প্রফেসর আবদুল মান্নান, যশোর-২ আসনে মনিরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা-১ আসনে ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, সরদার মুজিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে কাউসার আহমেদ পলাশ, ফেনী-৩ আসনে আবুল বাশার, হাজী রহিম উল্যাহ, কুমিল্লা-২ আসনে অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ, চট্টগ্রাম-২ আসনে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, বরিশাল-২ আসনে একে ফয়জুল হক রাজু, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে মতিউর রহমান, ময়মনসিংহ-৩ আসনে ড. অধ্যক্ষ একেএম আবদুর রফিক, ময়মনসিংহ-১০ আসনে ওবায়দুল্লাহ আনোয়ার বুলবুল, নেত্রকোনা-১ আসনে মোসতাক আহমেদ রুহী, নেত্রকোনা-৪ আসনে শফী আহমেদ প্রমুখ। যদিও মনোনয়পত্র যাচাই বাছাইয়ের প্রথম দিনেই বিদ্রোহীদের অনেকের মনোনয়পত্র বাতিল হয়েছে। ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টে নানামুখী সঙ্কট ॥ ২০-দলীয় জোটের সঙ্গে বিএনপির আসন বণ্টন চূড়ান্ত হয়নি। তেমনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির আসন ভাগাভাগির বিষয়ে চূড়ান্ত কোন ঘোষণা এখনও আসেনি। জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন বলেন, নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে প্রার্থীরা মনোনয়ন দাখিল করেছেন। যারা দাখিল করেছেন তারা প্রত্যেকের দলের হয়ে, জোটের হয়ে নয়। তাই জোটের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে চূড়ান্ত করা হবে। আমরা সে লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি। আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের কোন দূরত্ব হয়নি বলেও জানান তিনি। জানা গেছে বিএনপির পক্ষ থেকে দুই জোটকে ৬০টি আসন ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। এর মধ্যে ২০-দলীয় জোটকে ৪২টি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ১৮টি আসন ছাড় দেয়া হতে পারে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে গণফোরামকে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১০টি আসন ছাড়তে পারে বিএনপি। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্যকে ২-৩টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিকে ৩টি এবং কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকেও ৩টি আসন ছাড় দেবে বিএনপি। ২০-দলীয় জোট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির কাছ থেকে দরকষাকষি করে তারা ৪২টির মতো আসন পেতে পারে। এ নিয়ে শরিকদের মধ্যে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, তারা দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য দলের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। ২০-দলের শরিক দলগুলোরও সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। এখন একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রার্থী তালিকা তৈরির জন্য তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ঐকমত্যে যাওয়া হবে। জানা গেছে, ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াত শেষ পর্যন্ত ৩৫টি আসন পেতে দরকষাকষি করছে। তাদের সর্বোচ্চ ২৫টি আসন ছাড় দিতে রাজি হয়েছে বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৮ আসনে নির্বাচন করা জামায়াত ৩৩টিতে জোটের মনোনয়ন পেয়েছিল। পাঁচটি আসনে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলেরই প্রার্থী ছিল। গতবারের ৩৩টির ২৭টিতে এবারও জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত। গতবারের উন্মুক্ত পাঁচটি আসনের তিনটিতে জামায়াত দ্বিতীয় হয়েছিল। বিএনপির অবস্থান ছিল তৃতীয়। এগুলোতেও এবার জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত। ওই ৩০টি ছাড়াও জামায়াত নতুন করে রাজশাহী-১, বগুড়া-৪, ঢাকা-১৫, সাতক্ষীরা-১ ও চট্টগ্রাম-১৬ আসনে মনোনয়ন চায়। সব ছেড়ে জামায়াতের দাবি ২৭টি আসনে। বাকি দুটিতে তারা স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারে বলে জানা গেছে।
×