ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবতার সেবায় শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৩ ডিসেম্বর ২০১৮

 ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবতার সেবায় শেখ হাসিনা

দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে একটি সুখী ও উন্নত দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ কাঠামো পুনর্গঠনে বিশেষ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে। তিনি মনে করেন ইসলামের মূলনীতি বাদ দিয়ে কোনভাবেই ইনসাফভিত্তিক সমাজ তথা দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন কল্পনা ও করা যায় না। তাই তো তিনি জনবহুল বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যার পরেও মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় প্রদান করে ইসলামী মূল্যবোধ ও মানবতার সেবায় সর্বাত্মক সহযোগিতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জনমানসে ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার ও প্রসারে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি ইসলামের সঠিক রূপ সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন সরকারী অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ গবেষণা সংস্থা হিসেবে স্বীকৃত। ইসলামী আকিদাভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন ছিল এক মহাবিপ্লব। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত এ ব্যবস্থা আজও চালু রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আরব বিশ্ব, বিশেষ করে প্যালেস্টাইনি মুসলমানদের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রেখেছিলেন। ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সারা আরব বিশ্বে এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী, শান্তি, কল্যাণ ও মানবতার ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র মানুষ হত্যাসহ নির্বিচারে নির্যাতন চালিয়েছিলেন। তিনি কালিমালিপ্ত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ইসলামের মর্মবাণীর প্রচার-প্রসারে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের কথা চিন্তা করে তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর দেখানো পথ ধরে শেখ হাসিনাও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। পবিত্র কোরান সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এটি মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার, সাম্য, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, আন্তঃধর্মীয় সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বাণী। কোরানের অন্তর্নিহিত জ্ঞান অনুধাবন করে মানব জাতির কল্যাণে কাজে লাগাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালে ৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে আল-কোরান ডিজিটালাইজেশন করেছেন। একই বছর ১০ আগস্ট পবিত্র কোরানের ওয়েবসাইট ‘আল-কুরআন : ডিজিটাল’-এর উদ্বোধন করেছিলেন তিনি। কোরান শরীফ আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে। আমাদের অনেকেই আরবী ভাষা পড়তে পারেন না; আবার অনেকে আরবী ভাষায় পবিত্র কোরান শরীফ পড়তে শিখেন; কিন্তু তার অর্থ বুঝতে পারেন না। আরবীর পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় কোরান পাঠের ব্যবস্থা, এর উচ্চারণ ও অনুবাদ থাকলে তা বুঝতে এবং শুনতে সহজ হয়। মূলত এই উদ্দেশ্যেই কোরান শরীফ ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ, বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক ও শ্রোতাদের জন্য পবিত্র কোরান পড়া, তেলাওয়াত শোনা এবং কোরানের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণী অনুধাবন করার ক্ষেত্রে ‘আল-কুরআন : ডিজিটাল’-এর অনলাইন ও অফলাইন ভার্সন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোরানের উচ্চারণ ও অর্থসহ প্রয়োজনীয় তথ্য ডাউনলোড করা যাচ্ছে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ একটি মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় । এটি বাংলাদেশে অধিভুক্ত প্রথম আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি ও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস করা হয় বহুল প্রতিক্ষীত এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন স্বতন্ত্র ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় আইন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ফাজিল (স্নাতক সমমান) ও কামিল (স্নাতকোত্তর সমমান) পর্যায়ের ডিগ্রী প্রদান করা হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, ফাজিল ও কামিল পর্যায়ের শিক্ষাক্রম অনুমোদন, শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন, মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষাঙ্গনগুলোর তদারকি ও পরিবীক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধায়নের জন্য ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদ্রাসা ধারার ফাজিল ও কামিল সনদকে যথাক্রমে সাধারণ শিক্ষাস্তরের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমান মর্যাদা প্রদান করা হয়। ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। স্বতন্ত্র ইসলামিক আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের সব ডিগ্রী এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হবে। এ ধরনের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় দেশে এটাই প্রথম। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে মাদ্রাসা শিক্ষার মান এবং শিক্ষকদের মর্যাদা বেড়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষকরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ও দেশের আলেম সমাজের দাবি অনুসারে স্বতন্ত্র মাদ্রাসা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালে রাজধানীর মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সম্মেলনে সর্বপ্রথম স্বতন্ত্র মাদ্রাসা অধিদফতর প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়েছিল। ’৭৬-এর পর থেকে প্রতিটি সরকারের কাছে অধিদফতর প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়াসহ সর্বস্তরের মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরা দাবি জানিয়ে আসলেও সাড়া দেয়নি কোন সরকারই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশ অনুসারে দীর্ঘ চার দশক পর শেখ হাসিনার সরকার ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষানীতিতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর প্রতিষ্ঠাসহ মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বর্তমান সরকার মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করেছে। সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শিক্ষা শাখা চালু করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিফতরের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা দেয়া হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক বিষয়ে মনিটরিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধদিফতর। দেশের সব শ্রেণীর আলেম-উলামারা যাতে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্র্ম থেকে ইসলাম প্রচার গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করার মানসে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যাত্রা। ‘ইসলামের মৌলিক আদর্শ, বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি প্রচার ও প্রসারের কাজে সহযোগিতা করা এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা। এছাড়া ‘ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালা’ জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার আয়োজন করা ও তার প্রসার ঘটানো এবং জনপ্রিয় ইসলামী সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলোর সুলভ প্রকাশনা ও বিলি বণ্টনকে উৎসাহিত করা। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অবয়ব ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের দিক থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে, তার অন্যতম হলো : জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সৌন্দর্যবর্ধন, মিনার নির্মাণ ও সম্প্রসারণ; ইমাম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম; পার্বত্য জেলায় ইসলামিক মিশন কার্যক্রম; ইসলামী প্রকাশনা কার্যক্রম; এছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ডিজিটালে রূপান্তর, আন্তর্জাতিক হিফজ, কিরাত ও তাফসির প্রতিযোগিতা; আল কোরান ডিজিটাইজেশন উল্লেযোগ্য। ইসলামী মূল্যবোধের উন্নয়ন ও ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের সময় সৌদি বাদশাহর সঙ্গে আলোচনায় দেশব্যাপী মডেল মসজিদ নির্মাণে তার আগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী মডেল মসজিদের নকশা তৈরিসহ সামগ্রিক বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২৫ এপ্রিল ২০১৭ একনেক ৯ হাজার ৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকার এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় । বহুমুখী এ মসজিদগুলো ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে স্ব-স্ব এলাকায় কাজ করবে। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম’ প্রকল্প শেখ হাসিনা সরকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎ প্রকল্প। বর্তমানে প্রকল্পের ৬ষ্ঠ পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পটির আকার পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ‘মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম’ দেশের শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ প্রকল্পে মসজিদের ইমামগণ মসজিদ কেন্দ্রে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদের বাংলা, অংক, ইংরেজী, আরবী নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার ও কোর্স সম্পন্নকারীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী অধিকাংশই সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠী। এ প্রকল্পের আওতাধীন প্রতিটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন, সহজ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ জন ও বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ জন। মূলত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে মসজিদের ইমাম সাহেবদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রাক-প্রাথমিক এবং ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরী ও অক্ষর জ্ঞানহীন বয়স্কদের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করেছে। প্রকল্পের আওতায় দেশের কোটি কোটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু কিশোর ও বয়ষ্ক নাগরিককে শিক্ষা দানের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এ ছাড়াও মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং ধর্মীয় পুস্তক পাঠদানের জন্য ৪৮৫টি মডেল ও ১০৫১ টি সাধারণ রিসোর্স সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে ৮১০৬৭ জন লোকের নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটিতে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম হলেও বর্তমান প্রকল্পে ৫২৯৫ জনেরও বেশিসংখ্যক মহিলা জনবল নিয়োজিত আছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার বাইরে থাকা দেশের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশের শিক্ষার দায়িত্ব পালনকারী কওমী ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে কওমী ধারার শিক্ষার সর্বোস্তরে দাওরায়ে হাদিসকে কওমী মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্ধের মূলনীতির ওপড় ভিত্তি করে সাধারণ শিক্ষা ধারার ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সমমান প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ এপ্রিল ২০১৭ গণভবনে কওমী মাদ্রাসার আলেম-উলামাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই স্বীকৃতি প্রদান করেন। ১৩ এপ্রিল ২০১৮ইং মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ‘দাওরায়ে হাদিসকে’ সাধারণ শিক্ষাধারার ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সমমান প্রদানের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। বর্তমানে কওমী মাদ্রাসার ৬টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সব দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা সরকার অনুমোদিত কওমী মাদ্রাসা বোর্ডসমূহ গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি দ্বারা নিবন্ধিত। এই কমিটির আওতায় দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা ও উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তর সনদ দিয়ে থাকে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমীয়া বাংলাদেশ। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংসদের ২২তম অধিবেশনে কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে স্নাতকোত্তর (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দেওয়ার বিলটি মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়। বিলটি পাসের মাধ্যমে স্বীকৃতিবিহীন দেওবন্ধ ধারার অনুসারীরা শিক্ষার মূলধারায় সম্পৃক্ত হলো। ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা সারাজীবন মসজিদে খেদমত করেন কিন্তু শেষ বয়সে এসে তারা কিছুই পান না। বরং সবসময় তারা তাদের চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্কে থাকতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে মঞ্জুর করে ‘ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করে দিয়েছেন। দেশের ‘ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট’ শেখ হাসিনার নিজের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে। যেটা আগে ছিল না। ধর্মীয় শিক্ষাদানের পাশাপাশি আলেম-ওলামাদের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তিনি বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছেন ফতোয়া দেয়ার অধিকার সবার জন্য অবারিত বা উন্মুক্ত নয় বরং যিনি ফকীহ্ বা মুফতি কেবল তিনিই ফতোয়া দেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। ফতোয়া বিভাগের সনদপ্রাপ্ত আলেম ছাড়া যে কেউ ফতোয়া দিতে পারবেন না, এটা কোরান সূন্নাহ পরিপন্থী ও বেআইনী। এতে ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি ও সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ফতোয়া জারির জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ‘ফতোয়া বোর্ড’ রয়েছে। শরীয়তের বিষয়ে যে কোন সমস্যা সমাধানে বা নীতি নির্ধারণের প্রয়োজন হলে উক্ত বোর্ড বা কাউন্সিল বিষয়টির ব্যাপক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার পর ‘ফতোয়া’ দিয়ে থাকেন। এটা এক ধরনের আইনসম্মত বা শরীয়া সম্মত মতামত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক ফতোয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। শেখ হাসিনা সেই মতবিরোধ দূর করার পাশাপাশি সঠিক ফতোয়া প্রস্তুত করার জন্য ৫ জন আলেমকে এমিকাস কিউরি মনোনীত করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে উপযুক্ত মুফতিগণ কর্তৃক ফতোয়া প্রদানের আইনগত অধিকার সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নির্দেশনায় ২০১০ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি জাতীয় হজনীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০১০ সালে আশকোনায় হজক্যাম্পের ডরমিটরিতে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি লিফট স্থাপন করা হজযাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ২০১১ সালে জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া নেয়া হয়েছ। যার জন্য ২০১০-১১ সালে বাংলাদেশ হজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়েছে। এ ছাড়াও কন্যাশিশু ও বয়স্ক নারীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য ছয় হাজার ধর্মপরায়ণ নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চল্লিশটি মিশনের পাশাপাশি আরও সাতটি মিশন স্থাপন করা হয়েছে। ইসলাম প্রচারে নিবেদিত তবলিগ জামায়াতের সদস্যদের স্থান সঙ্কুুলানের কথা চিন্তা করে কাকরাইল মসজিদ সম্প্রসারণ এবং সেখানে ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। তবলিগ জামায়াতের জন্য টঙ্গী এজতেমা ময়দান বরাদ্দ দিয়ে সেখানে সরকারীভাবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা বায়তুল মোকাররম মসজিদকে একসঙ্গে পাঁচ হাজার ছয় শ’জন মহিলা ও বিশ হাজার পুরুষ মুসল্লির নামাজ আদায়ের স্থান সম্প্রসারণ ও সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে । সেই সঙ্গে বায়তুল মোকাররম মসজিদ কমপ্লেক্সে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের উন্নয়নের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। দেশের হাজার হাজার বেসরকারী মাদ্রাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ, মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। হজ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নাধীন, ইসলামী প্রকাশনা প্রকল্প বাস্তবায়ন, ইসলামিক মিশন কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থা, চট্টগ্রাম জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেক্স ফাউন্ডেশনের অনুকূলে ন্যস্তকরণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ, আন্তর্জাতিক হিফজ, কিরাত ও তাফসির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সাফল্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে সচেতন। নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুরক্ষাসহ সব প্রতিকূলতা দূর করে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে শেখ হাসিনার অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×