ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও সক্রিয় মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চক্র ॥ আটক ১০ রোহিঙ্গা

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

আবারও সক্রিয় মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চক্র ॥ আটক ১০ রোহিঙ্গা

স্টাফ রিপোর্টার কক্সবাজার ॥ অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া মানবপাচার কোনভাবেই থামছে না। ইতিপূর্বে সরকারের সফল অভিযানে সমুদ্রপথে মানবপাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের পর কক্সবাজার থেকে মালয়েশিয়া মানবপাচার হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িতে দালালদের মধ্যে কেউ আবার বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। কেউ মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে রুজু করা মামলায় হাজতে রয়েছে। আবার অনেকে গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছে। তিন বছর পর রোহিঙ্গারা ফের শুরু করে দিয়েছে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার কাজ। বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা পৃথক অভিযান চালিয়ে তিন দফায় ৪৭ রোহিঙ্গা উদ্ধার ও চার দালালকে আটক করেছে। অবৈধভাবে সাগরপথে যে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়া যায়, তা আগে কখনও জানত না টেকনাফ ও সীমান্তের ওপারের লোকজন। মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারাই আবিষ্কার করেছে সাগরপথে মালয়েশিয়া মানবপাচার কাজ। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা দালালদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে প্রতিরাতে শত শত মানুষ সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মানবপাচার প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতিতে ২০১৫ সালে কঠোর থেকে কঠোরতম ভূমিকা নিলে এক প্রকারে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়া মানবপাচার। তখন থেকে প্রায় ৩ বছর ধরে কক্সবাজারে মানবপাচার কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ঢালাওভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে। কূটনৈতিক আলোচনাসহ ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে সরকার যখন মিয়ানমারের সঙ্গে একমত হয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করার উদ্যোগ নেয়, তখনই রোহিঙ্গাদের মন বিগড়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য স্থায়ীভাবে না হলেও অন্তত একযুগ ধরে এদেশে থেকে যাওয়া। কৌশলে বিদেশে পাড়ি দেয়া। তবে প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হচ্ছে দেখে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে। তারা দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়া, ভুয়া ঠিকানায় জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া পাচারকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে ছয় নারীসহ ১০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা ও মানবপাচার, অস্ত্র বেচাকেনা, বিদেশে নারী পাচার, জঙ্গী প্রশিক্ষণ ইত্যাদি জঘন্যতম অপরাধগুলো প্রথম সৃষ্টি করেছে রোহিঙ্গারা। তাদের দেখাদেখিতে জড়িয়ে পড়েছে এদেশের কিছু লোভী ব্যক্তি। মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে রয়েছে ধনাঢ্য রোহিঙ্গা। তারা উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় শিবির থেকে সুন্দরী রোহিঙ্গা যুবতী-কিশোরীদের ভাগিয়ে নিতে দালাল (রোহিঙ্গা) নিয়োজিত করেছে বাংলাদেশে। তারা আশ্রয় শিবিরে ঘুরে যে কক্ষে সুন্দরী যুবতি ও কিশোরী দেখে, তাদের কাছে সরাসরি প্রস্তাব রাখে বিদেশে গমনের। আশ্রিত রোহিঙ্গা অভিভাবকগণও তাদের কিশোরী মেয়েদের দালালের হাতে তুলে দিতে সহজে রাজি হয়ে পড়ে। যেহেতু একদিকে মেয়েকে টাকা ছাড়া বিদেশে পাঠানো, অপরদিকে সেখানে গিয়ে স্বামীর ঘরে সংসার ও মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত থাকবে। তাই রোহিঙ্গারা বিনা বাধায় দালালের হাতে তুলে দেয় তাদের সন্তানদের। দালালরাও বিদেশে থাকা খদ্দেরের (হবু স্বামী) কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়ার আশায় রোহিঙ্গা মেয়েদের বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে বিশেষ করে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় পাচার তৎপরতায় লিপ্ত। র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা গোপনে খবর পায় যে একদল রোহিঙ্গাকে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশে একটি ঘরে জড়ো করা হয়েছে। শুক্রবার ভোরে র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে র‌্যাব সদস্যরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া ফজলুল হকের বাড়িতে অভিযান চালায়। আটক করা হয় দালাল আবদুর রহমানকে। আটক দালাল মাঝেরপাড়ার ফজলুল হকের পুত্র। তার স্বীকারোক্তি মতে উদ্ধার করা হয়েছে রশিদ উল্লাহ, নুর আলম, মোঃ জাবের, মোছাঃ মোকদেছা, জান্নাত আরা, সেতেরা, জোলেখা, রোজিনা, জিয়াউর রহমান ও সলিকা নামে ১০ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ । র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর মোঃ মেহেদী হাসান জানান, শুক্রবার রাতে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে শাহপরীর দ্বীপের আবদুর রহমানের বাড়িতে কিছু রোহিঙ্গাকে জড়ো করে রাখা হয়েছে এমন সংবাদে র‌্যাবের একটি দল ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। মেজর মেহেদী আরও জানান, নিরাপদে মালয়েশিয়া পৌঁছে দেয়ার প্রলোভনে ১০ হাজার টাকা ‘টোকেন মানি’ নিয়ে তাদের সেখানে নিয়ে আসা হয়। গভীর সাগরে একটি বড় ট্রলারে তাদের তুলে দেয়ার কথা ছিল। মালয়েশিয়া পৌঁছার পর আরও ২ লাখ টাকা করে দেয়ার চুক্তি হয় তাদের সঙ্গে। এছাড়াও রোহিঙ্গা নারীদের সেখানে বিয়ের ব্যবস্থার কথাও হয় বলে দাবি করেন উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নারীরা। কয়েকদিন আগেও দু’দফায় ১৪ ও ২৩ রোহিঙ্গাকে একই এলাকার সৈকত থেকে উদ্ধার করা হয়। যারা মালয়েশিয়া যেতে দালালদের ২০ হাজার টাকা করে দিয়ে দুদিন সাগরে ঘুরে প্রতারিত হয়েছে। মানবপাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা এনজিও হেলপ কক্সবাজারের নির্বাহী আবুল কাশেম জনকণ্ঠকে বলেন, বেশিরভাগ মানবপাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। বর্তমানে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিতে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে সরে পড়ছে। তারা দালালের হাত ধরে পাড়ি দিচ্ছে মালয়েশিয়ায়। কেউ সেখানে গিয়ে মাবাবাকে নিয়ে যাওয়ার এবং কেউ মালয়েশিয়া পৌঁছে স্বামী গ্রহণ করার (বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া) উদ্দেশে আশ্রয় শিবির ত্যাগ করছে। মিয়ানমার সাগরে ৯৩ জন আটক ॥ ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে শুক্রবার ভোরে সাগর থেকে মিয়ানমার নৌবাহিনী ৯৩ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। তারা রাখাইনের রাজধানী সিটওয়ে (আকিয়াব) থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছিল। মিয়ানমার প্রশাসন শনিবার দেশটির গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছে, এসব রোহিঙ্গারা নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করলে সে দেশের নৌবাহিনী তাদের আটক করে। আটককৃতদের মধ্যে নারী এবং শিশুসহ ৯৩ জন রোহিঙ্গা রয়েছে।
×