ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপীদের লম্বা লাইন

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপীদের লম্বা লাইন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি নবেম্বর মাসে ব্যাংকগুলোতে খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিলে পড়েছে ঋণ খেলাপীদের লম্বা লাইন। এই একমাসেই ১৭০টি খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিলের আবেদন এসে জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্ট করে না বললেও ইঙ্গিত দিয়েছে, পুনর্তফসিলের আবেদন নিয়ে হাজির হওয়া ঋণ খেলাপীদের বড় একটি অংশই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী হতে চান। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ঋণ খেলাপীর তকমা থাকলে নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভব হবে না বলেই তারা শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে পুনর্তফসিলের মাধ্যমে প্রার্থিতার যোগ্যতা নিশ্চিত করতে চান। সাধারণত কোন ঋণ নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ না করা হলে ওই ঋণকে খেলাপী ঋণ হিসেবে ঘোষণা করে ব্যাংক। পরে ঋণ নেয়া ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে ‘ঋণখেলাপী’ ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ঋণ খেলাপী কোন ব্যক্তি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। অন্যদিকে, কারও এক টাকা ঋণ থাকলেও এবার সেই তথ্য ব্যাংকগুলোকে পাঠাতে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে যেকোন পরিমাণের খেলাপী ঋণের কারণেই এবার জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থিতা আটকে যেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট ডাউন পেমেন্ট দিয়ে পুনর্তফসিলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি সনদ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সিআইবি সনদ পেলে আগের ঋণ খেলাপীরাও অংশ নিতে পারবেন নির্বাচনে। সে কারণে নির্বাচন এলেই ব্যাংকগুলোতে ঋণ পুনর্তফসিলের হিড়িক পড়ে যায় বলে জানান অর্থনীতিবিদরা। ব্যতিক্রম হয়নি এ বছরও। এই নবেম্বর মাসেই ১৭০টি খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিলের আবেদন এসে জড়ো হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘নবেম্বর মাসে ১৭০টি খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিলের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে সবই যে নির্বাচন সংক্রান্ত, তা বলা যাবে না। তবে অধিকাংশই নির্বাচন সংক্রান্ত।’ পুনর্তফসিলের আবেদনকারীরা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীরাই কিনা, জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘পুনর্তফসিলের আবেদনে তো আর প্রার্থীর পরিচয় দেয়ার দরকার নেই। তার খেলাপী ঋণটি নিয়মিত করা প্রয়োজন। তা না হলে তো সে প্রার্থী হতে পারবে না। সেজন্য আমরা ধারণা করতে পারি, নির্বাচনের ঠিক আগে আগে যে আবেদনগুলো এসেছে, এগুলো নির্বাচন সংক্রান্তই হবে। হয়ত প্রার্থীরাই আবেদন করেছেন। তা না হলে সারাবছর তো কেউ ব্যাংকে ঋণ পুনর্তফসিল করতে আসে না।’ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখেই সাধারণত খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিল করা হয়ে থাকে। যারা প্রার্থী নয়, তারাও এই সময়টিতে সুযোগ নেয়। তবে ব্যাংকে ভিড় থাকে মূলত প্রার্থীদেরই।’ ঋণ খেলাপী ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে এবার নতুন একটি বিধান হয়েছে। এর আগে, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়ের সাতদিন আগে সিবিএ সনদ নিতে হতো। কিন্তু এবার মনোনয়নপত্র দাখিলের আগ পর্যন্ত পুনর্তফসিলের সুযোগ রাখার সমালোচনা করে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘এর ফলে যারা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় খেলাপী ঋণ পুনর্তফসিলের চেষ্টা করছিল, তারা মনোনয়ন না পেলে আর খেলাপী ঋণ পরিশোধ করবেন না।’ ফলে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবার খেলাপী ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের পরিমাণ কমতে পারে বলে মনে করছেন তিনি। এদিকে, পুনর্তফসিলের মাধ্যমে খেলাপী ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের পরিমাণ জানাতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্তত ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও খেলাপী ঋণ থেকে তাদের অর্থ আদায়ের পরিমাণ জানা যায়নি। তবে কয়েকটি ব্যাংক তাদের লক্ষ্যের কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার খেলাপী ঋণ আদায়ের প্রত্যাশা করছে। ইসলামী ব্যাংক বলছে, আঞ্চলিক অফিসগুলো থেকে এখনও তথ্য আসেনি। বুধবার মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন থাকায় পরবর্তীতে তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে ব্যাংকটি। ওয়ান ব্যাংকও একই ধরনের তথ্য জানিয়েছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত দেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। আর খেলাপী ঋণের ৪৩ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই এ তথ্য জানিয়েছিলেন।
×