ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

হারাচ্ছে গারো বর্ণমালা

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

হারাচ্ছে গারো বর্ণমালা

ঐতিহ্যগতভাবে নানা কারণে বাংলাদেশে নানা ধর্মীয় কুসংস্কার, গোড়ামী ও ধর্মান্ধতার প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জন্ম হওয়ার পর থেকে এটি অব্যাহতভাবেই প্রসারিত হচ্ছে। একাত্তরে আমরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ভেঙ্গে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরও সেই রাজনীতির ছক থেকে এখনও বের হতে পারিনি। তবে বিষয়টি কেবল রাজনীতিতেই সীমিত নেই। বস্তুত ধর্মান্ধতার শিকড় অনেক গভীরে। কুসংস্কার তো বটেই এটি এমনকি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও গারো ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা হারানোর মতো অবস্থাও তৈরি করেছে। আমরা আজ ধর্মের নামে অন্য কুসংস্কার জন্ম নেবার পাশাপাশি গারোদের বর্ণমালা বিলুপ্ত হবার কথাও বলব। ২০১৩ সালের কোরবানির ঈদের পরদিন ১৭ অক্টোবর আমরা টাঙ্গাইলের মধুপুর গিয়েছিলাম। এর আগে কুমিল্লায় গিয়েছিলাম। কুমিল্লায় যেমন নজরুল ও শচীন দেব বর্মণের স্মৃতি দেখার বিষয় ছিল মধুপুরে তেমন বড় কিছু ছিল না। শুনেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের প্রতিষ্ঠাতা নবাব আলীর বাড়ি ধনবাড়ি উপজেলায়-মধুপুরের কাছেই। রাজবাড়িও নাকি আছে একটা। আছে ইকোপার্ক এবং পিকনিক স্পট। তবে মধুপুরে গারো সম্প্রদায় বসবাস করে এই ভাবনা থেকে আমরা গারো পরিবারের সঙ্গে মেশার ও আমাদের শিশুশিক্ষা সফটওয়্যারের গারো সংস্করণ তৈরির কথা ভাবছিলাম। সেই সূত্র ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেসবাহ কামালের মাধ্যমে আমরা সন্ধান পাই গারো নেত্রী সুলেখা ম্রোং-এর। এর বাইরেও আমার ফেসবুক হিসাবের স্ট্যাটাস থেকে জেনে সুদূর জাপান থেকে হারুনর রশিদ, মধুপুরের শরিফুল ও বিজয় মজুমদার আমাদের সহায়তা করার প্রস্তাব করেন। তবে তাদের কারও সহায়তার প্রয়োজন আমাদের হয়নি- একা সুলেখা ম্রোংই আমাদের সকল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে যান। সুলেখা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল আমাদের আগেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি মধুপুরের ইকোপার্ক আন্দোলনের সাথে যুক্ত এবং সামাজিকভাবে তিনি খুবই প্রভাবশালী। সুলেখা ম্রোং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছিলাম, আমাদের টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর পার হয়ে ময়মনসিংহের দিকে পঁচিশমাইল নামক বাজার হতে সৌলবাড়ি সড়ক ধরে ভুটিয়া গ্রামে তার বাড়িতে যেতে হবে। সুলেখা আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি। সেই পথ ধরে যেতে যেতেই পচিশমাইল বাজার ছাড়িয়ে মধুপুর জঙ্গলে প্রবেশ ও জলই গ্রামে যাওয়া। বস্তুত ভুটিয়া গ্রাম খুঁজতে গিয়ে জলইতে চলে গিয়েছিলাম আমরা। জলই মধুপুর জঙ্গলের ভেতরে গারোদের একটি গ্রাম। সড়কের চারপাশের মনোরম দৃশ্য মুগ্ধ করে দেয়। ছিমছাম সুন্দর চারপাশ। বাংলাদেশের সমতল এলাকার সাধারণ গ্রামের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। কদাচিত দুয়েকটা মানুষ চোখে পড়ে। ভ্যান গাড়ির সঙ্গে দেখা যায় মোটর সাইকেল। সম্ভবত ওরা ভাড়ায় মানুষ বহন করে। কখনও ঘোড়ার গাড়িও নজরে আসে। দু’পাশে গাছ গাছালির ফাঁকে হলুদ, আনারস আর পেপে ক্ষেত। গাছের পর গাছ। বাঁশঝাড় থেকে শুরু করে শত রকমের গাছের সমারোহ। এই পথ ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে যেতে যেতে চা খাব ভেবে যেখানে আমরা থেমেছিলাম সেখানে কারিতাসের তৈরি শিশুদের একটি স্কুল আছে। সেটি আবার গির্জাও। প্রতি রবিবার সেখানে খ্রীস্টানদের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। আশপাশের গারোদের নাম অঞ্জলী, সুলেখা ইত্যাদি হলেও তারা প্রায় সবাই খ্রীস্টান। ওরাই রবিবারে জমায়েত হয় খ্রিস্টধর্মীয় প্রার্থনার জন্য। স্কুলের মাটির ঘরের চারপাশের পরিবেশটা মনোরম। রাস্তার তেমাথার বাম কোণে একটি চায়ের দোকান। গারোরা বেঞ্চিতে বসে দোকানটিতে আড্ডা দেয়। এক গারো মহিলা দোকানটি চালান। গরুর দুধের চা আছে জেনে আমরা থেমে গেলাম কোনাটায়। তাকে চা বানানোর অনুরোধ করে একটু একটু করে কথা বলতেই তিনি অনেক কথা বললেন। তিনি জানালেন, গারোরা অনেক গরিব। এই ময়মনসিংহ অঞ্চলে ওরা প্রায় হাজার তিরিশেক রয়েছেন। খেত খামারই তাদের একমাত্র পেশা। তবে এখন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। ওখানকার কাকাবাবু বললেন, গারোরা সবাই নাম স্বাক্ষর করতে পারে। শতকরা ৯৫ জন প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত। উচ্চশিক্ষার হার দিনে দিনে বাড়ছে। ওদের ভাষা আছে। তার নাম আচিক। তবে কোন বর্ণমালা নেই। রোমান হরফে লেখা হয় তাদের ভাষা। কেউ কেউ বাংলা হরফও ব্যবহার করে। ধর্ম প্রচারকরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, রোমান হরফ দিয়ে ওদের ভাষা লেখা সহজ। বস্তুত বিষয়টি একেবারেই উল্টো। ওদের ভাষার শব্দাবলী বাংলা হরফে যত সহজে লেখা যায় সেটি রোমান হরফ দিয়ে ততো সহজে লেখা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গারো ভাষা লেখা হয় না। এটি এখন আমাদের নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল অঞ্চলের ভাষার মতোই একটি আঞ্চলিক বা পারিবারিক ভাষা। তারা প্রায় সবাই ভালভাবে বাংলায় দক্ষ। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা বিধায় তারা স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলায় দক্ষতা অর্জন করে। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম প্রচারকরা গারো ভাষার ধর্মপুস্তককে রোমান হরফ দিয়ে লেখে সেই ভাষাটিকে রোমান হরফের দাসে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। গারো হরফের বিদায়ের পর রোমান হরফের জন্য বাংলা হরফও যে হারিয়ে যাবে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। আমার কাছে আতঙ্কজনক মনে হয়েছে ধর্মকে কেন্দ্র্র করে কুসংস্কারের প্রসার ঘটানোর চেষ্টাটিকে। জলই গ্রামের চায়ের দোকানটার একটু সামনেই একটি বটগাছ আছে। সেটি দেখতে এই পথেই হাজার হাজার লোক আসে। বটগাছে রয়েছে কথিত যীশুখ্রিস্টের মুখ। গাছের মাঝখানটাতে কিছু শিকড়বাকড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে যীশুর মুখ হিসেবে। ওখানে আছে প্রার্থনার জায়গা। আমরা কৌতূহলী হলাম। ইন্টারনেটে প্রায়ই দেখি, গাছ লতাপাতা, মাছ, সব্জি, ফল ইত্যাদিতে বিভিন্ন ধর্মীয় বাণী বা প্রতীক খোদিত রয়েছে। এ ধরনের প্রচুর ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সর্বশেষ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী সাইদীর কথা মনে পড়ল। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে তাকে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজব ছড়িয়ে পুরো দেশে তুলকালাম কা- ঘটানো হয়েছিল। এই অঞ্চলের হিন্দুরা যেখানে সেখানে গাছ-লতাপাতা ইত্যাদির পূজা করে থাকেন। পশুপাখিও তাদের দেবতা। যারা দেবতার পূজা করে তাদের কাছে কোথাও অলৌকিক কিছু ধারণা করে তার পূজা করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু খ্রিস্ট বা মুসলমান ধর্মে পূজা করার কোন সুযোগ সেই। মধুপুরের জলই গ্রামের সেই বিবরণটুক ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। এসব প্রসঙ্গ এমনিতেই আসেনি। বস্তুত আমাদের দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অংশ হিসেবেই এসব আমাদের নজরে আসে। আমি অনেক কোন থেকে ছবি তুললাম। প্রার্থনার জায়গায় গেলাম। কিন্তু কোথাও যীশুর মুখের সঙ্গে কোন মিলের এলাকা পেলাম না। দুটি গারো তরুণী পঁচিশমাইল বাজার থেকে কষ্ট করে যীশুর মুখ দেখতে এসেছে। ওদের কাছে জানতে চাইলাম- তোমরা কি যীশুর মুখ দেখেছো। ওরা বলল, না। বটের ডালে যীশুর কোন আকৃতিই চোখে পড়েনি তাদের। কিন্তু তাতে কি? ওদের কাছে জানতে চাইলাম, প্রার্থনা করবে না? এইচএসসিতে পড়া মেয়েটি বলল, গাছের কাছে প্রার্থনা কিসের? যীশুর মুখ যদি এখানে থেকেও থাকে তবে এই গাছটিকে কেন পূজা করব? তবে গ্রামের সাধারণ গারোরা উল্টো চিন্তা করে এবং গভীর বিশ্বাসে সেখানে সমবেত হয়। ওখানে ৩ বেলা প্রার্থনা হয়। মোমবাতি আর উপাসনালয় সম্পূর্ণ প্রস্তুত, এই কথিত বটগাছকে পূজা দিতে। বাইরেই মোমবাতি নিয়ে বসে থাকা হকারও আছে। আমি অবাক হইনি এটি দেখে যে, গ্রামের সবাই খ্রীস্টান হয়ে গেছে। এটিও অবাক হইনি যে, কারিতাসের মতো এনজিও সেখানে স্কুল করেছে। যারা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের খবর রাখেন না তারা বিস্মিত হতে পারেন এটি জেনে যে, বছরের পর বছর ধরে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকরা নানাভাবে এই পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়সমূহকে তাদের ধর্মে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলাম সেখানে প্রবেশই করতে পারেনি। দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিন্দুও সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। ওরা কেউ কেউ হিন্দু নাম রাখলেও, মাইকেল, রোজারিও, গমেজ এসব খ্রীস্টান নামও গ্রহণ করেছে। এটি যে খ্রীস্টান ধর্ম প্রচারকদের কৌশলগত সফলতা সেটি না বললেও চলে। এই জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দেবার পাশাপাশি তাদের ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি নজর দেয়াও একটি বড় কারণ। এসব জাতিসত্তার মানুষ তাদের সকল আচার-আচরণ বহাল রেখে খ্রীস্টান ধর্ম চর্চা করে। গারোদের মতোই অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগুলোর ক্ষেত্রে ধর্মান্তর ছাড়াও আরও একটি কাজ করেছে। এসব ভাষার বর্ণমালাকে বিদায় করে রোমান হরফ তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। এজন্য বই তৈরি করা হোক, সফটওয়্যার বানানো হোক বা কীবোর্ড দান করা হোক তার কোনটা করার ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে কার্যরত বিদেশী ধর্মীয় এনজিওগুলোর পাশাপাশি মিশনারিরা পেছনে পড়ে থাকেনি। এই কাজটি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেই শুরু করা হয়নি। ব্রিটিশ ভারতে ভারতবর্ষজুড়ে মিশনারিরা তাদের ধর্ম প্রচারের যে কার্যক্রম শুরু করে এটি তারই অংশ। দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের কোন সরকার বিষয়টির গভীরতা নিয়ে ভাবেনি। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাষা সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকার ফলে একদিকে বাংলা ভাষা রোমান হরফে লেখা হচ্ছে, অন্যদিকে সকল ক্ষুদ্র ভাষাগুলো ইংরেজী হরফের কাছে তাদের ঐতিহ্যগত মূল বর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। কোন স্বাধীন দেশের যে কোন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা লক্ষ্য করেছি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গারোরা পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দা নয় বলে তারা সেই সুবিধা পায় না। সরকারের দায়িত্ব হলো গারো হাজং কোটাসহ যেসব ক্ষুদ্র জাতি পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে বসবাস করে তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য যথাসম্ভব সহায়তা করা। বিশেষ করে ভাষার নামে জন্ম নেয়া বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারিকে যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা দুনিয়াকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপহার দিয়েছে তখন বাংলাদেশের ঘাড়ে যে কোন মাতৃভাষা রক্ষার দায়িত্বটা একটু বেশি। সেই কারণেই ক্ষুদ্র ভাষাভাষীদের বর্ণমালা রক্ষা করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। অন্যদিকে ধর্ম প্রচারের নামে কোন ভাষার মূল বর্ণকে হটিয়ে দেয়াকে কোনভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। সেজন্য আমাদের সরকার এগিয়ে এসেছে। সরকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা করার জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু গারোরা নিজে যদি তাদের ভাষা ও হরফ রক্ষা করতে এগিয়ে না আসে তবে তাদের ভাষা ও হরফ কে রক্ষা করবে। ঢাকা, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৪/ ৩০ নবেম্বর ১৮ ॥ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×