ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

আন্দোলিত যখন মাতৃভূমি

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

আন্দোলিত যখন মাতৃভূমি

আজকাল অনেকেই বলেন বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর ধরে সার্বভৌম এই দেশ নানা রকম রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাই পার হয়েছে বটে কিন্তু এখন ‘ক্রান্তিকালে’র সংজ্ঞা যে কি এটা কেউ পরিষ্কার করে বলতে পেরেছেন এমনটা দেখা যায় না। একটা সময় ছিল নব্বই দশকে, এরশাদের সময়কালের শেষের দিকে যখন সামরিক শাসনের থেকে উদ্ভূত স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্র থেকে বাংলাদেশ সংসদীয় ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সংগ্রাম করছিল আর তা ছিল স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। অপর একটি জরুরী বিষয় যোগ হয়েছে এ দেশের জন্য, ২০১৩ সালে যখন যুদ্ধাপরাধীদের উচিত বিচারের জন্য গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন হয়, যা ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ নির্দেশনা হিসেবে। এটা নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন, দেশের আপামর মানুষ যখন আন্দোলিত হয় তখনই দেশে আন্দোলন হয় বা ঘটে, শুধু শুধু আন্দোলন হয় না বা কোন ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের ডাক দিলেই তা দেশের জন্য ‘ক্রান্তিকাল’ হয়ে যায় না। ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ এখন কিসে আন্দোলিত? প্রযুক্তি বৈষম্য কমিয়ে আনার যে সংগ্রাম তা এখন জোরদার, তাতে আর এটাই বাংলাদেশের জন্য ক্রান্তিকাল যা মহাকালের বিচারে বাংলাদেশের মানুষ জয় করতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। বাংলাদেশের আগে বা এখনও পর্যন্ত তথ্য-প্রযুক্তি কোন দেশের রাজনৈতিক দর্শনে স্থান পায়নি। যা ঘটেছিল ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর যখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন। সেই থেকে গত এক দশকে দেশের মানুষ নির্বিবাদে এই আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। সরকারের সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশের সকল জেলা, উপজেলা ও প্রায় সব ক’টি গ্রামের মানুষ এ পর্যন্ত শুধু তথ্য-প্রযুক্তি খাতেই এমনভাবে নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছে যা অন্যান্য উন্নয়ন খাতে এত দ্রুত সম্পন্ন হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ সংগঠনের আন্দোলনে উজ্জীবিত বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামের মানুষ জানে ইন্টারনেট কি। দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষের কাছে মোবাইল ফোন আছে তার মানে দেশের প্রায় সব প্রান্তে মোবাইল ফোনের সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যাদের কাছে মোবাইল ফোন আছে তাঁদের সবাই চাইলেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। তার মানে দেশের সকল প্রান্তেই ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থাও সম্প্রসারিত হয়েছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট সংযোগপ্রাপ্ত গ্রাহকসংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৫৭ ভাগ। তার মানে এই পরিমাণ মানুষের ইন্টারনেট জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়েছে। যারা মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের প্রকৃত ব্যবহারকারী তাঁদের একটি চিত্ররেখা যদি তৈরি করা যায় তাহলে দেখা যাবে, দেশব্যাপী আন্তঃব্যক্তি যোগাযোগ থেকে শুরু করে, দেশ পরিচালনা, টাকা পয়সা লেন-দেন, ছবি তোলা ও পাঠানো, সামাজিক যোগাযোগের ব্যবহার, ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিক্ষা ও আয়ের পথ খুঁজে নেয়া নানা রকম সম্পৃক্তি ঘটেছে যা এরকম ছোট পরিসরে উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। এর ফলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সত্যিই প্রযুক্তি যুগের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে যা সারা দেশের মানুষকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করতে পেরেছে। এই আন্দোলনের ফলে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের মনোজাগতিক ও সাংস্কৃতিক জগত নির্মাণে, যার অনিবার্য পরিণতি অর্থনৈতিক মানের উন্নয়ন। দেশের মানুষ একটি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। এই পরিবর্তন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বে কি প্রভাব ফেলছে তা গবেষণার বিষয় হলেও এ কথা তো স্বীকার করতেই হবেÑ সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে এত বড় আন্দোলন সংগঠন সম্ভব হতো না। সরকারের নানা রকম নীতিমালা আর উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বেসরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই আন্দোলন সফল হতে চলেছে। দেশ বিদেশের নানা পর্যবেক্ষণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ডিজিটাল আন্দোলনের সাফল্যের খবর প্রকাশ হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে ও তথ্য প্রযুক্তির প্রভাবে এ দেশের সমাজ অর্থনীতির কোন ক্ষেত্রে কি কি অর্জন তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। এমন কি কোন কোন দেশ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের দেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে ইতোমধ্যেই হাত দিয়েছে। মহাকালের কাগজে বাংলাদেশের এই আন্দোলন কেমন করে একটি জাতির ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে একদিন তা প্রকাশিত হবে। যে অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ এই প্রতিশ্রুতিতে এগিয়েছিল তার যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হবে। এক দশক একটি পশ্চাৎপদ জাতির প্রযুক্তি সম্পৃক্ত হয়ে সম্পূর্ণ পরিণতির দিকে যেতে যথেষ্ট নয়। মালয়েশিয়ার লেগেছিল কুড়ি বছর যদিও তা সরকারের উন্নয়ন দর্শনের প্রধান অংশ ছিল না। ইউরোপ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তথ্য-প্রযুক্তিকে ‘উন্নয়ন-সহায়ক’ হিসেবে বিবেচনা করে এগিয়েছে কারণ এসব দেশ উন্নত বিশ্বের সব সুবিধা মোটামুটি আশির দশক থেকেই অর্জন করে নিয়েছিল ফলে তথ্য প্রযুক্তিকে এরা কখনও জীবন দর্শনের অঙ্গীভূত করার কথা ভাবেনি। যদিও তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার অগ্রণী ভূমিকা ছিল কিন্তু গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে অনেক উন্নত দেশ অনুন্নত দেশের মেধা ও উদ্ভাবনের সুবিধা নিয়েছে বেশি বা এখনও নিচ্ছে। আজ যে আমরা ভার্চুয়াল জগতের সাক্ষাত পাচ্ছি তার অধিকাংশই বাংলাদেশের মতো দেশের মেধাসম্পদ দিয়ে উদ্ভাবিত ও সংগঠিত। উন্নত দেশগুলো শুধু পুঁজির বিনিয়োগ করে সেসবের বিকাশ করে নিচ্ছে নিজেদের লাভালাভের জন্য। বাংলাদেশের জনগণের ভাবাদর্শে মুক্তিযুদ্ধ একটি সফল আন্দোলিত প্রেরণা হিসেবে কাজ করে যা আমরা ধারণ করি আমাদের চেতনায়। বাঙালীর আবেগ মূলত ৩টি এরকম একীভূত প্রেরণায় গেঁথে গেছে- রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ। এই তিনটি প্রেরণা নিয়েই বাংলাদেশে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলার চূড়ান্ত অনুধাবন তৈরি হয়েছে বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার হাত ধরে। ফলে এই সোনার বাংলা হতে যাচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক এক মানবিক রাষ্ট্র যার সংগঠন প্রক্রিয়া অপরাপর উন্নত দেশগুলো থেকে অনেক বেশি পৃথক। উন্নয়ন ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল যে মাত্র দশ বছরের শাসন ব্যবস্থায় কোন দেশ তার মাথাপিছু আয় তিনগুণ করতে সমর্থ হয়েছে বা দেশের প্রায় সব মানুষের কাছে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সবগুলো সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছে। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের যে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়েছে তার সুবিধা দেশের উন্নয়নের জন্যে পরিপূরক রাখতে এই আন্দোলন আরও এক দশক অন্তত অব্যাহত থাকা চাই। যে কোন উন্নয়নের মতোই প্রধান তিনটি ধাপ-চিন্তা, প্রয়োগ ও সাফল্য-লক্ষ্য অনুসরণ করে আমরা এখন এগিয়ে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তা জন-সম্পৃক্ত থাকতেই হবে। আর তার সুফল পাবে পরের প্রজন্ম। ভোটের হিসেবে যে সরকারই আসুক দেশের এই মূল আন্দোলন থেকে কোনভাবেই বিচ্যুত হওয়া যাবে না। এখনও পর্যন্ত শেখ হাসিনার এই ডিজিটাল সম্পৃক্তির আন্দোলন দর্শন বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হয়ে আছে যার চূড়ান্ত পরিণতি ধীরে ধীরে একটি মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণ দর্শনে রূপান্তরিত হচ্ছে, আমাদের উচিত তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা ও অংশীদার থাকা। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×