ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গলে পা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

মঙ্গলে পা

অবশেষে মানুষের স্বপ্ন বুঝি পূরণ হতে চলেছে। রক্তিম রঙের গ্রহ মঙ্গলের বুকে পা রাখতে সমর্থ হয়েছে মনুষ্যনির্মিত রোবটযান ইনসাইট। বহু প্রসিদ্ধ বাঙালী কবি একদা হাহাকার করে লিখেছিলেন, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে? ...’ সেই আপ্তবাক্য যে এমন আমোঘ ও ফলদায়ী হয়ে উঠবে অচিরেই, তা বোধকরি কবিও কল্পনা করতে পারেননি। পৃথিবী যে ক্রমশ উত্তপ্ত ও বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠবে তা সুস্থ মন ও মস্তিষ্কে কে ভাবতে চায়? তবে বাস্তবে সেটাই ঘটতে চলেছে যেন। উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরুতে ওজোন স্তরের ক্রমাগত ক্ষয়ের কারণে ভূম-ল ইতোমধ্যেই উত্তপ্ত ও মরুভূমি সদৃশ হয়ে উঠেছে। যার অনিবার্য পরিণতি আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা ও মরুপ্রবণতা, তীব্র তুষারপাত, ঝড়Ñঝঞ্ঝা-শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা সর্বোপরি হিমবাহের গলন। এর পাশাপাশি প্রায় নিয়মিত যুদ্ধবিগ্রহ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, অশান্তি-বিরোধ, হানাহানি ইত্যাদি তো আছেই। তদুপরি তীব্র সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ। যে কারণে বিজ্ঞানীদের ভাবনা, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে নিজের সমাজসভ্যতা ও কৃষ্টিকে নিরাপদ এবং বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য ভিন্ন কোন গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন করতে হবে। আর বর্তমান পৃথিবীর উপযোগী আবহাওয়া ও ভূ-আনুকূল্য বিবেচনায় সৌরজগতের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত গ্রহটি হলো লাল সদৃশ মঙ্গল। আর সে কারণেই বহু বাছবিচার, বহু গবেষণা ও অনুসন্ধিৎসা শেষে মানুষের মঙ্গল অভিযান। অবশ্য কাজটি মোটেও সুগম ও সহজসাধ্য ছিল না। প্রথমত মঙ্গলের দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৪৮ দশমিক ৬ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলের বুকে পা রাখা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। চলতি বছরের ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যানডেনবার্গ বিমান ঘাঁটি থেকে যাত্রা শুরু করে রোবট ইনসাইট। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২৬ নবেম্বর মঙ্গলের মাটিতে অবতরণে সক্ষম হয় রোবটযানটি। নাসা জানিয়েছে, গ্রিনিচ মান সময় সোমবার রাত ৭টা ৫৩ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ১টা ৫৩ মিনিট) মঙ্গলে নামে ইনসাইট। অবতরণের পরপরই নাসার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সেলফি তুলে পাঠিয়েছে রোবটটি। সর্বোপরি নুড়ি পাথরভর্তি এলাকার পরিবর্তে বিজ্ঞানীদের কাক্সিক্ষত ধূলিধূসর প্রান্তরে অবতরণে সক্ষম হয়েছে যানটি। অতঃপর ইনসাইট যেসব কাজ করবে তা হলো, মঙ্গলপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, অনুরণন, কম্পনের মতো অত্যাবশ্যক লক্ষণসমূহের পরিমাপ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ এবং সেসব পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রেরণ। ছবি ও তথ্য পাঠানোর পাশাপাশি ইনসাইটের দ্বিতীয় মুখ্য কাজ হবে নিজের সোলার প্যানেলটিকে সক্রিয় করে তোলা। তাহলে রোবটিক দীর্ঘদিন সক্রিয় ও কর্মক্ষম থাকতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে নাসা মঙ্গলের মাটিতে রোবট নামানোর জন্য অন্তত অর্ধডজন প্রকল্প গ্রহণ করলেও প্রতিবারই তা সফল অবতরণে ব্যর্থ হয়। সেই হিসেবে রোবট ইনসাইট হলো মঙ্গলের বুকে প্রথম অবতরণকারী এলিট ক্লাবের সদস্য রোবটযান। ইনসাইটের সফল অবতরণে বিজ্ঞানী মহল স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে একটি মাইলফলকও বটে। চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখে নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, মানবসভ্যতা ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এটি একটি মাইলফলক নিঃসন্দেহ। সেক্ষেত্রে মঙ্গলের মাটিতে পা রাখাকে কি অভিধায় অভিহিত করা সমীচীন হবে? মনে হয়, কোন অভিধাই এর জন্য যথেষ্ট ও উপযুক্ত নয়। কেননা, বিজ্ঞান ও মানুষের সম্ভাবনা অসীম ও অন্তহীন। তাকে কোন পরিসীমায় বেঁধে ফেলা যায় না। পৃথিবী লয়প্রাপ্ত হলে মানুষ সভ্যতা স্থানান্তরে উদগ্রীব হবে, সেটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। সে ক্ষেত্রে মঙ্গল হতে পারে মানুষের প্রথম পছন্দ।
×