ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতায় সমরেশ মজুমদার

’৪৭ পরবর্তী বাঙালীর অভ্যুত্থান নিয়ে উপন্যাস লিখব

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

’৪৭ পরবর্তী বাঙালীর অভ্যুত্থান নিয়ে উপন্যাস লিখব

মনোয়ার হোসেন ॥ আমার পরবর্তী লেখার বিষয় হবে দেশভাগ থেকে বাঙালীর অভ্যুত্থান। ত্রিশ বছর ধরে এই উপন্যাসটি লেখার কথা ভাবছি। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট শুরু হবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের বিকেল থেকে। দেশভাগের বেদনাত্মক আখ্যানের মাধ্যমে সূচনা হবে কাহিনীর। যখন ভারতবর্ষ বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সৃষ্টি হলো। জন্ম হলো পূর্ব পাকিস্তানের। আর উপন্যাসের শেষ হবে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বরের বাংলাদেশ স্বাধীনের বিকেলের গল্প দিয়ে। এ উপন্যাসের মধ্য আমিই একইসঙ্গে দেশভাগ ও বাঙালীর অভ্যুত্থানের গল্প বলব পাঠককে। দেশভাগ ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে রচিত হবে নতুন আখ্যান। এভাবেই মন্ত্রমুগ্ধ অনুরাগীদের নিজের পরবর্তী লেখার গল্পটি মেলে ধরলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজমুদার। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার আড্ডায় বললেন ব্যক্তিজীবন থেকে সাহিত্যজীবনের নানা কথা। সেই সূত্র ধরে উঠে এলো ভারতীয় এই কথাশিল্পীর জীবনের কঠিন বাস্তবতার কথা। বলেছেন নিজের সৃষ্ট পাঠকের আদর্শে পরিণত হওয়া চরিত্র নিয়ে। লেখার মতোই লেখকের কথাতেও অনুরাগীরা হয়েছেন মোহাবিষ্ট। চমৎকার করে বলে যাওয়া কথার মাঝে ছিল রসিকতা। সব মিলিয়ে পাঠক ও ভক্তরা জেনে নিলেন ব্যক্তি সমরেশ মজমুদার থেকে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারকে। লেখকের কাছ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছেন ছুঁড়ে দেয়া প্রশ্নের উত্তর। শনিবার সকালে সমরেশ মজুমদারের কথোপকথনে অনুষ্ঠিত ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শীর্ষক আলাপচারিতা। রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অষ্টমতলায় উন্মুক্ত এ আলাপচারিতার আয়োজন করেন বই বিতান বাতিঘর। আলাপচারিতা শুরুর আধা ঘণ্টা আগেই অনুরাগীদের আগমনে পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাতিঘরের পুরোটাই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যত মানুষ ভেতরে ছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ ফিরে গেছেন জায়গা না পেয়ে। সাহিত্যরসিকের এমন টইটুম্বুর উপস্থিতিতে একইসঙ্গে আপ্লুত ও মুগ্ধ হয়েছেন সমরেশ মজুমদার। সেই ভাললাগা থেকে বললেন, আপ্লুত বললেও বোধহয় কম বলা হবে। এখানে এসে, এত মানুষের মুখোমুখি বসে যেন নতুন এক জীবন খুঁজে পেলাম। আলাপচারিতার শুরুতেই লেখক ফিরে যান তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুই বছর আগের এক কঠিন বাস্তবতায়। সে প্রসঙ্গে বলেন, ঘটানাটা দুই বছর আগের। লেখালেখি শেষ করে ঘুমাতে গেলাম রাতের বেলায়। এরপর ঘুম ভাঙার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বিছানায়। যখন স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে আমার। কোন কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। চিকিৎসকরা জানালেন, আমি আমার সবকিছুই ভুলে গেছি। এমনকি নিজের নামটাও। চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরার পরে আমার হাতে ‘বর্ণপরিচয়’ বইয়ের সঙ্গে একটি স্লেট তুলে দেয়া হয়। যার মাধ্যমে আমি নতুন করে অ আ থেকে এ বি সি শিখতে শুরু করলাম। প্রথমেই নিজের নাম মনে পড়ল। এরপর ধীরে ধীরে মনে পড়তে শুরু করল সবকিছু। ঘটনার পরম্পরায় লেখক বলে যান, একসময় চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন আমি আর লিখতে পারব না। কিন্তু তাদের সে শঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে আমি আবারও লিখতেন শুরু করলাম। এভাবেই আমার দ্বিতীয় লেখক জীবনের শুরু হলো। প্রথমদিকে আমি ফুলস্কেপ কাগজে প্রতিটি লাইনে ১২টি করে শব্দ লিখতাম। অসুস্থতার পরে যখন লেখা শুরু করি, তখন ৮ থেকে ১০ শব্দ করে ছয় লাইনের বেশি লিখতে পারিনি। আস্তে আস্তে লাইনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অসুস্থ হওয়ার আগে আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যায় আমার একটি উপন্যাস লেখার কথা ছিল। অনিশ্চিত হয়ে যাওয়া সেই উপন্যাসটি দিয়েই আমি আবার ফিরে এলাম পাঠকের কাছে। এখন আর কষ্ট হয় না লেখার সময়। দীর্ঘ ২৩ বছর পর বর্তমানে দেশ পত্রিকায় একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছি। কেমন করে একজন লেখক প্রবেশ করেন তার গল্পেÑ এ বিষয়ে সমরেশ বলেন, প্রথমে কিছুটা লিখতে শুরু করি। এরপর খুঁজে পাই গল্প। প্রস্তুতি নিয়ে লেখা যায় না। ওটা সহজাতভাবেই আসে। লিখতে লিখতে লেখকের কলম খুঁজে নেয় তার গন্তব্য। শৈশব-কৈশোরে কখনও লেখক হওয়ার চিন্তা ছিল না সমরেশের মাথায়। সে প্রসঙ্গে বলেন, মঞ্চনাটকের প্রতি আমার টান ছিল প্রবল। পাড়ার একটি নাট্যদলে যুক্ত ছিলাম। ওই দলটির একটি নাটকের জন্য চিত্রনাট্য রচনার মাধ্যমে আমার প্রথম গল্প লেখার শুরু। যার নাম ছিল ‘অন্তর আত্মা’। পরে মঞ্চদলটি গল্পটি নিয়ে নাটক না করায় সেটি পাঠিয়ে দেই দেশ পত্রিকায়। প্রথমে অবশ্য সেটি ছাপানো হয়নি। এরপর আমার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল করকে ফোন করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলাম। অবশেষে কাগজে গল্পটা ছাপা হলো। ওই গল্পের জন্য আমাকে ১৫ টাকা দেয়া হলে বন্ধুটা মিলে টাকাটা উড়িয়ে দিলাম। আর ওই ফাউ খাওয়ার লোভে বন্ধু আমাকে আবারও লিখতে বলল। সেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর লোভ থেকেই আমার সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হলো। দীর্ঘ আলাপে বারবার উঠে আসে সমরেশের উপন্যাস-ত্রয়ী ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ প্রসঙ্গ। উপন্যাস-ত্রয়ী নিয়ে তিনি বলেন, এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লিখিনি। কিছু লিখতে হবেÑ সেই ভাবনা থেকে লিখেছি। উত্তরাধিকার প্রকাশের পর পাঠকদের তুমুল আগ্রহ আর প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে লেখা হলো বাকি দুই পব। আলোচনায় উঠে আসে লেখকের পাঠকনন্দিত উপন্যাস ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলি চরিত্র সৃষ্টির নেপথ্য কথা। বলেন, আমার বাড়ির পাশে বারো বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের দিন সকালে সে আমার হাত ধরে বলেছিল, কাকু, আমাকে বাঁচাও। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন ওই মেয়ের বিয়ে ঠেকাতে পারিনি। তবে বিয়ের আটদিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, কাকু, আমি বেঁচে গেলাম। ওই ঘটনা থেকেই তৈরি হলো দীপাবলি চরিত্রটি। নিজের জীবনে দীপাবলির মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কতটা মেনে নিতেনÑ অনুরাগীদের ছুঁড়ে দেয়া এ প্রশ্নের জবাবে সমরেশ বলেন, আমরা পুরুষরা মেয়েদের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করি। ছোটবেলা মা আর বড়বেলায় স্ত্রী। কাপড় ইস্ত্রি থেকে তিন বেলার খাওয়ারÑ সব কিছুতেই নির্ভর করি নারীদের ওপর। কিন্তু দীপাবলি তেমন ধরনের মেয়ে না। আমাদের সমাজ বাস্তবতায় তাই কোন পুরুষই দীপাবলিকে পছন্দ করলেও স্ত্রী হিসেবে চান না। আর মেয়েরা তাকে জীবনের আদর্শ মনে করে। এটাই এ চরিত্রের সার্থকতা। পাঠককে মোহাবিষ্ট করা সমরেশ মজুমদারের আরেক চরিত্র অনিমেষ। লেখকের প্রতি এক ভক্তের প্রশ্ন ছিলÑ আপনি কি কখনও অনিমেষ হতে চান? সোজসাপটা জবা দেন, আমি কখনও অনিমেষ হতে চাই না। অনিমেষের একটা পায়ে পুলিশ গুলি করে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছিল। তাই আমি অনিমেষ হতে চাই না, তার ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চাই। এক পাঠক জানতে চাইলেন আত্মজীবনী প্রসঙ্গে। রসিকতামাখা লেখকের জবাবটা ছিল এ রকমÑ আত্মজীবনী লিখলে ঘরে এবং বাইরে শত্রু তৈরি হবে। আমার সংসারটাও হয়তো টিকব না। তাই আমার দ্বারা এ কুকর্ম সম্ভব হবে না। অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের স্বাগত জানান বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাস। উপস্থিত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। সব শেষে তিনি বলেন, ঔপন্যাসিকরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী। তারা কোটি কোটি পৃষ্ঠা জুড়ে যা লেখেন, তার একটিও সত্য নয়। কিন্তু এর ভেতরটা সত্য, স্বপ্নটা সত্য। যার প্রমাণ সমরেশ মজুমদার ও তার ভক্তরা।
×