ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বীরপ্রতীক তারামন বিবির ইন্তেকাল

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

বীরপ্রতীক তারামন বিবির ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ ’৭১-এর রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধে বীরপ্রতীক তারামন বিবি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর। শনিবার রাত দেড়টার দিকে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়ায় তার নিজ বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারামন বিবি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট রোগে ভুগছিলেন। তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ নবেম্বর কুড়িগ্রামের রাজীবপুর থেকে ময়মনসিংহ সিএমএইচে (সেনা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকদের পরামর্শে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে শারীরিক কিছুটা উন্নতি হলে এক সপ্তাহ আগে তিনি রাজিবপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে বীর প্রতীক তারামন বিবির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেলোয়ার হোসেন বাড়িতেই তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন। পরে রাত দেড়টার দিকে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় এবং তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। শনিবার দুপুর ২টার দিকে রাজিবপুর উপজেলা পরিষদ মাঠে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অর্নার প্রদান করা হয়। পরে ওই মাঠেই দুপুর আড়াইটায় জানাজা শেষে এই বীর প্রতীককে রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া গ্রামে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ সময় বীর প্রতীক তারামন বিবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানান কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন, পুলিশ সুপার মেহেদুল করিম, রাজিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীর বিক্রম, মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাজ, মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম টুকু, গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার, সাবেক এমপি জাকির হোসেনসহ স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বীর প্রতীক তারামন বিবির পুত্র আবু তাহের জানান, আমার মায়ের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। সরকার সবসময় আমার মায়ের ও পরিবারের পাশে ছিল। মা মারা যাওয়ার পরও যেন সরকার আমাদের পরিবারের প্রতি লক্ষ্য রাখে সেই প্রত্যাশা করি। মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাজ বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারামন বিবির অকাল মৃত্যুতে শোকাহত। যদিও তারামন বিবির মৃত্যু হয়েছে আমি মনে করি বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে তিনিও ততদিন বেঁচে থাকবেন। তারামন বিবির সহযোদ্ধা শওকত আলী বীর বিক্রম জানান, তারামন বিবি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। সে অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অনেক খবর সংগ্রহ করাসহ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা একজন বীর সেনাকে হারালাম। জানা গেছে, তারামনের বয়স ১৬ বছর তখন তিনি ১১নং সেক্টরে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী অঞ্চল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের টু এম এফ কোম্পানির বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মুহিব রৌমারী থানার কোদালকাঠিতে যুদ্ধরত ছিলেন। তারই অধীনে তারামন প্রথমে একটি ক্যাম্পে কাজের মেয়ে হিসেবে যোগ দেন। পরে অংশ নেন সশস্ত্র সংগ্রামে। ক্যাম্পে কাজ করতে করতে এক সময় তারামন অস্ত্র চালনা শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হাবিলদার মুহিব তাকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও স্টেনগান চালনা শেখান। অল্প দিনেই তিনি অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরবর্তীকালে হঠাৎ একদিন কোদালকাঠি এলাকায় পাকসেনারা আক্রমণ করলে অন্যদের সঙ্গে তারামন বিবিও সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। এছাড়া তিনি গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। তারামন বিবি যুদ্ধকালে তার কাজ ছিল শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা, খবরাখবর সংগ্রহ করা এবং তা নিজ ক্যাম্পে এসে জানানো। বহুবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে তারামনকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়। পরে সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেয়া হয়। অবশ্য স্বাধীনতার ২৪ বছর পর ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের সহোযোগী অধ্যাপক বিমলকান্তি দে মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করার পর্যায়ে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে যান। নারী মুক্তিযোদ্ধা মহীয়সী তারামন বিবি বীর প্রতীক ও তার পরিবার সদস্যদের সন্ধান পান। তারপর ইতিহাস হয়ে যান তারামন বিবি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশে যে দু’জন নারী মক্তিযোদ্ধাকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হয়েছে তারামন বিবি তার একজন। ১৯৯৯ সালের ২ অক্টোবর তিনি জনকণ্ঠ সম্মাননায় ভূষিত হন। রাষ্ট্রপতির শোক ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন। শনিবার এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, জাতি এবং স্বাধীনতা প্রিয় জনগণ চিরকাল তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আবদুল হামিদ মরহুমার রুহের শান্তি ও মুক্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক তারামন বিবির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবির অসামান্য অবদান গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে তারামন বিবি অস্ত্র হাতে নিয়ে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার সেই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তার রুহের শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করেন এবং তারামন বিবির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম পৃথকভাবে তারামন বিবির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
×