বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কেন্দ্রের কঠোর হুঁশিয়ারি। আজীবন বহিষ্কারের খড়গ। তবুও জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ হয়ে পড়ছে। দলের হাইকমান্ডের কঠোর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিভিন্ন আসনে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মনোনয়নবঞ্চিত অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচনী মাসে কিছুটা হলেও বিব্রত অবস্থায় পড়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। তবে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের কর্মকা-ের ওপর তীক্ষè নজরদারি করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র ২৮দিন বাকি। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ চার সহস্রাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে থেকে প্রায় ২৩১টি আসনে দল মনোনীত প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক নৌকা বরাদ্দ দিয়ে চিঠি দিয়েছে। এতে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপে সংঘর্ষ, সড়ক অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর এমনকি গুলিবর্ষণের ঘটনাও পর্যন্ত ঘটেছে। অনেক আসনেই মনোনয়ন বঞ্চিতরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। অসংখ্য আসনেই নির্বাচনের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াত তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে থাকলেও এসব আসনে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এ সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে তারা।
তবে বিষয়গুলো তীক্ষè নজরদারি করছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী কিংবা সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িত, তাদের তালিকা তৈরি করে নির্বাচনের আগেই জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পথে যাচ্ছে দলটি। জানা গেছে, কেন্দ্র থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। যারা দলের টিকেট পেয়েছেন তারাও বিদ্রোহীদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। তবে দলের হাইকমান্ড হিসেবে কষছেন মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে কতজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। কোন পদ্ধতিতে তাদের বসিয়ে একক প্রার্থী রাখা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন দাখিলকারী একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হলে তারা নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রকাশ করতে নারাজ। তাদের মতে, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার সবার রয়েছে। আমরা আশা করি পুনরায় মাঠ জরিপের মাধ্যমে সত্যিকারের জনপ্রিয় নেতাদের বেছে নিতে প্রার্থিতা মনোনয়নের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে। আগামী ৯ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। সুতরাং এর আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার দাবি বিদ্রোহীদের।
এদিকে মনোনয়ন বঞ্চিত অনেক নেতাই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। তবে দলের সভাপতি সবাইকে বুঝিয়ে আগামী চ্যালেঞ্জের নির্বাচনের কথা বিবেচনা করে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নৌকা মার্কার পক্ষে কাজ করতে বলেছেন। সেখান থেকে অনেকেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও এখনও কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে এখনও রয়েই গেছেন। তবে ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে দলের সংসদীয় বোর্ডের একাধিক নেতা জানান, এখনও দল ও মহাজোটের একক চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়নি। দলে মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সবদিক বিবেচনা করে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সবাইকে তার পক্ষেই একাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে। এবার এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত কঠোর অবস্থানে থাকবে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের কাউকেই এক চুল ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা দল মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করছে বা করবেন, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে তাদের একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বোঝানোর পরও আয়ত্বে আনতে না পারলে নির্বাচনের আগেই তাদের দল থেকে আজীবন বহিষ্কারসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে দলটির সিনিয়র নেতারা আশাবাদী, আগামী ৯ ডিসেম্বরের আগেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দেশ, আওয়ামী লীগ ও উন্নয়নের স্বার্থে সব বিদ্রোহীরা নিজেদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়ে দল মনোনীত প্রার্থী অর্থাৎ নৌকার বিজয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী মাঠে নামবেন। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগে নিশ্চিত করে বলা যাবে না, কে বিদ্রোহী প্রার্থী। তবে এবারে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত পরিষ্কার ও কঠোর। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত কেউ অমান্য করলে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। আগের মতো বহিষ্কৃত কোন নেতাকে আর কোনদিন দলে ফিরিয়ে নেয়া হবে না।
দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ইতোমধ্যে যেসব আসনে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছে, সেসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝিয়ে তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হচ্ছে। কেন তারা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন, কেন দল সবদিক বিবেচনা করে যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে- সেসব কথাও বলা হচ্ছে। একইসঙ্গে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে কপালে কী শাস্তি অপেক্ষা করছে, সেটিও বিদ্রোহীদের কড়া সুরেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। সূত্রটি জানায়, সবকিছু বোঝানোর পর অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীই তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করছেন। এ প্রক্রিয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, ৯ ডিসেম্বরের আগেই সব বিদ্রোহী প্রার্থী তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়ে নৌকার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী যুদ্ধে মাঠে নামবেন।
বিভিন্ন আসনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন শ’ আসনের মধ্যে এখনও প্রায় অর্ধশতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি কেন্দ্র কিছু আসনে প্রার্থী রদবদল করে, মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে সেজন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মনোনয়ন দাখিল করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- নওগাঁ-২ ড. ইঞ্জিনিয়ার আখতারুল আলম, নওগাঁ-৪ এ্যাডভোকেট আব্দুল বাকী ও আফজাল হোসেন, নওগাঁ-৬ আনোয়ার হোসেন হেলাল, বগুড়া-২ মেস্তাফিজার রহমান মোস্তা ও আবুল কাশেম ফকির, বগুড়া-৪ কামাল উদ্দিন কবিরাজ ও অধ্যাপক আহছানুল হক, বগুড়া-৫ তাহরিনা জামান হিমিকা রাজশাহী-৫ ওবায়দুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, দিনাজপুর-২ আসনে মানবেন্দ্র রায়, কুড়িগ্রাম-১ আসনে ওসমান গণি, মেহেরপুর-১ আসনে এ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী, জয়নাল আবেদীন, প্রফেসর আবদুল মান্নান, যশোর-২ আসনে মনিরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা-১ আসনে ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, সরদার মুজিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে কাউসার আহমেদ পলাশ, ফেনী-৩ আসনে আবুল বাশার, হাজী রহিম উল্যাহ, কুমিল্লা-২ আসনে অধ্যক্ষ আবদুল মজিদ, চট্টগ্রাম-২ আসনে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, বরিশাল-২ আসনে একে ফয়জুল হক রাজু, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে মতিউর রহমান, ময়মনসিংহ-৩ আসনে ড. অধ্যক্ষ একেএম আবদুর রফিক, ময়মনসিংহ-১০ আসনে ওবায়দুল্লাহ আনোয়ার বুলবুল, নেত্রকোনা-১ আসনে মোসতাক আহমেদ রুহী, নেত্রকোনা-৪ আসনে শফী আহমেদ প্রমুখ।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে মনোনয়ন বঞ্চিতরা ॥ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে একটি টিম কাজ করবে। এ টিম দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তিন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এ টিমে অন্য যারা রয়েছেন তারা হলেন- যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, বিএম মোজাম্মেল হক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সাত্তার, উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এদের মধ্যে বর্তমান সংসদের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বাহাউদ্দিন নাছিম ও বিএম মোজাম্মেল হককে এবার মনোনয়ন দেয়া হয়নি। আহমদ হোসেন ও আফজাল হোসেনও মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তারাও মনোনয়ন বঞ্চিত।
এ বিষয় শনিবার সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে একটি টিম সার্বক্ষণিক কাজ করবে। তারা নির্বাচন করছেন না। তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) আক্ষেপ নির্বাচনের সময় সব নেতাই ঢাকার বাইরে চলে যান। হেডকোয়ার্টারে কেউ থাকেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি ভারতেও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একটি অংশকে হেডকোয়ার্টারে রেখে দেয়া হয়। এজন্য আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে রাখা হয়েছে। শক্তিশালী একটি টিম কেন্দ্রে থাকবে, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজ করবে। এতে হেডকোয়ার্টারে নেতৃত্বের ঘাটতির পূরণ হবে। আমিও মাঝে মাঝে আসব।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: