ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতের উপহার ॥ গল্প

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

শীতের উপহার ॥ গল্প

স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তাই আর স্কুলে যেতে হয় না ছোঁয়াকে। এ বছর বই মেলায় কেনা যত গল্পের বই ছিল সেসব তো অনেক আগেই পড়া শেষ হয়ে গেছে। গতবার বার্ষিক পরীক্ষায় একটু রেজাল্ট খারাপ হয়ে গিয়েছিল ছোঁয়ার। বাবা বলেছিলেন, একেবারে বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আবারও নতুন গল্পের বই কিনে দেবেন। এ বছর আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে ওকে। পরীক্ষা তো গত সপ্তাহেই শেষ। অফিসের কাজের চাপে প্রতিদিনই দেরি করে বাসায় ফিরছেন বাবা। মেয়ের জন্য যে একটু সময় বের করে মেয়েকে নিয়ে গিয়ে পছন্দের বইগুলো কিনে দেবেন, সেই সময়টা হচ্ছে না তার। সারাক্ষণ একা একা টিভি দেখে আর কম্পিউটারে গেম খেলেই সময় পার করতে হচ্ছে ছোঁয়াকে। এদিকে দাদিও গ্রামের বাড়ি থেকে বার বার ফোন করে বেড়াতে যেতে বলছেন সবাইকে। ছোঁয়ারও এইবার পরীক্ষা শেষে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। নাহ, এভাবে আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছে মন। তাই আজ মা-বাবা অফিস থেকে ফেরার পর গ্রামে যাওয়ার ব্যাপারে খুব জোর দিয়ে ধরবে বলে ঠিক করলো ছোঁয়া। সন্ধ্যার একটু আগে আগে বাসায় ফিরলেন মা। বাবার এখনও আসতে কিছুটা সময় দেরি হবে। চুপচাপ টিভির সামনে বসে বাবার জন্যই অপেক্ষা করছে ছোঁয়া। বাবা ফেরার পর প্রতিদিনের মতোই একসঙ্গে খেতে বসল তিনজন। খেতে খেতে ছোঁয়া তার প্ল্যান মতো গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা উঠাল। খুব জোর দিয়ে বাবাকে বলল, এবারের ছুটিতে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে। বছর ঘুরলেই ক্লাস এইটে উঠবে সে। জেএসসি পরীক্ষার জন্য পড়ার অনেক চাপ থাকবে তখন। কাজেই এই ছুটিতে না গেলে সামনের বছরও আর যাওয়া হবে না। এদিকে বাবা তো অফিসের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু মেয়ের যুক্তিটাও ফেলে দিতে পারছেন না। ছোঁয়ার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তুমি কি পারবে অফিস থেকে শুক্র আর শনিবার মিলিয়ে বাড়তি দুইদিন ছুটি নিয়ে মেয়েকে গ্রাম থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে? ছোঁয়ার মা উত্তর দিলেন, আচ্ছা আগামীকাল অফিসে গিয়ে দেখি পারি কিনা। এখন আর কোন কথা নয়। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর সবাই। খাওয়া শেষ করে ছোঁয়া নিজের ঘরে চলে গেল। পরেরদিন সকালে প্রতিদিনের মতোই মা-বাবা দুজনেই অফিসে চলে গেলেন। আর সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর সারাদিন মায়ের জন্য অপেক্ষা করে করে কাটাল ছোঁয়া। মা আসলেই জানা যাবে গ্রামের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে কি না! সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলেন মা। ঘরে ঢুকতেই মাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছোঁয়া, ছুটি কি পেয়েছ মা? -হ্যাঁ, এ বছর তো কোন ছুটি নেইনি। তাই খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। আগামী বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনেই রওনা হচ্ছি আমরা। তোমার বাবাকে বলেছি টিকেট কেটে নিয়ে আসার জন্য। বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেনে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল ছোঁয়া আর ওর মা। বাবা ওদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। ট্রেনের জানালার পাশের সিটটায় বসেছে ছোঁয়া। জানালার গ্লাসের ভেতর দিয়েই চাঁদের আলোতে বাইরের দৃশ্যগুলো দেখছে সে। বাইরে প্রচ- শীত, ঠা-া লেগে যাওয়ার ভয়ে মা কিছুতেই ওকে জানালার গ্লাস খুলতে দেননি। মাঝরাতে একটা নীরব স্টেশনে এসে দাঁড়াল ট্রেনটা। এমন সময় ট্রেনের হুঁইসেলের শব্দ পেয়ে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা একটি মেয়ে চকোলেটের একটা প্যাকেট হাতে ছোঁয়াদের কামরায় উঠে আসল। পরনে তার একটা পাতলা জামা। শীতে কাঁপতে কাঁপতেই সে জোরে জোরে কেউ চকোলেট কিনবে কিনা জিজ্ঞাসা করছে। কারোরই তেমন কোন সাড়া না পেয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেল মেয়েটি। হয়ত বুঝতে পেরেছে এই মাঝরাতে কেউ চকোলেট কেনার নেই। তাই সে আবারও আগের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শীত ফেরানোর জন্য তার গায়ে সামান্য একটা কাঁথাও নেই। মেয়েটিকে শীতে কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখে মন খারাপ হয়ে গেল ছোঁয়ার। ওর থেকেও দেখতে ছোট লাগছে মেয়েটিকে। অথচ শীতে কত কস্ট করছে! আর সে শীতের জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বেড়াতে যাচ্ছে। যেন ঠা-া না লেগে যায় আবার এজন্য মা কত খেয়াল রাখছেন! এমনকি দাদিও বার বার করে বলে দিয়েছেন, যাওয়ার সময় ভারি শীতের কাপড় নিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রামে অনেক বেশি শীত। জানালার গ্লাসটা তুলে দিল ছোঁয়া। তড়িঘড়ি করে মা বলতে শুরু করলেন, গ্লাসটা তুললে কেন ছোঁয়া? গ্লাসের ভেতর দিয়েই বাইরের দৃশ্য দেখ। এখনই ট্রেন ছেড়ে দেবে। ঠান্ডা লাগাতে চাও কি তুমি? জ্বর এলে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে পারবে?- সেজন্য না মা। ঐ মেয়েটিকে ডাকবো, তাই গ্লাসটা তুললাম। -কেন চকোলেট কিনবে?-না। দেখ মা, ঠান্ডায় ওর কত কস্ট হচ্ছে! প্রতিদিনই ওকে নিশ্চয় এভাবেই রাত পার করতে হয়। আমি আমার জ্যাকেটটা ওকে উপহার হিসেবে দিতে চাই। আমার ব্যাগে তো আরেকটা জ্যাকেট আছেই, তাই আমারও কোন অসুবিধা হবে না। মেয়ের এমন ভাল কাজে মা আর বাঁধা দিবেন কিভাবে! তাই মা’ও কোন আপত্তি করলেন না। মেয়েটিকে ডাক দিল ছোঁয়া। ডাক শুনে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। বলল, চকোলেট নেবেন? আলত হেসে জবাব দিল ছোঁয়া, না। আমি তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই, নেবে? হকচকিয়ে যাওয়ার মতো করে তাকাল মেয়েটি। বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কি উপহার আর কি জন্য দেবেন? -এখন তো অনেক শীত। তোমার শীতে খুব কস্ট হচ্ছে। তাই আমি তোমাকে আমার জ্যাকেটটা দিতে চাই। কথা বলতে বলতেই গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল ছোঁয়া। এদিকে ছোঁয়ার কান্ড কারখানা কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়েটি। সঙ্কোচ নিয়ে ছোঁয়ার মায়ের দিকে তাকাল সে। মা’ও বিষয়টা বুঝতে পেরে অভয় দিতে বললেন, জ্যাকেটটা নাও মা। আমি কিছুই বলব না। বরং খুশি হব।-কিন্তু আপুর ঠান্ডা লাগলে? -আপুর ব্যাগে আরেকটা জ্যাকেট আছে। তুমি এটা নিলে আপু খুব খুশি হবে। একগাল হাসি দিয়ে জ্যাকেটটা হাতে নিল মেয়েটি। এরপর হুট করে দৌড়ে শোয়ার জায়গায় ফিরে গেল আবার। ট্রেনটাও ছেড়ে দিয়েছে এমন সময়। জানালার গ্লাস নামাতে যাবে ছোঁয়া এমন সময় আবারও দৌড়ে জানালার ওখানে ফিরে আসল মেয়েটি। হাতের মুঠো ভর্তি চকোলেট বাড়িয়ে দিল ছোঁয়ার দিকে। চকোলেটগুলো নিজের হাতে নিয়ে অন্য হাত দিয়ে বিদায় জানাল ছোঁয়া। মেয়েটিও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথমবার আজ কাউকে চোখে মুখে মায়া নিয়ে হাত তুলে বিদায় জানাতে জানাতে বলল, ভাল থাকবেন। ২য় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×