ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাহের ইসলাম

একজন মিতালী চাকমা এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

 একজন মিতালী চাকমা এবং কিছু কথা

স্থানীয় ডিগ্রী কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। দীর্ঘদিন ধরেই তাকে প্রস্তাব দেয়া হচ্ছিল একটি স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেয়ার জন্য। বিগত সময়ে এই সংগঠনটির কিছু কার্যক্রম অনেকের কাছেই দেশ-সমাজ বিরোধী ঠেকেছে। হয়তো সে কারণে মেয়েটি সেই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে। এমনও হতে পারে পড়ার পরে মেয়েটি একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখত। তাই অনিশ্চিত জীবন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায়নি। এমন হতে পারে, পড়ার খরচ যোগাতে বাবা-মা আর বড় বোনের কষ্টের ছবি তার মানসপটে এমনি গ্রোথিত ছিল যে- পড়ালেখার বাইরে অন্য কোন কিছুতে জড়ানো মানেই নিজের দরিদ্র ও সমস্যা জর্জরিত পরিবারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। অথবা বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত উপার্জনে পড়তে এসে লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোন কিছুতে জড়াতে মন সায় দেয়নি। লেখাপড়াকে ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করে সে হয়ত ভেবেছিল, লেখাপড়ার পেছনেই সমস্ত প্রচেষ্টা নিয়োগ করবে- যেন সকলের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। আশা ছিল, তার অর্জনে পিতা-মাতার দুঃখক্লিষ্ট মুখে ফুটবে গর্বের হাসি, গর্বিত হবে ভাই-বোন, সহপাঠীরা, এমনকি এলাকার সকলে। দেশবাসীর কাছে তার নাম কতটা পৌঁছাত সেটা জানা না থাকলেও এলাকাবাসীর কাছে তার নাম এখন পৌঁছে গেছে সেটা নিশ্চিত। গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে কন্যার কল্যাণে তার পিতা-মাতা এখন প্রাণ হারানোর শঙ্কায় ভুগছে। তারা এখন কোথায় আছে কেমন আছে- কেউ জানে না। এতক্ষণ যে মেয়েটির কথা বলছিলাম তার নাম মিতালী চাকমা। রাঙ্গামাটির এক প্রত্যন্ত গ্রামে দুই বোন আর এক ভাইয়ের সংসারে মিতালী মেঝো। সাধ আর সামর্থ্যরে যোজন যোজন দূরত্ব কখনই সন্তানদের উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্প থেকে এই পরিবারের কর্তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বৃষ্টিতে ভেজা চোখের জলের মতোই এই বাস্তবতা পরিবারের বড় মেয়েটি বুঝে ফেলে একটু বড় হওয়ার পরেই। তাই বাবা-মায়ের কাঁধ থেকে সংসারের জোয়ালের ভার কিছুটা হলেও লাঘবের অভিপ্রায়ে সে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে প্রিয় বাবা-মা আর আদরের ছোট ভাই-বোনদের ছেড়ে শহরে ছোটখাটো এক চাকরিতে যোগ দেয়। আর তাদের সকলের অতি আদরের ছোট ভাই এখনও স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেনি। পারিবারিক বন্ধনে ভালবাসায় বেড়ে ওঠা সন্তানদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা আর দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি বাস্তবতার আলোকে কষ্ট আর পরিশ্রমকে সাথী করে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার বহু গল্প হয়ত পাঠকের জানা। সেদিক থেকে মিতালী চাকমাকে নিয়ে কিছু লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে, তার জীবনের ক্যানভাসে কিছু দুর্জনের আঁচড়ের বিভীষিকা এবং আমাদের সামাজের প্রতিক্রিয়ার অসঙ্গতি থেকেই এই লেখার অবতারণা। ২৩ নবেম্বর ২০১৮ খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ের পরেই মিতালী চাকমা আলোচনায়। বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যাবলী থেকে তার অপহরণের ঘটনার পরিষ্কার একটা চিত্র পাওয়া যায়। জানা যায়, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলে যোগ দেয়ার আহ্বান উপেক্ষা করায় ১৭ আগস্ট ২০১৮ তাঁকে অপহরণ করা হয়। এর পরে তাকে আটকে রেখেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। সে রাজি না হলে তাকে স্থানীয় দুই নেতার হাতে তুলে দেয়া হয়। তারপর শুরু হয় অবর্ণনীয় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। তার বিভীষিকাময় জীবনের কিছুটা হলেও উঠে এসেছে, তার কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে, ‘তাদেরকে বলাবলি করতে শুনেছি যে, আমাকে গর্ভবতী না করলে আমি হয়তো ইউপিডিএফ এ যোগ দিতে রাজি হবো না। এমতাবস্থায় গত ৩০/৮/২০১৮ তারিখ হইতে ১৯/১১/২০১৮ তারিখ পর্যন্ত ইউপিডিএফ কর্মীরা আমাকে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার রেপ করে। ইউপিডিএফ (প্রসীত) এর কর্মীদের পাশবিক নির্যাতনে আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও করতে পারি নাই।’ তার কাছ থেকে আরও জানা যায়, তাকে সবসময় দু’জন অস্ত্রসহ পাহারা দিয়ে রাখত, যেন সে পালাতে না পারে। তবে, যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে সেনাবাহিনীর এক টহল দলের আনাগোনা টের পেয়ে অস্ত্রধারীরা সরে পড়ে। এই সুযোগে সে টহল দলের কাছে এসে তার দুর্দশার কথা জানায়। তারা তাকে উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। প্রয়োজনীয় ডাক্তারী পরীক্ষা ও মামলার প্রক্রিয়া শেষ হলেও প্রাণভয়ে সে এখন বাড়িতে ফিরতে পারেনি। সে এখন চিন্তিত, তার বাবা-মাকে এই সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলতে পারে। তার সঙ্গে আরও দু’জন নারী বন্দী ছিল, তাদের উদ্ধারের আবেদনও সে জানিয়েছে। ইউপিডিএফ (প্রসীত) এর পক্ষ থেকে অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করা হয়, তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যেই এমন পরিকল্পিত নাটক সাজানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন দাবির সপক্ষে বেশ কিছু প্রচারণাও করা গেছে। ইতোপূর্বে এক চাকমা নারীকে কোন বাঙালী কর্তৃক ধর্ষণের শুধু অভিযোগ পাওয়ার পর প্রমাণিত হওয়ার আগেই কি পরিমাণ প্রতিবাদ হয়েছিল সেটা বলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ইতি চাকমা নিহতের ঘটনায় দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। কারণ, এমন প্রতিবাদ মিছিল ঢাকার শাহবাগ ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। আর যদি কোনভাবে একটা ধর্ষণের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে আঙ্গুল তোলা যায়, তাহলে কি লঙ্কাকান্ড হতে পারে সেটাও দেশবাসী দেখেছে বিলাইছড়ির দুই মারমা বোনের ঘটনায় দেশের সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীদের হম্বিতম্বি। অথচ, নারীর প্রতি সংবেদনশীল এই মানুষগুলোই আবার একদম চুপ মেরে যান, যদি ধর্ষক খুনী আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ হয়, বা অবাঙালী কেউ হয়। মিতালী চাকমার ঘটনাই তারই প্রমাণ। অপ্রিয় হলেও বলছি, এই বছরের জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ির দুই মারমা বোনের ঘটনা নিয়ে কী না করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ঢাকার সুশীল সমাজের, মানবাধিকারের নেতা-কর্মীরা। দেশের বড় বড় শহরে প্রতিবাদ মিছিল ও মানববন্ধন, শাহবাগে সেনাবাহিনীকে বিদ্রুপ করে আয়োজিত পথনাটক, ব্লগ ও সংবাদপত্রের নারীবাদীদের লেখালেখি, মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি, উদ্বিগ্ন সুশীল সমাজের বিবৃতি, সুপ্রীম কোর্টে কিছু দেশবরেণ্য ব্যক্তির দৌড়াদৌড়ি, ঢাকার বুকে মশাল মিছিল, চাকমা সার্কেল চীফের পতœীদের আবেগঘন মিথ্যাচার, হাসপাতালে পাহারা বসানো ইত্যাদির বাইরে আরও অনেক কিছুই ছিল। অথচ, ঐ সময়ে আবেগে আপ্লুত হওয়া ব্যক্তিবর্গের অনেকেই আজও জানে না যে, এক মিথ্যে অভিযোগকে কেন্দ্র করে কিভাবে তাদের অনুভূতিকে ব্লাকমেল করা হয়েছে। বেশিদিন আগের কথাও নয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাঙামাটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এক নারী নিজের মুখে যা শুনিয়েছে, তা অনেকটাই ভৌতিক সিনেমার কাহিনী বলে মনে হচ্ছিল। ভিন্ন সম্প্রদায়ের একজনকে ভালবেসে বিয়ে করায় জোসনা চাকমাকে দুই মাস হাতে-পায়ে শিকল বেঁধে অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে দিনের পর দিন অমানবিক নির্যাতন করেছিল ইউপিডিএফ। ১৬ জানুয়ারি ২০১৭-এর মধ্যরাতে কোনমতে পালিয়ে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করে নিকটস্থ সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। এরপর সেনাবাহিনী তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। তিন দিন পরে সংবাদ সম্মেলনের সময় বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিল হতভাগা এই নারী। সংবাদ সম্মেলনে সে নিজেই জানায় যে, তার স্বামী বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হলেও শুধু বাঙালী বড়ুয়া সম্প্রদায়ের একজনকে বিয়ে করার অপরাধেই এই নির্মম ও লোমহর্ষক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল। একজন নির্যাতিত নারী প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে তার জীবনের ওপর বয়ে যাওয়া দুর্বিষহ যন্ত্রণা জনান দিলেও এর প্রতিবাদের আওয়াজ দেশের কোন দিক থেকেই শোনা যায় না। এমনকি, কোন নারীবাদী সংগঠন বা মানবাধিকার কমিশন যাদের জেলা অফিস এই রাঙামাটিতেই অবস্থিত- প্রতিবাদ তো দূরের কথা এমন ভয়াবহ এবং গাঁ শিউরে ওঠা ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য হলেও নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। আমাদের সমাজের যে মহীয়সী নারীরা আর কিছু না হলেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে অন্তত কলম দিয়ে যুদ্ধ করেন, তাদের মধ্য হতেও কেউ এই হতভাগার কান্নায় নিদেনপক্ষে সহমর্মিতা পর্যন্ত ব্যক্ত করেননি। রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মানববন্ধনেও দেখা যায়নি কাউকে। নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা আর পাহাড়ের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সকল সময়ে যারা উচ্চকিত তাদের মিতালী চাকমার জন্য কোন ধরনের পদক্ষেপ যেমন চোখে পড়ছে না, তেমনি তাদের এই হতভাগার জন্য বিন্দুমাত্র উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত ঘটনাবলীর প্রতি আমাদের দেশের কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্য কতটা চরম হতে পারে, তার সর্বশেষ উদাহরণ মিতালী চাকমা। যারা এই ধরনের ঘটনায় প্রতিবাদ করেন বা ইতোপূর্বে করেছিলেন তাদের কাউকেই এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তাই, অবধারিতভাবেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়, মিতালী চাকমা কি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে আমাদের ‘সমাজের কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্যের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়ার অসঙ্গতির’ শুধু আরেকটি উদাহরণ হিসেবেই থেকে যাবে? নাকি, প্রতিটি জুম্ম নারীরও যে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার থাকতে পারে তা অন্যরা বিশেষত নারীরা অনুধাবন করবেন? লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
×