ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

যাকে খুশি তাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রার্থীকে ভোট দেব

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১ ডিসেম্বর ২০১৮

 যাকে খুশি তাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রার্থীকে ভোট দেব

কোন এক কালিভোর কাটিয়ে তখনও সূর্য তার মুখ বের করেনি। গ্রামে আমার বন্ধু পরিবারটি তাদের শত শত বছরের বাস্তুভিটা ছেড়ে চলে গেলেন ভারতের উদ্দেশে। ওটাই তাদের নতুন ঠিকানা। পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আযম, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলে দিয়েছেন, হিন্দুঅধ্যুষিত এলাকা হবে হিন্দুস্তান। মুসলিমঅধ্যুষিত অঞ্চল হবে পাকিস্তান। মানে দাঁড়াল ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান। আর তা বাস্তবায়নের জন্য গোটা ভারতবর্ষে দাঙ্গা লাগিয়ে দেয়া হলো। বিশেষ করে কলকাতা এবং পূর্ববাংলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর আধিক্য বিদ্যমান। এভাবে ভারতে মুসলিম পূর্ববাংলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। তারপর শুরু হয় এদেশ-ওদেশ, ওদেশ-এদেশ মাইগ্রেশন এবং এতে সংখ্যালঘুদের হার কমতে কমতে এখন অনেক নিচে। অবশ্য গত দশ বছরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে তো বটেই, সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে গেছে তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাইগ্রেশন কমেছে। অর্থাৎ তাদের পারসেন্টেজ বেড়েছে। তারা রাজনৈতিকভাবে রুখে দাঁড়াতেও শুরু করেছে। এরপরও বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নির্বাচন এলেই একটি অশুভ গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হয়। তারা বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দেয় বলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নৌকায় না দিয়ে ধানের শীষে দিলেও কেউ বিশ্বাস করে না। তাদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়। আর বিএনপির টার্গেট হলো নির্যাতন চালিয়ে হিন্দুদের যত ভারতে পাঠিয়ে ভোট কমানো যাবে ততই আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করা সহজ হবে। তারা আবার মোটামুটি কিছু জঙ্গীও পেয়ে গেছে। যাদের সমাজে মোটামুটি একটা সেক্যুলার ফেস রয়েছে। এতদিন বিএনপি জামায়াত-জঙ্গীদের ফেসটি আড়ালে ছিল, উন্মোচন করতে পারেনি। এখনও সেভাবে পারছে না, কারণ নির্বাচন কমিশন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের উচ্চ আদালতও তাদের বিরুদ্ধে যে মতামত দিয়েছে তাতে তারা প্রকাশ্যে আসতে পারছে না। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায়ে বিএনপিকেও একই কাতারে আবিষ্কার করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রেনেড হামলাটি হাওয়া’ মানে তৎকালীন বিএনপি সরকার সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তারপরও বিএনপি বেপরোয়া। কাগজে দেখলাম, বিএনপি ২৫ জামায়াতী জঙ্গী নেতাকে নমিনেশন দিয়েছে। ইংরেজী ‘ডেইলি স্টার’ (২৯ নবেম্বর ২০১৮) BNP has nominated 25 leaders of Jamat-e-Islami, A key compo neat of the 20 party alliance to contest the up-coming parliamentary polls. We have received 25 nomination letters from the BNP. Matiur Rahman Akhand organi“ing secretary of Jamat told the Daily Star yesterday. জঙ্গী ও জামায়াত এতই বেপরোয়া যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলেও পাবনা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নমিনেশন ফাইল করেছে। ডেইলি স্টার (২৯ নবেম্বর ২০১৮) এর খবর হলো : Meanwhile, Nayibur Rahman son of former Jamat Ameer and executed war criminal Matiur Rahman Ni“ami, Filed nomination papers for Pabna-1 as an Independent Candidate. ... of the 25 Jamat (nominee) aspirants, Shaming saydee second son of convicted Delwar Hossain Sayedee, Submitted nomination papers for Pirojpur-1. বিএনপি এত সাহস পেত না যদি না সো-কলড ঐক্যফ্রন্ট তাদের সঙ্গে যোগ দিত। আগেই বলেছি যারা আছেন সমাজে তাদের প্রো-লিবারেশন ফেস রয়েছে। যেমন ড. কামাল হোসেন, মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতান মনসুর, আ স ম আবদুর রব। সর্বশেষ যোগ দিয়েছেন অধ্যাপক আবু সাঈয়িদ এবং বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে বোমা হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র রেজা কিবরিয়া তার একটা অভিমান থাকতে পারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে, তার বাবা কিবরিয়া সাহেবের হত্যার বিচার এখনও হয়নি ক্যানো? এ প্রসঙ্গে আমি তার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বলা উচিত প্রশ্ন করতে চাই, বঙ্গবন্ধু ও ৪ নেতার হত্যার বিচার হলো কত বছর পর? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যার বিচারও হলো কত বছর পর? তারপরও বলব ঐক্যফ্রন্টের নামে যে মানুষগুলো তারেক খালেদা এবং দ- কার্যকর করা নিজামী গোলাম আযম গোষ্ঠীর প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালেন তাদের লজ্জা না থাকতে পারে, আমাদের লজ্জা আছে, কেননা তারা কেউ যুদ্ধাপরাধী নন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে তাদের একটা ফেস ভ্যালু আছে (যদিও ভোট নেই, হয়তো সে কারণেই ড. কামাল ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলে কাগজে দেখলাম)। এই দুর্ভাগা দেশ দেশের জাতির পিতাকে হত্যা করতে যাদের বুক কাঁপে না হাত বেঁকে যায় না তারা জঙ্গী-জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে হাত মেলাবেন তাতে অবাক হই না। আদালতের ভাষায় সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত এবং তাদের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন শিবির যেটি বিশ্বের ২নং সন্ত্রাসী সংগঠন, তারা কিভাবে এখনও বাংলাদেশের রাজনীতি করছে, তাতে অবাক না হয়ে পারি না। এখন নির্বাচন কমিশনেরও অগ্নিপরীক্ষা। কমিশন এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি নিবন্ধন বাতিল করেছেন, এখন নির্বাচনে তাদের প্রার্থিতার বৈধতা দেবেন কি করে? স্বাভাবিকভাবেই তাদের নমিনেশন বাতিল হওয়ার কথা। দুদিন আগে টিভিতে দেখলাম বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বলছেন ‘জঙ্গী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে।’ অনেকে অবাক হয়েছেন। আমি বলি উনি ঠিকই বলেছেন, মিলিটারি জিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ব্যারিস্টার মওদুদ, এরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের মানুষ। তারাতো জঙ্গী জামায়াত নিয়েই ঘর করছেন। সেই সঙ্গে এখন যোগ দিয়েছেন আ স ম আবদুর রব, মোস্তফা মহসিন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাঈয়িদ, সুলতান মনসুর- এই মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দেবার পর অনায়াসেই বলা যায় জামায়াতে মুক্তিযোদ্ধা আছে? হায় সেক্যুলাস! পঞ্চাশ বছর পর কি দেখছি? ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জীবনের দিনগুলো যদি জীবনে না থাকত তাহলে কোন কষ্ট পেতাম না। ক্ষমতা মানুষকে এত অন্ধ করতে পারে অগ্রজদের কাছে অনেক শুনেছি, বিশ্বাস করিনি। আজ তা জীবনের বাস্তবতা। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আবদুর রব (যাকে লিডার অথবা রব ভাই বলে ডাকি), মন্টু ভাই, যারা ক্যাম্পাসে আইয়ুবের চামচা মোনেম খান, হিংস্র এনএসএফ-এর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন, তারা কি আজ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন? না বিএনপি জঙ্গী-জামায়াতের হিন্দু তাড়াও আন্দোলনে শরিক হবেন? পূর্ণিমা মহিমাদের আত্মাই বা কী বলবে? ড. কামাল হোসেনের কথা বাদই দিলাম। তার সারাজীবনই রহস্যময়। আজকের জনকণ্ঠে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তার রহস্যময় জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন দৈনিক জনকণ্ঠের চতুরঙ্গ পাতায়। ঐ ভদ্রলোক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত না গিয়ে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন? বিচারপতি মানিক দেখিয়ে দিয়েছেন ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মুজিবনগর বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে গাড়িতে করে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ড. কামাল ও গাড়িতে উঠে বসেছিলেন কিন্তু মুহূর্তে তিনি তাদের অপেক্ষা করার কথা বলে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অজুহাত দেখিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যান। তাজউদ্দীন সাহেবরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ভারত চলে যান। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান নিয়ে যায়। ড. কামাল পাকিস্তানী জেনারেল মিঠ্ঠা খানকে খবর দিলে মিঠ্ঠা তাকে প্রটেকশন দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিরাপদে রাখেন। এ পর্যায়ে মিঠ্ঠা খানের সহায়তায় কার্গোবিমানে করে পাকিস্তান চলে যান। পাকিস্তানে তার শ্বশুরবাড়ি। ৯ মাস পাকিস্তানে তিনি কী করেছেন তা আজও রহস্য। জনশ্রুতি আছে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ড. কামালকে বঙ্গবন্ধুর প্লেনে বসিয়ে দেন এবং তিনি এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তারপর ড. কামালের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল রহস্যময়। তবে এবার আর রহস্যময় থাকেনি। এবার সরাসরি স্বাধীনতা বিপক্ষ জঙ্গী-জামায়াত ও বিএনপির চিটা ধানের শীষের বোঝা কাঁধে নিয়ে প্রমাণ করলেন তিনি আসলে ওদের লোক। দেশপ্রেমিক সেক্যুলার জনগণের সতর্ক থাকতে হবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। কিন্তু নির্বাচন এলেই গর্তের বিষাক্ত কীটরা বেরিয়ে আসে। যে চিত্র আমরা দেখেছি ভোলায়, নাসিরনগরে, বিশেষ করে ২০০১-এর নির্বাচনের পর দেশব্যাপী জঙ্গী-জামায়াত ও বিএনপির অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যা, চোখ উপড়ানো, হাত-পা’র রগকাটা, কব্জি কাটা, সংখ্যালঘু ও নৌকার কর্মীদের বাড়ি, গাছ, গরু এবং পুকুরের মাছ লুটের ঘটনা খুব বেশি দিনের কথা নয়। গ্রামে-গঞ্জের ওদের চাঁদা না দিয়ে কোন হিন্দু বা নৌকার সমর্থক দোকানদার তাদের দোকান খুলতে পারেনি। তখনও আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সেক্যুলার শক্তি রুখে দাঁড়িয়েছে এবং খালেদা-তারেকের ক্ষমতায় খায়েশ মিটে গেছে। তারপর বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ২০০৮ বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সেক্যুলার ফোর্স ক্ষমতায় এলে চিত্র পাল্টে যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার কঠোরহস্তে জঙ্গী-সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির রেখে যাওয়া সমাজ পাল্টে দেন। সেই থেকে দেশ যেমন গণতান্ত্রিক পথে অর্থনৈতিকভাবে এমন উচ্চতায় তুলে আনেন যে, বাংলাদেশে আজ বিশ্বে এক লোভনীয় ‘ব্র্যান্ড’। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নেও এক শান্তির নীড়। এই নীড় আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। সম্প্রীতি বাংলাদেশের সম্প্রীতির একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরতে চাই। সম্প্রীতি বলছে, এবারের দুই ঈদ এবং দুর্গাপূজা তিনটি উৎসবই পালিত হয়েছে সাড়ম্বরে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ জন্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সম্প্রীতি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আসলে at the end of day আল্লাহর রহমত এবং বঙ্গবন্ধুর রক্তের কাছেই আমাদের যেতে হবে। যেতে হয়। এ জন্যই আজকের স্লোগান ‘আমার ভোট আমি দেব। যাকে খুশি তাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রার্থীকে ভোট দেব।’ নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল তারকা শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরীর কন্যা ডাঃ নুজহাত চৌধুরী বিশ্বাস করেন যে, নতুন প্রজন্ম এবার ভোটার হয়েছেন তারা প্রথম ভোটটি দেবেন মুক্তিযুদ্ধের প্রার্থীকে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রার্থীকে। ঢাকা- ২৯ নবেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×