সম্প্রতিকালে কবিতা নিয়ে আশা ও হতাশা দুটোই লক্ষ্য করা যায়। কিছু কবিতা পাঠককে হতাশায় নিমজ্জিত করছে দুর্বোধ্যতার কারণে। কবিতা পাঠে দেখা দিচ্ছে অনীহা। কবিতার রসাস্বাদনে পাঠক হচ্ছে বিমুখ। এখানে পাঠকের সাথে কবিতার সংযোগ সাধনে কিছুটা হলেও কবির দায়বোধ্যতা রয়েছে। আবার কিছু কবিতা এই পাঠক-খরার কালেও পাঠককে উদ্বুদ্ধ করে। পাঠক কবিতার রসাস্বাদন করে নিমগ্ন চিত্তে। শেষোক্ত কবির কাতারে আছেন কবি আব্দুল মান্নান সরকার।
আব্দুল মান্নান সরকারের লেখালেখি খুব দীর্ঘদিনের নয়। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি এ পথে যাত্রা শুরু করেন। ঔপন্যাসিক বা গল্পকার হিসেবে তার বেশ পরিচিত থাকলেও কবি হিসেবে তেমন পরিচিতি নেই। পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার পাথার অঞ্চলে তার কেটেছে শৈশব ও কৈশোর। নিবিড়ভাবে মিশেছেন তিনি সাধারণ মানুষের সাথে, আর এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি লিখেছেন ‘পাথার’ নামে একটি উপন্যাসও। তবে তার ‘তোমার পায়ের ধুলো হবো’ কাব্যগ্রন্থখানি পাথারের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা নয়। এটি তার দেশপ্রেম, নারীপ্রেম, ব্যক্তিপ্রেম বিবিধ বিষয়ক কবিতাগ্রন্থ; যাতে প্রকাশ পেয়েছে কবিতার প্রতি মমত্ববোধ। নামকবিতা ‘তোমার পায়ের ধুলো হবো’-এর কথাই ধরা যাক-
পাঁজরে ঘুমের ঘ্রাণ লেগে আছে
ইচ্ছের গরল ঢেলে দেই বেদনার অগ্নিদাহে
রতিক্লান্ত দেহ খোঁজে ঘুমের আড়াল।
তবুও তো চাই অমরতা অনন্তের গহীন গোপনে...
প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চান আর কবি অমর হতে চান কবিতাকে ভালোবেসে। মূলত কবি প্রেমিকা তথা কবিতার ঈশ্বরীকেই ভালোবাসেন-
কারণ ঈশ্বরীকে আপনি
আপনার মতো করেই গড়েছেন
ভদ্রজন এবং সংবেদনশীল,
আপনার ঈশ্বরী মানবিকতায় ভরপুর।
(উত্তম বাবু আপনার ঈশ্বরীকে)
কবিতা তো মানবতারই জয়গান গায়। কাজেই কবি বা কবিতার ঈশ্বরী যে ‘মানবিকতায় ভরপুর’ হবে এটাই স্বাভাবিক। ‘কালো আফ্রিকা’ কবিতায় কবির এই মানবিকবোধ আরো তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছেÑ
আজও তোমার অরণ্য জুড়ে বড় অশুভের ভয়
রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ারের আনাগোনা
আল শাবাব, বোকোহারাম-এর রাইফেল গর্জে ওঠে
সিংহের গর্জন ছাপিয়ে।
‘তোমার পায়ের ধুলো হবো’ কাব্যগ্রন্থে ‘মধুমালা’ ১,২... শিরোনামে ১২টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো প্রেমের, আঙ্গিকে সনেট নয়, সনেট জাতীয়। কবিতাগুলো কোনোটি ১২ পঙ্ক্তির, কোনোটি ১৬ পঙ্ক্তির আবার কোনোটি বা ১৪ পঙ্ক্তির। কাজেই এগুলোকে সার্থক সনেট বলা না গেলেও সনেট জাতীয় কবিতা বলাই শ্রেয়। প্রতিটি কবিতাই মধুমালার প্রতি কবি বা প্রেমিকের প্রেমের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে। যেমন ‘মধুমালা-২’ কবিতায় দেখা যায়-
আজ আমি বিদ্ধ সখী সে তোমার নামের শায়কে
মধুমালা মধুমালা ডাকে প্রাণ তাপিত তপন।
তেপান্তরে দিয়ে পাড়ি চলি শুধু অশান্ত আবেগে
ভুলেছি আমারে আমি দেখে এক মধুর স্বপন।
এ সনেট জাতীয় কবিতাগুলো পাঠে যেন কবি আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এর কবিতাগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে ‘সোনালী কাবিন’-এর কবিতাগুলো ভাব-ভাষা ছন্দ অলংকারে যেমন ঋদ্ধ এগুলো তেমন নয়। বিষয় কিংবা বাহ্যগত কিছু সাদৃশ্য থাকলেও সিংহভাগ কবিতায় বৈসাদৃশ্যতাই লক্ষণীয়।
কবি আব্দুল মান্নান সরকারের কাব্যগ্রন্থটির শিরনাম নারীপ্রেম বা প্রেম বিষয়ক হলেও এখানে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। কখনো তিনি নারীপ্রেমে মত্ত হয়ে উঠেছেন আবার কখনো দেশ সমাজ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ‘এক বীরাঙ্গনার কথা’ শিরনামের কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিগৃহীত এক নারীর বেদনা-বিধুর কথা-
রাজাকার শামছু খান আমারে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিলো
শিয়াল-শকুন যেমন মরা নিয়ে কামড়া-কামড়ি করে
আমাকে নিয়েই তাই করল।
এভাবে আব্দুল মান্নান সরকার তার ‘তোমার পায়ের ধুলো হবো’ কাব্যগ্রন্থে দেশ-সমাজ-মুক্তিযুদ্ধ সব কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তার কবিতার ভাষায় তেমন দুর্বোধ্যতা নেই- সহজ-সরল প্রকাশ ভঙ্গি; যা সাধারণ পাঠকসমাজকে আকর্ষণ করবে এমনটিই আশা করা যায়।