ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার মাসুদ

স্মরণাঞ্জলি ॥ কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

স্মরণাঞ্জলি ॥ কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার

৮ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বিশওয়ারের মৃত্যুর বারো বছর পূর্তি হবে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে বিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার লোকান্তরিত হন। ছিলেন আশির প্রজন্মের উজ্জ্বল এক কবি ও গদ্যকার। তার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাত হয় ২০০৫-এর একুশে বইমেলায়। শেষ বিকেলে লিটন ম্যাগ চত্বরে মিলিত হই। ওখানে কিছু সময় থাকি। তারপর মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসি। ঘণ্টা দুয়েক একসঙ্গে ছিলাম। তার নিজের সদ্য রচিত কবিতা, তরুণ কবিদের কবিতা (যার ৯৫% সম্বন্ধে সে ছিল হতাশ), প্রকাশকদের অসহযোগিতা, সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম ছাপা-না ছাপার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সাহিত্য সম্পাদকের প্রশ্নসঞ্চারী ভূমিকা- এসব নানা প্রসঙ্গে আলাপ করে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন সিলেটে। ওর সঙ্গে জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি। কিন্তু ওদিনের মতো অতটা ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করতে তাকে দেখিনি ইতোপূর্বে। ২০০৫ সালেরই ফেব্রুয়ারিতে তার ‘রচনাসমগ্র-১’ বেরোয় যা কয়েক মাস পর আমার হাতে আসে ‘কালের খেয়া’য় রিভিয়্যু করার সূত্রে। ১৯৮৬-এর শেষ দিকে রিফাত চৌধুরী, আহমেদ মুজিবের পাশাপাশি প্রায় একই সময়ে পরিচয় হয় ফিশওয়ারের সঙ্গে। আড্ডা ছিল আজিমপুরে; গোরস্তান মেইন গেটের কাছাকাছি একটা স্টলে। আমি থাকতাম গাবতলীতে। দেড় টাকা ভাড়া দিয়ে কাঠবডি বাসে চেপে সোজা চলে আসতাম। কিন্তু ফিশওয়ারের সঙ্গে আমার সত্যিকার ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৮৯/৯০-এর দিকে। উনি তখন মালিবাগ-রামপুরা রোডের মাঝামাঝি ‘ঢাকা বিল্ডার্স’-এর পেছনে একটা মেসে থাকতেন। ওই মেসে আমিও ৪-৫ রাত কাটিয়েছি। সে সময় মগবাজারে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ অফিসের খুব কাছে একটা ভবনের ছাদে আড্ডা হতো। আমাদের সঙ্গে আড্ডায় শামিল হতেন আসাদুল্লাহ শেখর (কবিতা লিখতেন, এখন ব্যবসায়ী), বদরুল হায়দার এবং স্থানীয় দু’তিন যুবক যারা লেখালেখি করতেন না। আমার প্রথম সিলেট-জাফলং ভ্রমণের স্মৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ফিশওয়ার। সম্ভবত ১৯৯১ সালে শেকরসহ আমি সিলেটে যাই। ফিশওয়ারের পৈত্রিক বাড়ি ‘খান ভিলা’য় এক রাতযাপনের পর আমরা তিন বন্ধু খুব সকালে রওনা হয়েছিলাম জাফলংয়ের উদ্দেশে। জাফলংয়ের সেই হৃদয় জুড়ানো সৌন্দর্য আর নেই। পাথর ব্যবসায়ীরা সব শেষ করে দিয়েছে। ওই ভ্রমণে আমাদের গাইড ছিলেন ফিশওয়ার। জাফলংয়ের মামুর বাজার, পাহাড়ী নদীর অপরূপ দৃশ্যমুখা পার হয়ে আমরা ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়িয়েছি খাসিয়া কুঞ্জির (খাসিয়াদের পাড়া) অনেকখানি ভেতর পর্যন্ত। একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। পাহাড়ী দারু খোঁজে আমরা হাঁটছিলাম একটা কুঞ্জির বাঁকে। ফিশওয়ার করলেন কি, পাজামা-ফতুয়া পরা অদ্ভুত দর্শন এক লোককে এদিকে কোথাও ‘পানি’ পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। ওই ব্যক্তি ছিলেন পাঠশালার শিক্ষক। শিক্ষক মহাশয় তো রীতিমতো মাইন্ড করলেন। ফিশওয়ার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। আমরাও অপ্রস্তুত। যাহোক, শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের ‘পানি’র সন্ধান দিয়েছিলেন। এক হতদরিদ্র পাহাড়ীর ঘরের দাওয়ায় বসে বড় বড় পাহাড়ী মরিচাযুক্ত চানাচুর সহযোগে সেই সাদা দারু সেবনের পর যে অনাস্বাদিতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, তা আজ পর্যন্ত অপ্রতুল। ফুরফুরে এক অপার্থিব অনুভূতির ভেতর কাঁধে ডানা লাগানো ভাব নিয়ে আমরা পাহাড়ী পথের চড়াই-উতরাই পার হয়ে গেছি টানা ঘণ্টা তিনেক। ফিশওয়ার ছিলেন স্পষ্টবাদী। যা উপলব্ধি করতেন তাই-ই বলতেন। বানিয়ে কথা বলা তার স্বভাবে ছিল না। এদেশের কবি সমাজে কাব্যহিংসা অতি পরিচিত বিষয়। কিন্তু ফিশওয়ার সমকালীন কোন কবিকেই ঈর্ষা করেননি; অন্তত তার প্রকাশ কখনও দেখিনি এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। বরঞ্চ, সমপ্রজন্মের কারও কোন লেখা পড়ে ভাল লাগলে অকুণ্ঠচিত্তে তা জানাতেন। ১৯৯২ সালের দিকে আল মাহমুদ একটি সাক্ষাতকারে সত্তর পরবর্তী কবিতা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কতিপয় তরুণ কবির নামের সঙ্গে আমার নামটিও উচ্চারণ করেছিলেন। সেই ইন্টারভিউ আমার চোখে পড়ার আগেই তিনি পড়ে ফেলেন। পরে আমার সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বিষয়টি সানন্দে জানান। কবিদের অধিকাংশের মধ্যেই এই ঔদার্যের অভাব আছে। তারা হয়ত ভাবেন, অন্যকে স্বীকৃতি দিলে নিজে খাটো হয়ে যাবেন। কিন্তু এটা খুব ভুল ধারণা। আমি মনে করি, একজন সত্যিকার প্রতিভাবান লেখক অপর একজন গুণবন্ত লেখকের প্রশংসা করতে পিছপা হন না। আমাদের অনুজ যে কবিরা আজ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত তাদের কাউকে কাউকে কবিতা ভাল লাগার উল্লেখের মাধ্যমে সামনা সামনি উৎসাহ দিয়েছেন কিশওয়ার। তার কবি চরিত্রের এও এক পজিটিভ দিক। টানা ৯-১০ বছর ঢাকায় ছিলেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার। যদিও কবিতাই ছিল তার প্রথম প্রেম এবং ধ্যান-জ্ঞানের প্রধান ‘ক্ষেত্র’, তথাপি এন্তার কবিতা লেখার পাশাপাশি মূলত অর্থ উপার্জনের জন্য ছোট ছোট প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং বই আলোচনাও লিখেছেন। নামে-বেনামে রচিত এবং খ্যাত-অখ্যাত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এসব লেখা (যা একত্রে একটি বইয়ের সমান) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিশওয়ার প্রথমত এবং শেষত কবি। আমি তাকে আমাদের প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি স্থানীয় লেখক মনে করি। অনেক তরুণ কবির মতো কিশওয়ারও তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে নিজস্বতা দেখাতে পারেননি। সেটা পৃথিবীর খুব কম কবি পারেন। কিন্তু ওই বই সুস্পষ্ট কবিত্বের প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে তার কবি-কল্পনা। সম্প্রসারিত হয়েছে ভাবজগতের সীমা। ক্রমশ আরও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছেন। তার গোড়ার দিককার দুটি কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করবÑ একটা চাঁদনী রাত/আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাই/প্রিয়ার তৃষিত ঠোঁটের কাছে। (উৎসারিত) তুমি সূর্য উদয়াস্তে/তুমি কৃশনের কাস্তে/ধূসর পাখির মতো তুমি হেসে হেসে/ডানা মেলে দিলে/নিসর্গ নিখিলে এর এক দশকে পরে তার কবিতা কতটা পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল তার সাক্ষ্য দিচ্ছে এই পঙক্তিগুলো- ক. যে জানে ধ্যানেই মুক্তি/তার ভয় নেই/অন্ধকার পাপোষে লুটালো,/আলো, আলো, ধ্যানে ধ্যানে শর্বরী পোহালো।’ খ. আমার আগ্রহ আলোর অগ্নিতে/শান্তির আশ্বাস দিলে/ভয় নেই মহান মৃত্যুতে/সকল তীরের ফলা/নিতে পারি/স্রোতে, হৃদয়ের মহৎ অশ্রুতে। গ. অন্ধকারের রেখাহীন প্রান্তরের মতোই বিভূতি/আলোহীন; নখদন্তময় বিশাল মূর্তির হাতের/প্রদীপে যে জ্যোতি,/তাকে বিশেষ লেসারে পাবে/হৃদয়ের ধ্যানে। (বিশেষ লেসার দিয়ে)। কিশওয়ার ছিলেন জাত কবি। ছন্দের নিপুণ প্রয়োগের মধ্যেও তার প্রমাণ মেলেÑ আমি কি তখন জীবনানন্দ/ঘাসের ভেতর খুঁজি আনন্দ/বহুদিন পরে/একাকার করে দু’চোখের পাতা/ঢলে পড়ে যাই তারায় তারায়/পরীরা নামলো ঘুমের পাড়ায়।’ (পরীরা নামলো অগ্রন্থিত কবিতা, রচনাসমগ্র-১) ইংরেজী কবিতার ক্ষেত্রে সুদূর অতীতে জেরাল্ড মেনলি হপ্কিন্স, উইলিয়াম ব্লেক, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের মার্কিন কবি জেমস রাইট প্রমুখের হাতে আধ্যাত্মিক- তার চর্চা হয়েছে। বাংলা কবিতার ভুবনে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের আংশিক অধ্যাত্মভাবনা এবং অমীয় চক্রবর্তীর আধুনিক ঋষিপ্রতিম নিরাসক্ত ঈশ্বরচিন্তার (যা খুবই পরোক্ষ) পর এই ঘরানার কবিতা লেখার চেষ্টা খুব একটা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের কবি অনুরাধা মহাপাত্রের (সত্তরের দশক) ‘শ্রীমায়ের আকাশ’ এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন। এদের পর আমাদের এখানে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার অত্যন্ত সচেতনভাবে কবিতায় অধ্যাত্মপথের সঙ্গী হয়েছেন। আমি লক্ষ্য করেছি তার কবিতা গোড়া থেকেই ধারণ করে আসছে ঈশ্বরভাবনা, পরমাত্মচিন্তা, শুভবোধ, মৃত্যুচিন্তা আর প্রতীকী আগুন’ এবং ‘আলো’ যেগুলো তার সমস্ত জিজ্ঞাসা ও জীবনতৃষ্ণার কেন্দ্রে বিরাজমান। ব্লেক তার কাব্যে ঈশ্বরের কথা বলেছিলেন; তার মুখ দেখতে চেয়েছিলেন এক পলক। অন্যদিকে কিশওয়ার ঈশ্বরের মুখ দেখবার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেননি যেহেতু তিনি বিশ্বাস করতেন ‘আছে শুধু সত্য নিরাকার।’ তিনি অবলোকন করতে চেয়েছেন মৃত্যুর রূপ। কবিতার ভেতর দিয়েই তার সেই ইচ্ছা পরিতৃপ্ত হয়েছে। ‘নিঝুম অন্ধকারে স্বপ্নজাল ছিঁড়ে তার রূপ দেখলাম/অবিকল আমার প্রতিকৃতি/চূর্ণ হলো আমার সামনে।’ কিশওয়ার উনিশ শতকী অর্থে স্বভাব কবি ছিলেন না। কিন্তু প্রকৃত স্বভাব কবির মতোই লিখে গেছেন। অনেক লেখার ফলে তার কবিতা অনেক সময় ভুগেছে থিমের একঘেঁয়েমিতে। কবিতা গ্রন্থভুক্ত করা ক্ষেত্রেও তিনি গ্রহণ করেছেন উদারনীতি। শিল্প বোধ হয় এতটা ঔদার্য সমর্থন করে না। ফলে দীপ্তিমান কবিতাগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য সাদামাটা পদ্য জায়গা পেয়েছে। এতে করে কিশওয়ারের ক্ষমতার ক্ষেত্রগুলো পাঠকের নজর কাড়তে সময় নেবে। সন্ধানী পাঠক অবশ্য ঠিকই চিনে নেবেন কোন্গুলো উৎকৃষ্ট রচনা। তার বেশ কিছু কবিতা পরিচ্ছন্ন বক্তব্য, ভাষার প্রসাদগুণ ও শিল্পসৌকর্যের কারণে বার বার পঠিত হওয়ার দাবি রাখে। ‘বিভিন্ন আকাশ’ তেমনিই একটি কবিতা। এখানে কিশওয়ারের কাব্যস্বভাবের উত্তরণ ও পরিপূর্ণ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়Ñ ‘শান্ত হও মনে-মনে সমাহিত হও/তোমার অঙ্গনজুড়ে নামে যেন স্নিগ্ধ নীরবতা/আর হৈচৈই নয়, ধ্যানমগ্ন পরিবেশ/করো আয়োজন/তুমি কি জানো না কবি, কতো ক্ষণতর এ জীবন/ঈশ্বর সহায় হলে তুমি নিজে স্বয়ং ঈশ্বর। স্বতোশ্চল নদীর গতির মতো তখন তুমিই, সমুদ্র নিকটবর্তী নিতে পারো তৃপ্তির নিশ্বাস। একটি আকাশ হয় সকলের বিভিন্ন আকাশ। কবিরা সচরাচর ধর্ম বিষয়ে উদাসীন অথবা নাস্তিক। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পথের যাত্রী। তিনি মূলত প্রার্থনার ভাষায় কবিতা লিখেছেন। সেই ভাষা ধার করা নয়, তার নিজের। কবিতায় তিনি বার বার নিরাকার এর এবং হৃদয়ের ধ্যানের কথা বলেছেন। মনে রাখা প্রয়োজন সত্য নিরাকার; সৌন্দর্যও নিরাকার। আর ঈশ্বর তো নিরাকার বটেই। প্রেম তার কাছে হৃদয়ের সারাৎসার। এই প্রেম একজন আস্তিক কবির আধ্যাত্মচেতনার সঙ্গে মিলেমিশে হয়ে উঠেছে অনন্য। এক অনিঃশেষ কিন্তু অধরা সর্বত্র অস্তিত্বময় পূর্ণতার বোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে সারা কবি জীবন। তিনি কামনা করেছেন শান্তি কল্যাণ, সমগ্র মানবজাতির মঙ্গল। নিরন্তর গেয়ে গেছেন বিভ্রান্ত মানবাত্মার মুক্তির গান। কবিতা নানা রকম বিশ্বাস লালন করে। তার প্রকাশরীতিও নানা রকম। কিন্তু আমাদের এখানে কবিতা বিচারের সময় সমালোচকগণ, এমনকি কবিরাও এ কথাটি ভুুলে যান। বিষয়টি মাথায় থাকলেই কেবল কিশওয়ারের কবিতার ভাল-মন্দ যাচাই সঠিকভাবে করা সম্ভব। তার জীবনের ঢাকা পর্বটি ছিল যৌবনদীপ্ত কিন্তু ঝঞ্ঝাময়, এলোমেলো, অনিশ্চিত। সিলেটে পিতার (কবি দিলওয়া
×