‘মৃত্তিকা’ আমার চার বছরের মেয়ে। স্কুলে ভর্তির জন্য কোচিং করতে সে এই বাড়িতে এসেছে। ঘরের মেঝে আর বাড়ি দুটোই পুরনো। মেঝের রঙে লালের প্রলেপ দেওয়া, আর তিনতলা বাড়িটিও কেমন ঝিমধরা। পড়ন্ত বিকেলে টানা বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে, অন্য বাড়ির সানশেডে কয়েকটি নয়নতারা ফুটে আছে নোংরা স্যাঁতসেঁতে জায়গায়, সাদা রঙের বিবর্ণ নয়নতারা।
একটানা ভাবছি। আগামী সাহিত্য পাতায় কোন লেখাটা দেব। আমি ব্যাংকে চাকরি করি, গল্পও লিখি, সাহিত্য পাতায়। সন্ধ্যার আলো আমার কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে- অন্য বাড়ির উঠানে সবুজ ঘাস বাতাসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
- ‘মা-চলো’, পড়া শেষ।
একমাথা কোকড়ানো চুলের মৃত্তিকার চেহারাটি অসাধারণ আর কথা বলার সামর্থ্যও বিশেষণে ভূষিত করার মতো। ঘণ্টায় একশ’ আশি মাইল দমকা ও ঝড়ো হাওয়ার বেগে মেয়ে গল্প করছে, আর আমি শুনছি।
- মা, আদুরিনী কি করছে?
- আমি জানি না, মা।
আদুরিনীর বয়স এগারো। আমাদের বাড়িতে আমাকে একটু কাজে সাহায্য করার জন্য এসেছে। আদুরিনীর চেহারাখানা সানশেডে জন্মানো নয়নতারার মতো। এককথায় অপরূপ, তবুও গরিবের নর্দমায় জন্ম তার। বাপ তার পরের বাড়ির নারকেল গাছ পরিষ্কারসহ সামাজিক ভাষায় ছোট কাজে নিযুক্ত। তার ‘মা’ও তাই। নিষ্পাপ শিশুটি তাই ‘ভাত’ দেখে বেজায় খুশি। একবারে পেটের সামর্থ্যরে বাইরে ভাত খেয়ে উঠে দাঁড়াতে পারছে না, আমি শিশুটির ‘মা’ হলাম আজ থেকে।
- আমাকে ‘মা’ বলে ডাকবে।
আদুরিনী মাথা নাড়ছে। একটু পর পর হাতের নখ কাটছে দাঁত দিয়ে। শিশুদের চোখ সহজ আর তার ভাষা মধুময়, নিষ্পাপ আদুরিনীও এমন একটি শিশু। মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে মেয়েটিকে দেখছি। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায়, পাহাড়সম ভালোবাসা পেয়েছি, সবটুকু ভালবাসা জমে নীল জলরাশির সমুদ্র হয়েছে, আজ সেই ভালবাসার সমুদ্রে সবাইকে নিয়ে সাঁতার কাটছি।
তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর্বটি বড়ই বিচিত্র। সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল, সারাদিন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কলা ভবনের গেট থেকে বের হচ্ছি। হঠাৎ মোবাইল ধরতে গিয়ে মায়ের গলার স্বরে সবটাই এলোমেলো হয়ে গেল। অন্যদিক দিয়ে যে গাড়ি আসছে খেয়ালই করিনি, কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি অসম্ভব সুন্দর একটি ছেলে। মনে হচ্ছে এই বিপদে সে দেবদূত হয়ে এলো। আমি হেসে বললাম ’ধন্যবাদ’। এর পর প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য ডিপার্টমেন্টে পড়ে। এরপর ভাললাগা, হাতে হাত রেখে নির্জন রাস্তায় হেঁটে চলা। তারপর কখন যে দু’জনের পথ এক হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। সেদিন গাছের সবুজ ছায়ায় বসে ছিলাম দু’জন। হঠাৎ দুটো ভদ্র গোছের ছেলে এসে ওকে কিল, ঘুষি মারতে লাগল। আমি বললাম, কি বিষয়? ওকে মারছো কেন? তারা বললে, ও লম্পট আমার বোনের সর্বনাশ করেছে। শামীমের দারুণ সব ব্যাখ্যার নিকট হার মানলাম। সম্পর্ক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চুক্তি হলো। সাদা বোর্ডের ওপর আমি সাদা কলম দিয়ে লিখতে লাগলাম, কিছুই চোখে পড়ল না।
কবিতার ভাষা খুঁজি, গাছের সঙ্গে দীর্ঘ মিতালী আমার। অন্ধকারের মধ্যে খুঁজি আলো, আর আমার অন্দর মহলে বেড়ে উঠেছে আলোর মধ্যে অন্ধকার।
শামীম ফেসবুক দেখছে মনোযোগ সহকারে, আমার দিকে তাকানোর সময় কোথায়। পাঁচ বছর ভালবাসা শেষে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। তবে বিয়ের পর ভালবাসার রং গোলাপী থেকে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় তার অবাধ বিচরণ, শুধুমাত্র নিষিদ্ধ নীল দুনিয়ায়। একটু গান, ভালবাসার কথা, এক টুকরো হাসি সবই এ বাড়িতে কষ্টকল্পনা। ব্যাংকে চাকরি করা শামীমকে নিয়ে নিশা নামের উগ্র নিশিকন্যার গল্পও কানে আসে। আমি চুপ, চিৎকার করতে ভাললাগে না, মৃত্তিকার জন্মের পর নমনীয়, সহনীয় শব্দের সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচয় হয়েছে আমার।
- আদুরিনী মেয়েটি কি নিষ্পাপ, কি সুন্দর দেখেছো শামীম।
- হুঁ।
- আগামীকাল ফিরতে দেরি হবে আমার। মায়ের শরীর খারাপ, অফিসের পর ওখানে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে বাচ্চা দুটো দেখো একটু।
মায়ের শরীর নামক যন্ত্রটির বিকল হবার উপক্রম, মাকে নিয়ে ভারতের চেন্নাই যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমি আর বাবা যাব, শামীমও পনেরো দিনের চিত্তবিনোদনের ছুটি পেয়েছে, কিন্তু পাসপোর্টের ঝামেলা আর মৃত্তিকার পরীক্ষার কারণে সে ঢাকায় থাকবে।
আদুরিনী আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে,
- কিছু বলবে, তোমার কিছু লাগবে?
- না, বাড়ি যামু।
- কেন, তোমার কোন অসুবিধা হচ্ছে?
- না, বাড়ি যামু।
- ঠিক আছে, আমি মাকে ডাক্তার দেখিয়ে ফিরি, তারপর যেয়ো।
- না, বাড়ি যামু।
হঠাৎ মৃত্তিকা বলল,
- মা, আদুরিনীকে বাবা মারে আর ও চিৎকার করে।
- তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?
- এমনি, বাবাতো আমাকে আর ওকে অনেক চকলেট দিয়েছে। বলেছে, মাকে বলো না, বললে আরও বেশি মারব।
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বাইরে রোদের ঝলকানি, বুকের মধ্যে টিপটিপ শব্দ, শামীম বাচ্চাটাকে মারছে কেন? আজ বিকেলে ফ্লাইট। নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় নেই, দিন-রাত এক হয়ে যাচ্ছে মায়ের চিন্তায়। নীল-সাদা রঙের মিশেলে আজ আকাশটা একাকার, কি অপরূপ সৃষ্টিকর্তার শিল্প। বারান্দা থেকে এক মুহূর্তের জন্য আকাশটা দেখে নিলাম, মনটা একটু ভাললাগায় পূর্ণ হলো।
ভালবাসা সে তো সবুজ পাতা, আর ঝকঝকে পূর্ণিমা রাতের মাতাল হাওয়া। শামীমের সঙ্গে কতদিন পূর্ণিমার আলোতে স্নান করিনি, সে আমার কাছ থেকে এখন হাজার মাইল দূরে। মানুষের যদি প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধন না থাকে, সবুজ পাতার বৃষ্টির ফোঁটা যদি চোখে না পড়ে তবে তার কাছে বোধ করি জৈবিক চাহিদা মুখ্য হয়ে ওঠে।
- শামীম বাচ্চাটাকে মারো কেন?
- ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না, তুমি চিন্তা করো না সোনা।
গলার স্বরটি খুবই নরম মনে হচ্ছে, আমি যাচ্ছি তাই মনটা তার খারাপ। হয়তো ব্যস্ততার কারণে শামীমের দিকে আমার খেয়াল করাই হয়নি।
- ভুল হয়ে গেছে আমার, তোমাকে মিথ্যা সন্দেহ করেছি, তুমি কিছু মনে করো না, বাচ্চাটাকে মেরো না, ভাল থেকো।
পনেরো দিন পর অসুস্থ মাকে নিয়ে ফিরে এলাম সঙ্গে বাবাও। ফুলের মতো সুন্দর আদুরিনীর চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে।
শামীম বললো, মেয়েটার পেটে কৃমি, ডাক্তার দেখানো হয়েছে। বাড়ি ফেরার চার দিনের মাথায় ‘মা’ না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আদুরিনী পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে আমাকে দেখছে। বললাম- কিছু বলবে,
- বাড়ি যামু।
অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিলাম। আমার মা হারিয়ে গেল একদিনও হয়নি, আর উনি বাড়ি যাবে। বললাম, ঠিক আছে- কয়েকদিন পর চলে যেও।
-শামীম বলল, ও যখন বাড়ি যেতে চাচ্ছে, ওকে যেতে দাও।
- যে আদুরিনীকে নিয়ে এসেছিল, সেই কায়েস এসেছে তার কাছে মেয়েটিকে দিয়ে দেই?
- দাও।
-মা জানো, তুমি যখন ছিলে না বাবা আদুরিনীকে মেরেছিল, আমার একদিন রাতে ঘুম ভেঙে যায়, তখন দেখি বাবা ওর গায়ের উপর উঠে ওকে মারছে।
- বলোনি কেন? বাবা ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখায়, বলে মেরে ফেলবে তোমাকে বললে।
তীব্র মন খারাপ, কারণটি চুপ থাকুক মনের কোণে। মাথার উপর ছাদ, আছে বেঁচে থাকার আশ্বাস তবুও নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়। বিশাল ঐ দিগন্ত জুড়ে থাকা আকাশটাতে খুঁজে ফিরি সাদা মেঘ আর পালক আস্তরণে ঢেকে থাকা নীলাভ-নীল। সবকিছুই কেবল ধুসর মনে হয়।
- আপা, ‘আদুরিনী’ নেই। কেন কি হয়েছে? অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছে। শামীম ভাই এটা কি করল!
আমি বিস্ফারিত চোখে পৃথিবীকে দেখছি।
শীর্ষ সংবাদ: