ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

বাংলাদেশের অভ্যুদয়

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের অভ্যুদয়

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম অধ্যায়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অনেক আত্মত্যাগ জীবন উৎসর্গ, আনন্দ বেদনার মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বহু ব্যঞ্জনীয় আকীর্ণ। পেছনে তাকালে অনেক অজানা তথ্য ধরা পড়ে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের দুই অঞ্চল ‘পশ্চিম’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বারশ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্রের অধীন থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাঙালী’ ও পশ্চিম পাকিস্তানে ‘পাঞ্জাবীরা’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। দুই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ভিন্ন ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ শোষণ আর বঞ্চনা করে। বিভিন্ন তথ্য থেকে সে দিনের বৈষম্যেরচিত্র প্রকট হয়ে দেখা দেয়। চাকরি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৪% পূর্ব পাকিস্তানে ১৬% পররাষ্ট্র বিভাগের চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৫% পূর্ব পাকিস্তানে ১৫% সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানে ৯৫% পূর্ব পাকিস্তানে ৫% নৌবাহিনী (টেকনিক্যাল) চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানে ৮১% পূর্ব পাকিস্তানে ১৯% বিমান বাহিনীর বৈমানিক চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৯% পূর্ব পাকিস্তানে ১১% কর্মরত ছিল। গড় বার্ষিক বাজেট ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৬০% এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ৫০% পূর্ব পাকিস্তানে ১০% ও বেসামরিক ব্যয় ৪০% এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫% পূর্ব পাকিস্তানে ১৫% বরাদ্দ ছিল। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার হাতে স্বরাষ্ট্র দফতর ন্যস্ত থাকে। ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল গঠিত মন্ত্রী সভায় খান বাহাদুর মোহাম্মদ আলী অর্থ, জনস্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খান বাহাদুর মোয়াজ্জেম হোসেন শিক্ষা ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী, আহমদ হোসেন কৃষি বন মৎস্যমন্ত্রী, যোগেন্দ্র নাথ ম-ল বিচার ও সংসদীয় ও নগরপূর্তমন্ত্রী খান বাহাদুর আবুল ফজল, সমবায়, ঋণ ও রিলিফমন্ত্রী, মোহাম্মদ আবদুর রহমান সেচ ও নদীপথমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যোগেন্দ্র নাথ ম-ল কেন্দ্রীয় অস্থায়ী সরকারে সংযুক্ত হন। তারনাথ মুখার্জী সেচ ও নদীপথমন্ত্রী, নরেন্দ্র নারায়ণ রায়, বিচার ও সংসদীয়বিষয়কমন্ত্রী, ফজলুর রহমান ভূমি রাজস্ব ও কারাগারবিষয়কমন্ত্রী, দ্বারকানাথ বাড়ৈ ওয়ার্কস ও বিল্ডিংবিষয়কমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালের ২৫ নবেম্বর শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন প্রাদেশিক পরিষদে ২ অংশে বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে খাজা নাজিমউদ্দীন সংসদীয় নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সারের ১৪ এপ্রিল পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এ মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন স্যার ফেডারিক বোর্র্ন গবর্নর, খাজা নাজিম উদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী তার হাতে স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা, বিচার ও রেজিস্ট্রেশন মন্ত্রণালয় ন্যস্ত ছিল। নূরুল আমীন বেসামরিক, বাণিজ্য শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী, আবদুল হামিদ শিক্ষামন্ত্রী, সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল কৃষি, সমবায় ও ত্রাণমন্ত্রী, হাসান আলী যোগাযোগ পূর্ত ও পানিমন্ত্রী, হামিদুল হক চৌধুরী রাজস্ব ও অর্থমন্ত্রী, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, আবদুল করিম স্পীকার, নাজমুল হুদা ডেপুটি স্পীকার নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত ইতিহাস নানা ঘটনাবর্তে আবর্তিত। এ সময় তেভাগা আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। বঙ্গীয় বর্গাদায় নিয়ন্ত্রণ বিল ১৯৪৭ প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপিত হয়। ক্রমে তেভাগা আন্দোলন গতিহীন হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজী ও উর্দুর পাশে বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রস্তাব গণভোটে দিলে অগ্রাহ্য হয়। ১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হবে উর্দু। অন্য ভাষা নয়, ‘না, না’ প্রতি ধ্বনি তোলে উপস্থিত ছাত্ররা। ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র সঙ্গে সাক্ষাত করে স্মারকলিপি পেশ করে। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ভাষা পুনর্গঠন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ বাংলা বর্ণমালাকে আরবীকরণের লক্ষ্যে মাওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে সাহিত্য সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারের ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করা হয়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে ১৯৫০ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর গণপরিষদের সাংবিধানিক মূল কমিটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। ভাষা সংগ্রাম কমিটি ১২ নবেম্বর বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৯৫১ সালে আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন জনসভায় ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালিত বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের লক্ষ্যে। ৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল কর্মসূচীর ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেরুয়ারি থেকে পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছাত্র ও যুব কর্মীরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র প্রতিনিধিরা দলে দলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে জড়ো হয়। দশজন দশজন করে ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খ- খ- মিছিলে অংশ নেয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পুলিশ আটক করে ট্রাকে তুলে নেয়। বাকি ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ ক্যান্টিনে জমায়েত হতে থাকে। মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের ভেতর পুলিশ ঢুকে গুলি করে। ছাত্র-ছাত্রীরা ইট পাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে আবদুল জব্বার ও রফিক উদ্দিন নিহত হয়। গুরুতর আহত আবদুল বরকত রাতে মৃত্যুবরণ করে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা একটি শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সাইদ হায়দারের নকশায় ২৩ ফেব্রুয়ারি চাত্ররা অজ্ঞাত দুই রাজমিস্ত্রির সাহায্যে ‘শহীদ স্তম্ভ’ নির্মাণ করে। শফিউরের পিতা ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও নেজামী ইসলামী লীগ সমন্বয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গড়ে ওঠে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ চারজন মন্ত্রী ও ৫০ মুসলিম লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। পরে পাকিস্তানে সামরিক শাসন শুরু হয় ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৫৮ সারের ২৮ অক্টোবর আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৫৯ সালে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৬০ সারের ১১ জানুয়ারি এক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার সদস্য মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীকার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সরকার ইসলামীকরণের নামে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনে। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘চল চল চল’ এর কবিতায় উদ্ধৃত নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব কবির মহাশ্মশান এর স্থানে সংশোধন করে লেখা হয়। ‘সজীব করিব গোরস্তান’ ও সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’র স্থানে ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি লেখা হয়। ১৯৬১ সালে বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্র ধর্মঘট ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ অসংখ্য রাজনীতি বিদদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ সংগঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালীরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সংস্থাপন দুর্বল ছিল। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ৬ দফা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্ত শাসনের দাবি তুলে ধরেন। ৬ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- (ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইট স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। (খ) লাহোর প্রস্তাব অনুসারে শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। সত্যিকার ফেডারেশন গড়তে হবে। আইন সভার সার্বভৌমত্ব থাকবে। (গ) ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় বিষয় থাকবো। অন্যান্য বিষয় স্টেট সমূহের (প্রদেশ) হাতে থাকবে। (ঘ) পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারিরক্ষী বাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়। ছয় দফা ঘোষণার পর সর্বত্র আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। পাকিস্তান সরকার মিছিল, সমাবেশ হরতাল পালনে কঠোর দমন পীড়নের আশ্রয় নেয়। ছাত্র নেতারা ও জাতীয় রাজনীতি বিদগণ স্বায়ত্ত শাসন থেকে সংগ্রামকে সংগঠিত করেন। ১৯৬৮ সালে ছাত্র নেতৃত্ব ১১ দফা ঘোষণা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- (ক) গ্রামে-গঞ্জে স্কুল স্থাপন, ছাত্র বেতন ৫০% হ্রাস, হল হোস্টেলের ডাইনিং হল, ক্যান্টিন ৫০% সাবসিডি প্রদান। অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু (খ) বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে। (গ) পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। (ঘ) ব্যাংক বীমা পাট ব্যবস্থা ও বৃহৎশিল্প জাতীয়করণ করতে হবে। (ঙ) কৃষকের খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করতে হবে। (চ) শ্রমিকের মজুরি বোনাস দিতে হবে। শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। (ছ) পূর্ব পাকিস্তানের বন্যানিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। (জ) জরুরী আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য বিবর্তন মূলক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। (ঝ) সিয়েটো, সিন্টো, পার্ক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করতে হবে। (ঞ) দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মীদের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করতে হবে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারিকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ক্রমে তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সারা বাংলাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পেশাজীবী, শিক্ষক ও বিভিন্ন সংগঠন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেরুয়ারি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের বেয়নেট চার্জে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬৯ সারের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পর রেসকোর্স ময়দানে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত করে ছাত্র জনতা। ১৯৬৯ সালের ২১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছয়দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৬৯ সালে ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের কাছ থেকে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে। ইয়াহিয়া খান জন প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদে ও ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নবেম্বর প্রবল ঘূর্ণিঝড় অনুষ্ঠিত হয়। দুই লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান সংবিধান প্রণয়ন ও ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত হয়। ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি শর্ত আরোপ করেন- ১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে। ২. অবিলম্বে সব সৈন্য বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। ৩. প্রাণহানি সম্পর্কে তদন্ত করতে হবে। ৪. জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বৈঠক করে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনগণের নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করা নিয়ে যায়। ১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় দিল্লীতে পৌঁছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বাংলাদেশের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। একটি সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার আত্মপ্রকাশ করে। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় গঠিত এই সরকারের নাম দেয়া মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, তার হাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ন্যস্ত ছিল। খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ মন্ত্রণালয় এএইচএম কামরুজ্জামান অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৭ এপ্রিল সকাল ১১.১০ মিনিটে মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। এ সময় প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ ইউসুফ আলী। ভারতে আশ্রিত ও রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ছাত্র-বুদ্ধিজীবী জনমত গঠন ও কূটনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেয়। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস রক্ষক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামে বহু শহীদের আত্মত্যাগ, জীবন উৎসর্গ, মা বোনের সম্ভ্রম হারানো বেদনার ইতিহাস উৎকীর্ণ হয়ে আছে। এমন কম পরিবার আছে যেখানে একজন শহীদ হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান অধিকার করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন রাষ্ট্রের উন্নয়ন, যাত্রায় নতুন নতুন কর্মসূচী যোগ করেন। দেশের স্বাবলম্বিতা অর্জনের মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর উল্টা পথে ইতিহাসের চাকা ঘুরেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের অধিষ্ঠিত হয়েছে। সামরিক ও স্বৈরশাসন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রথম ক্ষমতাসীন হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও সংবিধান সুরক্ষায় কাজে অগ্রবর্তী হয়। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছেছে। আজও বাতাসে যড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। স্বাধীনতাবিরোধীরা নান অপতৎপরতায় লিপ্ত। এদেশের সিংহভাগ মানুষের ধমনীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবাহিত। ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বাঙালী একদিন পৌঁছে যাবে বিজয় স্তম্ভে। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয় আপামর জনতা। এই জনতা বাঙালীর গৌরব ও অহঙ্কারের অংশ। এদের মুখে হাসি ফোটানো, দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে না পারলে প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতার অর্থ অর্থহীন হয়ে পড়বে। সুদিনের প্রত্যাশায়।
×