ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন মাহমুদ রবি

বিশ্বকবির শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহি

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বকবির শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহি

যারা ভ্রমণপিপাসু তারা একবার হলেও বেড়িয়ে যাবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি। যেখানে গেলে আপনার পরিচয় হবে ইতিহাসের সঙ্গে। জানতে পারবেন বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সম্পর্কে। আরও জানবেন কবির অনেক অজানা কথা। এখানে এলে দেখবেন, বাংলাসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ ভাস্কর্য, কবিপতœীর আবক্ষ ভাষ্কর্য, ও শ্বশুরবাড়ির দ্বিতল ভবনটি। আর পিঠাভোগে রয়েছে কবিগুরুর পূর্বপুরুষের নিবাস। এছাড়া চোখে পড়বে দক্ষিণডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্সের ভবনের পূর্বদিকের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অবস্থিত ছফেদা তলায় নির্মিত মৃণালিনী মঞ্চ, আছে গ্রাম্য পরিবেশ, আরও নজরে পরবে হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্য নিদর্শন শান্তির নীড় মাটির তৈরি বাড়ি (ঘর)। যেখানে এখনও বসবাস করছে মানুষ। ফুল, ফল, সবুজ-শ্যামল ঘন বাগান, সৌম্য-শান্ত গ্রাম, পান-বরজ ও নার্সারি। খুলনা বিভাগে অবস্থিত নোবেল বিজয়ী অমর কবির আদি আত্মীয়তা ছড়িয়ে আছে এ জেলাতে। যা পূর্বে দক্ষিণডিহি রায়বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কবিগুরুর পূর্ব আদিনিবাস পিঠাভোগের কুশারী বাড়ির ইতিহাস খুলনা জেলার রূপসা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে ৫নং ঘাটভোগ ইউনিয়নের অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামে অবস্থিত একটি সুপ্রাচীন গ্রাম। নওয়াপাড়া বিশ্বরোড থেকে ৭কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে প্রাচীন ভৈরব নদীর ১২০ মি. উত্তর পাড়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের আদিনিবাস কুশারীবাড়ির অবস্থান। নাম তার পিঠাভোগ! খুলনা আঞ্চলিক প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের পরীক্ষামূলক সমীক্ষায় পিঠাভোগ গ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের ভিটার ভিত্তিপ্রস্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ভৈরব অববাহিকায় গড়ে ওঠা পিঠাভোগ নামের সুপ্রসিদ্ধ গ্রামটি প্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহ্যবাহী। ভৈরবের উত্তর অববাহিকায় মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে গড়ে ওঠা এ প্রাচীন জনপথটি প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। ঐতিহাসিক তথ্য সূত্রে জানা যায়, খানজাহান আলী (রহ.) বাগেরহাট আগমনের প্রায় কয়েকশ’ বছর আগে ভৈরব অববাহিকায় এই প্রাচীন জনপথটি গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক যোগসূত্র থেকে পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ কুশারীদের আবির্ভাব ও গোড়াপত্তন এবং প্রাচীন বসতি বিন্যাস থেকে গ্রামটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে তথ্য মেলে। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে কুশারী গোত্রের শাখা-প্রশাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে। দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী ভৈরব তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারানাথ কুশারীর দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর বংশের আদি পুরুষ। যিনি খুলনা ফুলতলার দক্ষিণডিহি নিবাসী শুকদেব রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিয়ে করে পীরালি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়। ‘অন্যগোত্রে বিয়ে করার দোষে সাব্যস্ত হয়ে’ জাতিচ্যুত হয়ে দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনে বাধ্য হন। জগন্নাথ কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী পারিবারিক মতপার্থকের কারণে গঙ্গাতীরে কলকাতা শহরের নিকটবর্তী গোবিন্দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। কুশারীরা ব্রাহ্মণ ছিলেন বিধায় স্থানীয় রুচিবান মানুষেরা ব্রাহ্মণ পঞ্চনন কুশারীকে স্ব-সম্মানে ঠাকুর বলে ডাকতেন। এভাবেই তাঁরা কালক্রমে পিঠাভোগ গ্রামের কুশারী থেকে কলকাতার ঠাকুর হলেন। কলকাতার সম্মানিত পঞ্চানন কুশারী ওরফে পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী বংশধর নীলমণি ঠাকুর প্রভূত অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় গিয়ে বিয়ে করেন। জোড়াসাঁকোয় এই বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারেই ১৮৬১ সালে ৮ মে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের প্রায় দুইশ’ বছরের পুরনো ভবনটি ১৯৯৫ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়। বসতভিটায় চলতি ২০১১-১২ সালের অর্থবছরের পরীক্ষামূলক প্রতœতাত্ত্বিক খনন গত ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর শুরু“হয়ে ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে সম্পন্ন হয়। বর্তমানে এখানে কবিগুরুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। বেণীমাধব রায় চৌধুরীর পরিচয় ও কিছু ইতিহাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরের নাম বেণীমাধব রায় চৌধুরী। যৌবনে কবি কয়েকবার তাঁর মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামাবাড়িতে এসেছিলেন। পরিবার থেকে রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী সন্ধান ক্ষেত্র হিসেবে তৎকালীন যশোরের ফুলতলা (বর্তমান খুলনা জেলাধীন) এলাকা নির্বাচন করা হয়। ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এ বাড়ির গৃহকর্তা রায়চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিণী দাক্ষায়নী দেবীর একমাত্র কন্যা ভবতারিণী দেবী ওরফে পদ্ম ওরফে ফুলি ওরফে ফেলীর সঙ্গে বিয়ে হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বিয়ের পর ঠাকুর পরিবারের প্রথা অনুযায়ী ভবতারিণী দেবীর নাম বদলে রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। বিয়ের সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস, আর ভবতারিণী দেবীর বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর ১১ মাস! রবীন্দ্রনাথ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণডিহির সম্পর্ক হয়ে ওঠে নিবিড়। মৃণালিনী দেবীর পিতা বেণীমাধব রায় চৌধুরী ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারি এস্টেটের বেতনভুক্ত কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিয়ে করেন দক্ষিণডিহির রামনারায়ণ রায় চৌধুরীর কন্যা সারদা দেবীকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী আর কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর জন্ম এ গ্রামেই। রবীন্দ্র পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত দক্ষিণডিহি রবীন্দ্রনাথের পাঁচপুরুষের শ্বশুরবাড়ি হিসেবেও পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর বিয়ের পর রায় পরিবার উন্নত বসতবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বেণীমাধব রায় চৌধুরীর দোচালা টিনের ঘর ছিল। তাই কবির শ্যালক নগেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ১৮৯০ সালে দক্ষিণডিহি ‘রায়বাড়ি’ এর নির্মাণ কাজ শুরু“করেন। কবিপতœী মৃণালিনী দেবী মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৯০২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বেণীমাধব রায় চৌধুরীর পুত্রদেরও মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের অনুপস্থিতির কারণে ভবনটি অবৈধ দখলে চলে যায়। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর ১৯৯৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভবনটি অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়। জাতীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে নামকরণ করা হয় ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামে। এবং সে বছরের ১৪ নবেম্বর জেলা প্রশাসক (খুলনা) জনাব কাজী রিয়াজুল হক ভিত্তিপ্রস্থরের শুভ উদ্ধোধন করেন। ২০১০ সালের ২৭ জুলাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিছু সময় হাতে নিয়ে ২৫ থেকে ২৭ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ বেড়িয়ে যেতে পারেন দক্ষিণডিহিতে। কেননা এ দিনগুলোতে নানা আয়োজনে দিনব্যাপী পালন করা হয় কবির জন্মজয়ন্তী ও কবি প্রয়াণ দিবস। কবির স্মৃতিধন্য এ দুই স্থানে কবিপ্রেমীদের মিলনমেলা ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই তিন দিন নতুন রূপে সাজানো হয় এবং আনাগোনা থাকে কবিপ্রেমীদের! প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর, আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় (খুলনা) গিয়ে জানা যায়, খুলনা জেলা প্রশাসক ইতোমধ্যে কবির আদিনিবাস পিঠাভোগ ও শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণিডিহিকে ঘিরে কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নেয়া হয়েছে কিছু পদক্ষেপ। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের বসতভিটায় কবিগুরুর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। তবে জেলা প্রশাসক এ জায়গাটিতে রবীন্দ্রপ্রেমীদের জন্য নির্মাণ করতে যাচ্ছে কবির স্মৃতি জাদুঘর। কবিপ্রেমীরা যেখানে আসলে জানতে পারবেন বিশ্বকবির অজানা অনেক ইতিহাস। আর ফুলতলায় উপজেলার দক্ষিণডিহিস্থ কবির শ্বশুরবাড়ি ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’-এ ঘিরেও নিয়েছে আরও কিছু কার্যক্রম। সেখানে নিরাপত্তার জন্য রয়েছে সীমানা প্রাচীর ও সর্বক্ষণ ৫ জন আনসার ও রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে টিকেট কাউন্টার। এবং শিশুরা রবীন্দ্রনাথের জীবনী সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য থাকবে চিলড্রেন কর্নার। এছাড়া প্রতিবছর কবির প্রয়াণ দিবস ও জন্মজয়ন্তীতে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে থাকেন জেলা প্রশাসক। এ আয়োজনের সময় যে কেউ ঘুরে যেতে পারেন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য খুলনার দক্ষিণংিডহি ও পিঠাভোগে। যেভাবে যাবেন দক্ষিণডিহিং দেশের যে কোন স্থান থেকে খুলনা মহানগরীতে এসে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ফুলতলা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গেলে দক্ষিণডিহি গ্রাম। খুলনা-যশোর মহাসড়কের বেজের ডাংগা বাসস্টপ থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার পূর্বে গেলে দেখতে পরবেন গ্রামের ঠিক মধ্যখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেণীমাধব রায় চৌধুরীর দোতলা ভবনটি। যা রবীন্দ্র-মৃণালিনীর স্মৃতিধন্য বাড়ি হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে বাড়িটি ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
×