ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্দীপ্ত মনোবলে প্রান্তির ছুটে চলা

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

উদ্দীপ্ত মনোবলে প্রান্তির ছুটে চলা

শেখ প্রান্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এসএম আবু বকরের দ্বিতীয় সন্তান। মা কামরুন্নেসা লেখা একজন সুগৃহিণীই শুধু নন সফল শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল মডেল স্কুল থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। বড় মেয়ে শেখ শেমন্তী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে বেসরকারী বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। সুকণ্ঠ মায়ের সঙ্গীত সাধনা অতি বাল্যকাল থেকে দুই কন্যাকেই সংস্কৃতির এই বিশেষ আঙিনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। বড় মেয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন। আর অসুস্থ প্রান্তি শারীরিক হরেক রকম প্রতিবন্ধকতায় গলা সাধতে না পারলেও গিটারের সুরের মূর্ছনায় সবাইকে মুগ্ধ করে দেয়। ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে জন্ম নেয়া প্রান্তি অতি বাল্যকাল থেকে গলায় বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতো। এক সময় যা শ্বাসকষ্ট এমনকি কথা বলার জায়গাটিতেও বিপন্নতার শিকার করত। কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী প্রাপ্তি তার অসুস্থতার উপসর্গগুলোকে প্রতিনিয়তই যে মাত্রায় জয় করেছে সেখানে শিক্ষা জীবনও হয়েছে অবারিত। মমতাময়ী মা এবং স্নেহশীল বাবা শুধুমাত্র যে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়েছেন তা নয় আধুনিক সুচিকিৎসা দিতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। এসব স্মরণ করে প্রান্তি সজল চোখে আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। সৎ, আদর্শ নিষ্ঠ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা পিতার শিক্ষকতার জীবনে আর্থিক সচ্ছলতার সম্ভাবনা সেভাবে প্রত্যক্ষ না হলেও মেয়েকে নিরাময় করে তুলতে সব ধরনের প্রচেষ্টা এখন অবধি অব্যাহত রেখেছেন। প্রান্তিও সাধ্যমতো তার প্রতিদান দিয়েছে অকাতরে । সারা বছর অসুস্থ থাকা এই মেয়েটির ছাত্র জীবনের একটি বছরও নষ্ট হয়নি। শুধু তাই নয়, পরীক্ষায় মেধা ও মননের স্বাক্ষর রেখে কৃতী ছাত্রীর আসনে দাঁড় করাতে নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়েও দেয়। প্রতিটি চূড়ান্ত পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষ স্থানে চলে আসা এই মেয়েটির জীবন সংগ্রামের অনির্বাণ দীপ্তি। তার বক্তব্য থেকে জানা যায় বছরের সিংহভাগ সময় অসুস্থ থাকলেও পরীক্ষার দিন মানসিক শক্তিতে সে পরীক্ষার হলে গিয়ে বসতে পারত। সফলভাবে এই প্রয়োজনীয় পর্বটি অতিক্রমও করে যেত। নীতি-নিষ্ঠ মা-বাবা কখনও প্রান্তির শিক্ষকদের কাছে সেভাবে যেতেন না। মেয়ের মেধা এবং মনন শক্তির ওপর তাদের অবাধ আস্থা এবং বিশ্বাস ছিল। অসুস্থ মেয়ের কষ্ট আর বিষণœতার পরিবেশ ভারি হওয়া ছাড়াও এটা ছিল প্রান্তি এবং বাবা-মায়ের জন্য এক অন্যরকম আনন্দযোগ। কারণ সফলতার সঙ্গে প্রান্তি এমন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখত যেখানে মুগ্ধ আর বিস্ময় হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। মাত্র ৫ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালে বাবা তাকে নিয়ে যায় কলকাতায় আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষকের আয় ছিল হাতেগোনার মতো। আয়ের হরেক রকম উৎস এখনও কোন আদর্শ নিষ্ঠ শিক্ষক ভাবতেও পারেন না। আর সে সময়ে কোন সুযোগও তৈরি হয়নি বিভিন্ন সূত্রে মাসিক আয়কে অবারিত করার। শিক্ষক বাবার অতি সাধারণ যাপিতজীবনই শুধু নয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যয় সেও এক অনিবার্য গতিপ্রবাহে অর্থবিত্তের মোহ অতিক্রম করা অসম সাহসের ব্যাপার। এই জায়গাটিতে শিক্ষক পিতা শুধু দুঃসাহসীই নন অকৃত্রিম স্নেহশীলতায় অবরুদ্ধ এক অনন্য পিতৃসত্তাও। চিরায়ত মাতৃত্বের মহিমান্বিত রূপ আবহমান বাংলার অকৃত্রিম সম্পদ। কিন্তু পিতৃত্বের এমন স্বচ্ছন্দ, সাবলীল শৌর্য সত্যিই নজর কাড়ার মতো। কোনমতে অর্থ সঙ্কুলান করে বাবা-মা মেয়েকে ভর্তি করান কলকাতার সিটি হাসপাতালে। সেখানে তার স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক একটি ছোট্ট অপারেশনের সিদ্ধান্ত জানান। সেই মতে প্রান্তির মেরুদ-ের তিনটি হাড়কে এক জায়গায় নিয়ে এসে তার বাড়ন্ত উচ্চতাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মার মতে এরপর থেকে মেয়ের উচ্চতা আর বাড়েনি। সেই চিকিৎসা সেবাকে নিয়মিত মেনে চলার পরও প্রান্তি শারীরিকভাবে কখনও স্বস্তি বোধ করেনি। ১৯১৬ সালে তাকে ভেলোরে নিয়েও আধুনিক চিকিৎসা দেয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করেন বাবা। তার পরেও অতি উন্নতমানের চিকিৎসা সেবাও তাকে নিরাময় করে তুলতে ব্যর্থ হয়। তীব্র যন্ত্রণাকাতর উপসর্গগুলো উন্নত চিকিৎসার বদৌলতে সাময়িক আরাম দিলেও চূড়ান্ত অর্থে সুস্থ হওয়ার লক্ষণ সেভাবে দেখা যায়নি। আধুনিক চিকিৎসাই নয়, সুস্বাদু, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের তালিকা প্রান্তির জন্য সব সময়ই বরাদ্দ থাকত। নিজেদের আরাম আয়েশ, বিলাসীতাকে নির্দ্বিধায় অতিক্রম করে যাওয়া সেও এক স্নেহসিক্ত পিতা-মাতার নিঃশর্ত সমর্পণ। তার পরেও শ্বাসকষ্ট, অস্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করে। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি শারীরিক অসুস্থতাকে প্রান্তি কখনও তোয়াক্কাই করেনি। হীনম্মন্যতায়ও ভোগে না। ভেতরের এক অনমনীয় শক্তি তাকে সব সময় প্রাণিত করে। তার জ্বলন্ত স্বাক্ষর সে রেখেই যাচ্ছে। কখনও তার মনে হয়নি অন্যদের চাইতে তার কর্মক্ষমতা কিছুমাত্র কম। ফলে অদম্য গতিতে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াই ছিল প্রতিদিনের জীবনের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের দ্বারে পৌঁছে যেতে তাকে কালক্ষেপণ করতে হয়নি একটি দিনের জন্যও। ২০০৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাস করে জিপিএ-৫ পেয়ে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও জিপিএ-৫ এর মর্যাদায় অর্জিত হয়। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি নয় ভর্তি যুদ্ধে মেধা তালিকায় ১৩তম হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শারীরিক দুর্বলতাকে জয় করে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থায় পড়াশোনা চালিয়ে যায়। শুধু তাই নয় নির্ধারিত সময়ে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জিত হয়। এখানেও অসাধারণপ্রাপ্তি। প্রথম স্থানে দ্বিতীয়-সিজিপিএ-৩.৮। পরবর্তীতে স্নাকোত্তরের ফলাফলও নজর কাড়া। এখানে মেধার স্থানে কোন বিচ্যুতি ঘটে না- সেই প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। কিন্তু সিজিপিএ বেড়ে হয় ৩.৯৫। প্রান্তি মনে করে সংগ্রামী জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তবে সফলতার সঙ্গে শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি শেষ হলেও জীবনযুদ্ধ এখনও অব্যাহত আছে। শরীরের যন্ত্রণা তো আছেই তার ওপর একটি সম্মানজনক পেশায় যুক্ত হওয়া সেও এক নিত্য লড়াই। কৃতিত্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মৌখিক পরীক্ষার ফল এখনও জানা যায়নি। আত্মপ্রত্যয়ী প্রান্তি মনে করে যে কোন ধরনের পেশাকে গ্রহণ করার মতো মানসিক এবং শারীরিক সক্ষমতা দুটোই তার আছে। সে প্রমাণ দিয়েও এসেছে তার শিক্ষা জীবনে। একজন সুস্থ বাচ্চার তুলনায় তার পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফল কোন অংশেই খারাপ নয় ভাল ছাড়া। প্রান্তি বলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সমৃদ্ধ যুগে মেধা ও মননের বিকাশ কাজে লাগিয়ে যে কোন সম্মানজনক পেশা চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে একেবারে সম্ভব। সে অপেক্ষা করে আছে এমন এক সুবর্ণ সময়ের যখন তার আকাক্সিক্ষত স্বপ্নটি হাতের নাগালে চলে আসবে। স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রত্যয়ী, সচেতন প্রান্তি মনে করে বাবা-মা তার জন্য যা করেছে সে প্রতিদান দেয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না। তবে তাদের বয়স হচ্ছে, অল্প বিস্তর অসুখ-বিসুখও কাহিল করে দেয় সে মাত্রায় বাবা-মার স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্বটুকু নিতে চায় কর্ম জীবনে নিজেকে সম্পৃক্ত করার পর। প্রান্তি যেন তার প্রত্যাশিত স্বপ্নকে পেয়ে যায় এমন কামনা তার একান্ত সুহৃদদের।
×