ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে রাজনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় অফিসগুলোতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পদচারণায় মুখরিত চতুর্দিক। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের প্রার্থিতার সপক্ষে যৌক্তিকতা দেখানোর স্বার্থে ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিচ্ছেন। তবে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে, প্রত্যেক দলেই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসার ব্যাপারে নারী প্রার্থীদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। সংরক্ষিত আসনের পাশাপাশি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে নারীরা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় অগ্রগামী অবস্থায় রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রাকে আরও বেগবান ও তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলার ক্ষেত্রে নারীদের প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ ইস্যুটি ইতিবাচক হিসেবে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করবে। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের উপস্থিতি পুরুষের ন্যায় দেখা যায় না। তবে এবারের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণ করে বলা যায়, অন্যান্য বারের তুলনায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নারী প্রার্থীদের ফরম উত্তোলন ও জমা দেয়ার নজিরও বেশি দেখা যাচ্ছে। নারীরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদে যত বেশি প্রতিনিধ্ত্বি করতে পারবে তা আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ও পাথেয় হয়ে থাকবে। কারণ সংসদে সমতা এবং সাম্যতার ভিত্তিতে পুরুষের ন্যায় নারীদের অংশগ্রহণ সংসদকে প্রাণবন্ত ও কার্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরিসংখান দেখে জানা যায়, নির্বাচনে নারী প্রার্থীর হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ- মোট ১ হাজার ৫৬৬ জনের মধ্যে মাত্র ৫৭ জন, জয়লাভ করেন মাত্র ১৯ জন। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তুলনামূলক নারী প্রার্থীর সংখ্যা কমে আসে। ২৭টি আসনে নারী প্রার্থী ছিলেন মাত্র ২৮ জন (মজুমদার, ২০১৮)। তবে উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা মোট ৫০ টি যা মূলত আলঙ্কারিক। এবারের নির্বাচনে পূর্বের যে কোন পরিসংখানিক চিত্রকে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে অতিক্রম করবে বলেই মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে নারীদের নির্বাচনমুখী হওয়াই তা প্রমাণ করে। অন্যান্য যে কোন সংসদ নির্বাচনের তুলনায় আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হবে। এ তথ্যের স্বপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করা যায়। প্রথমত দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে গ্রীন সিগনাল এবং দলের সভাপতি/সভানেত্রীর মৌখিক নির্দেশনায় মনোনয়ন ফরম ক্রয় ও জমা দিয়েছেন অনেকেই। দ্বিতীয়ত নারীদের মধ্যে যারা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন তাদের সিংহভাগই দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে কিংবা ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নতুবা তৃণমূলের নেতৃত্বে রয়েছেন। তৃতীয়ত দলীয় প্রধানের পরামর্শে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কর্মসূচীতে সোচ্চার ও তৃণমূলে নেতাকর্মীদের মধ্যে দলীয় প্রচার প্রচারনায় সক্রিয় থাকার পুরস্কারস্বরূপ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন নারী নেত্রীরা। চতুর্থত সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন অনেকেই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন থেকেই দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। পঞ্চমত বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা জনপ্রিয় নারীরা বিভিন্ন দল থেকে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন। দলগুলো ব্যক্তিদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ভোটের মাঠে চমক সৃষ্টি করার প্রত্যাশা থেকেই নারীদের মনোনয়ন দিতে পারে। শেষত আন্দোলন, সংগ্রাম এবং দলের সঙ্কটকালীন সময়ে নারী নেত্রী এবং তাদের কর্মীদের অগ্রগণ্য ভূমিকা দলগুলো বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারে নারী প্রার্থীদের। গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার জন্য ২টি মনোনয়ন ফরম ক্রয় করার মাধ্যমে দলটির মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হয়। ফরিদপুর-২ এ সাজেদা চৌধুরী, রংপুর-৬ এ স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, শেরপুর-২ এ মতিয়া চৌধুরী, গাজীপুর-৫ এ মেহের আফরোজ চুমকি, চাঁদপুর-৩ এ ডাঃ দীপু মনি, খুলনা-৩ এ বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, টাঙ্গাইল-৬ এ তারানা হালিম, নড়াইল-১ এ ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী, জামালপুর-৫ এ মারুফা আক্তার পপি, জামালপুর-২ এ মাহজাবিন খালিদ, হবিগঞ্জ-১ এ কেয়া চৌধুরী, নেত্রকোনা-৩ এ অধ্যাপিকা অপু উকিল, সুনামগঞ্জ-২ এ জয়া সেনগুপ্তা, মৌলভীবাজার-৩ এ সৈয়দা সায়রা মহসীন, লক্ষ্মীপুর-৪ এ ফরিদুন্নাহার লাইলি, চাঁদপুর-৫ এ নূরজাহান বেগম মুক্তা, গাইবান্দা-২ এ মাহবুব আরা গিনি, যশোর-৬ এ ইসমত আরা সাদেক, বাগেরহাট-৩ এ হাবিবুন নাহার, বরিশাল-৫ এ বেগম জেবুন্নেছা আফরোজ, মুন্সীগঞ্জ-২ এ সাগুফতা ইয়াসমিন, ঢাকা-১৪ এ সাবিনা আক্তার তুহিন, মানিকগঞ্জ-২ এ কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, ঢাকা-১৭ আসন এ অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, ফেনী-৩ এ শমী কায়সার, ফেনী-৩ এ রোকেয়া প্রাচী, ঢাকা-১০ এ তারিন, ময়মনসিংহ-৩ এ জ্যোতিকা জ্যোতি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়াও অনেক নারী নেত্রী আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন লাভের প্রত্যাশায় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন। বিএনপি থেকে দলটির সভাপতি বেগম খালেদা জিয়ার ৩টি আসনে, কণ্ঠশিল্পী কনক চাঁপা, বেবী নাজনীন, আফরোজা আব্বাস মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া সাবিনা ইয়াসমিন (নাটোর-২), রুমানা মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সেলিমা রহমান (বরিশাল-৩), ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো (ঝালকাঠি-২), শাহিদা আক্তার রিতা (জামালপুর-১), আফরোজা খান রিতা (মানিকগঞ্জ-২), শিরীন সুলতানা (ঢাকা-৯), শামা ওবায়েদ (ফরিদপুর-২), হেলেন জেরিন খান (মাদারীপুর-২) ও হাসিনা আহমেদ (কক্সবাজার-১)। বিলকিস জাহান শিরিন (বরিশাল-৫), জেবা আহমেদ খান (ঝালকাঠি-২), শাহরিয়া ইসলাম শায়লা (ফরিদপুর-৪), তাহমিনা আওরঙ্গ (শরীয়তপুর-৩), সাবেক সংসদ সংসদ রেহানা আক্তার রানু (ফেনী-২), আয়েশা সিদ্দিকা মানী (বাগেরহাট-৩), ব্যারিস্টার সাকিলা ফারজানা (চট্টগ্রাম-৪), রাশেদা বেগম হীরা (চাঁদপুর-৪), তানজীন চৌধুরী লিলি (ময়মনসিংহ-৩), হোসনে আরা গিয়াস (কিশোরগঞ্জ-১), নিলোফার চৌধুরী মনি (জামালপুর-৫), নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা (সিলেট-২), শাম্মী আক্তার (হবিগঞ্জ-৪) আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন মর্মে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। জাতীয় পার্টি থেকে বেগম রওশন এরশাদ, সালমা ইসলাম মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন পার্টি অফিসে। জাসদ (ইনু) ফেনী-১ আসনে সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, নেত্রকোনা-৫ আসনে সহ-সভাপতি লুৎফা তাহের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য দলের নারী নেত্রীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আশায় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নারী নেত্রীরা মনে করছেন, দলে তাদের দীর্ঘদিনের অবদান ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের কারণে নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থিতার সুযোগ পাবেন এবং দল তাদের মূল্যায়ন করবে। নারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সারাদেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে এবং কর্মীরা নতুন প্রার্থীদের নির্বাচনী মাঠে বরণ করে নিতে উজ্জীবিত। এখন দলের নীতিনির্ধারকরা তৃণমূলের মতামত ও দেশী-বিদেশী জরিপের ভিত্তিতে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর নির্ভর করে ক্লিন ও স্বচ্ছ ইমেজের নারী নেত্রীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ প্রদান করবে এমনটাই প্রত্যাশা আমজনতার। আনুপাতিক হারে দেশের সব ক’টি নির্বাচনে প্রত্যেক দল থেকে পুরুষের ন্যায় নারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নকে উদ্বুদ্ধ করা হবে। প্রসঙ্গত, কূটনীতিক, দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকার সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে নারীর ক্ষমতায়নকে সার্থক ও সাফল্যম-িত করার সপক্ষে জোর দাবি জানিয়ে আসছে। দলীয় সাংগঠনিক কাঠামোকে আরও মজবুত ও সুসংহত এবং নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করতে নারীদের লাইম লাইটে নিয়ে এসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তা ছাড়া নারীদের নেতৃত্বগুণের বিকাশ এবং সর্বক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের সুযোগ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব হবে না। কারণ, যে দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী সেখানে নারীদের মূল স্রোতে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে জাতীয় অগ্রগতি এবং উন্নয়ন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো সভা, সমাবেশ, সেমিনারে নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য প্রদান করে থাকে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে হীনম্মন্যতা দেখা যায়। তবে এ কথা সত্য যে, দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রদানের ক্ষেত্রে নারীদের কিছুটা হলেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, একাদশ সংসদ নির্বাচনেও নারীদের প্রাধান্য দিয়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে দেশপ্রেমিক, মেধাবী এবং পরিশ্রমী নারীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসার আগ্রহ দেখাবে এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার মাধ্যমে নারীদের নেতৃত্বগুণ ও ক্ষমতায়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। যদিও বিগত কয়েকটি সংসদে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে নারীদের মুখ্য অংশগ্রহণ ছিল কিন্তু জাতীয় সংসদে শতাংশের হারে নারীদের অবস্থান ছিল সামান্যই। এ ব্যবধান দূর করে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করে জাতীয় রাজনীতিতে নারীদের বেশি সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হবে। তা হলেই তৃণমূল থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রত্যেকটি পর্যায়ে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নারীর নেতৃত্বগণ, দক্ষতা ও ক্ষমতায়নকেই প্রলুব্ধ করবে।
×