ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহাস্থানের বুকে আলো জ¦লল

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

মহাস্থানের বুকে আলো জ¦লল

প্রাচীন নগরী মহাস্থান চরিত্রে এলেন আসাদুজ্জামান নূর। দর্শকশ্রোতা তাকে দেখল না। শুনল ভরাট কণ্ঠস্বর- ‘আড়াই হাজার বছর আগে জেগে উঠেছিলাম। এতটা কাল আমার অন্তরের কথা তুলে ধরেছি। তোমরা আজ আমার বুকে এসে আলো জ¦ালিয়ে দিলে।’ তখন রাত। চারদিক থেকে জ¦লে উঠল বর্ণিল আলো। আলোকময় হয়ে উঠল ভাসুবিহারের ২০ হাজার বর্গফুট এলাকা। প্রতœ স্থাপনা ভাসুবিহারই মঞ্চ। বিশে^ বাংলাদেশই প্রথম প্রত্নস্থাপনায় প্রত্ন নাটক মঞ্চায়িত করে রূপাতীত ধারা নিয়ে এল। রইল কালের সাক্ষী হয়ে। প্রমাণ করে দিল যেখানেই প্রাচীন স্থাপনা, সেখানেই জীবন্ত করে তোলে প্রত্ন নাটক। যে স্থানেই ঘটনার কালক্রম সেখানেই নাটক। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রত্ন নাটক মঞ্চায়ন করে বিশ্বে ইতিহাস নাটক মঞ্চায়নের পুরনো কনসেপ্ট পাল্টিয়ে দিয়েছে। প্রতœ নাটক আবির্ভূত হলো রূপেরও অতীত হয়ে। যা মঞ্চায়িত হলো ২৩ ও ২৪ নবেম্বর বগুড়া নগরী থেকে উত্তরে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে মহাস্থান, সেখান থেকে আরও ৭ কিলোমিটার দূরে প্রত্ন স্থাপনা ভাসুবিহারে। বগুড়ার ইতিহাস খ্যাত পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী পুন্ড্রনগর মহাস্থনগড়। যা দেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগরী হিসাবে পরিচিত বহুকাল ধরে। ১৬টি কালের অধ্যায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাস্থানগড় ও তার আশপাশের বিরাট এলাকা। গেল শতকের নব্বইয়ের দশকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের খননে ভাসুবিহার উন্মোচিত হয়। বের হয়ে আসে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধদের কীর্তি উচ্চতর বিদ্যাপিঠ। প্রতœ খননে প্রতিবারই প্রাচীন ইতিহাসের বর্ণিল পাতা বের হয়ে আসছে। সমৃদ্ধ করে তুলছে বাঙালীর ঐতিহ্যের বিশাল ভা-ার। শিল্পকলা একাডেমি মহাস্থনের প্রাচীন ইতিহাসের সেই মহাভা-ার তুলে ধরল। নাটকের রচয়িতা সেলিম মোজহার মহাস্থনের ইংরেজী নামকরণ করেছেন ‘দ্য গ্রেট ল্যান্ড’। অসাধারণ এমন একটি নাটককে ‘দ্য গ্রেট ড্রামা অন দ্য আর্থ’ বলা যায়। গতানুগতিক ধারার ফরমেট ভেঙ্গে শৈল্পিক রূপের এই নাটকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কয়েকটি রঙের সার্চ লাইটের বিন্যাস। ব্যতিক্রমী এমন আলোক সম্পাতে দর্শকরা ফিরে গিয়েছিল সেই যুগে। যেমন- আর্যদের কালে কৃষি সভ্যতার বিবর্তনের পালায় শিল্পীরা মাথইল মাথায় সেদিনের পোশাকে যখন ফসলের মাঠে কাজ করছিল তখন ঘাসের ওপরে সবুজ আলো তার পাশেই সোনালি আলো ফেলে এমন দৃশ্যপট তৈরি করে। মনে হয়েছিল এ যেন কোন ফসলের মাঠ। পরের দৃশ্যে আদিকালের শোষক শ্রেণী ও প্রভু সামন্তদের নাট্যদৃশ্য ভাবাবেগ তৈরি করে। এরপরই মণিপুরী নৃত্যনাট্যের ধারায় মাছ ধরা গরুর দুধ দোয়নো, কৃষকের কাজ কিষাণবধূর কাজসহ মানব জীবনের আলেখ্য প্রবাহ তুল ধরা হয়। নটকের কালের একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে যেতে ইতিহাসকেই পালাক্রমে সাজানো হয় আলোক সম্পাতের সঙ্গে ধারণ করা ঐতিহাসিক চিত্রপট। যা তুলে ধরা হয় মাল্টি মিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে মঞ্চে বড় পর্দায়। নাটকের নির্দেশক শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী জানালেন, বিশে^ বাংলাদেশই প্রথম প্রতœস্থাপনায় গিয়ে এভাবে প্রতœ নাটক করছে। ইতিহাস ঐতিহ্য কৃষ্টি ও কীর্তির পটভূমিতে উপস্থাপিত এই নাট্যপ্রয়াসই প্রতœ নাটক। যা এক বিশেষ নাট্য প্রকরণ। এর বৈশিষ্ট্য- স্পেসই কথা বলে। বিশে^র দেশে দেশে লাইট ও সাউন্ডের সংমিশ্রিত প্রজেকশনে প্রতœ ইতিহাস তুলে ধরা হয়। আমরাই প্রথম শুধু শব্দ ও আলো দিয়ে নয়, নাট্যাঙ্গিকের যাবতীয় কথা কসরতের যথার্থ প্রয়োগে কালের বিবর্তন দৃশ্যমান করেছি। মহাস্থানগড়ে আছে ১৬টি কালের ইতিহাস। তারই একাংশ ভাসুবিহার ছিল বৌদ্ধদের কীর্তি। সেই স্থাপনাতেই মঞ্চস্থ হলো প্রতœ নাটক মহাস্থান। নাটকটিকে মহানাটক বলা হয়েছে। নাট্য নির্দেশকের কথার বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া গেল নাটকে। কালের বিবর্তনের বিষয়, পোশাক, সেদিনের হাতিশালের হাতি, ঘোড়াশালের ঘোড়া প্রাচীন যুগের ইতিহাসের সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের সঙ্গে ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন তুলে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে বাঙালী জাতির আড়াই হাজার বছরের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বহু গৌরবময় বর্ণাঢ্য ইতিহাস মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রতœনাটকের প্রদর্শনের স্পেস ছিল দুইটি। স্টেজ-১ পারফর্মে ছিল ভাসুবিহারের তিনটি স্থাপনা। স্টেজ-২ স্টেজ -১ এরই সম্পূরক। রেপ্লিকা বলা যায়। কালের ও যুগের রাজাদের ঘটনা বিহারের ওপরে। এর ওপর ভিত্তি করেই মঞ্চায়িত হয় যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা। রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়ার নাট্যরূপ ছিল বিহারের নিচের স্পেসে। মনে হয়েছিল ইতিহাসের ঘটনার সত্যরূপায়ন। নাটকের আখ্যানে গৌতম বুদ্ধ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌলিক উপাদানের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে লোকগাথা, লোকশ্রুতি, কল্পনা, কিংবদন্তিসহ বহু সাংস্কৃতিক উপাদান। কয়েকটি কালের যাত্রার বহু চরিত্রের আগমন ঘটেছে। ঘটনাবলি ১২টি আখ্যান। যার উপাখ্যান বিন্যাস ছিল ২৪টি। বড় বৈশিষ্ট্য- যে কোন আখ্যান বা উপাখ্যান থেকেই গড়ে উঠতে পারে নৃত্যনাট্য। সেই বিষয়টিও দর্শক বিশেষ করে নাট্যকর্মীদের মনে আসন করে নিয়েছে। আড়াই হাজার বছর আগের শিকড় ও কালের পোশাকের বৈচিত্র্য ও বিবর্তন তুলে আনা হয়েছে। এর মধ্যেই ছিল আমাদের সঙ্গীতের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, নানা জাতি ধর্মের সংঘর্ষ মিলন মহামিলন। এত কিছুর ভেতর দিয়ে সম্প্রীতির জায়গাটি নাটকে আঁকা হয়েছে। যার মূলমন্ত্র ‘সবার ওপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই।’ নাটক দেখে মনে হয়েছে এ যেন কোন ইতিহাস রং তুলি দিয়ে মঞ্চ নামের ক্যানভাসে ছবি এঁকে দিচ্ছে। প্রাচীন শিকারযুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, রামায়নের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিসামা, বৈষ্ণব পদাবলি, ব্রাহ্মসঙ্গীত, লোকগান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ব্রতচারীর গান, পঞ্চকবির গান, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস কাব্যগীত ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপস্থাপিত হয়। যা প্রজন্মকে ইতিহাস জ্ঞানে ঋদ্ধ করার পাশাপাশি বাঙালী জাতি সত্তার ইতিহাস, বাঙালী জাতির নানা কীর্তি অর্জন হৃদয়ে গেঁথে দেবে। সম্প্রীতির সহাবস্থানের আলোকিত আধ্যায় ছিল মহাস্থান প্রতœনাটকে। বাংলাদেশে প্রতœ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে। এক ঘণ্টার এই নাটকের নাম ছিল সোমপুর কথন। এরপর নরসিংদীর উয়ারী বটেশ^রে একই বছরের ৬ জুন মঞ্চস্থ হয় দ্বিতীয় প্রতœ নাটক। ভাসুবিহারে সোয়া দুই ঘণ্টার তৃতীয় প্রতœ নাটক ‘মহাস্থান’ মঞ্চায়িত হলো। কিছুটা ত্রুটি চোখে পড়ার পরও মনে হয়েছে কোন কিছুই বিতর্কের উর্ধে নয়। তারপরও বলতেই হবে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এমন একটি নাটক অবশ্যই প্রশংসা পাবে। যাকে মহানাটক বলা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদকের পাহাড়পুরে প্রথম প্রতœ নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এক ঘণ্টার সেই নাটকে সেদিনের হাতিশালার হাতি ঘোড়া মঞ্চে ছিল। আলোকসম্পাত ছিল অসাধারণ শৈল্পিক। যা মহাস্থান নাটকে পাওয়া যায়নি। বগুড়ার মহাস্থানগড়কে ২০১৬ সালে এক বছরের জন্য সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পর শিল্পকলা একাডেমির বড় পরিকল্পনায় মহাস্থান প্রতœনাটকের কাজ শুরু হয়। কথা ছিল বিশে^র অতিথিদের সামনে মহাস্থান নাটক প্রদর্শন করা হবে। এই প্রস্তুতির মাঝপথে সার্কের কালচারাল রাজধানী কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত হয়। তবে নাটক মঞ্চায়নের গবেষণা মহড়া ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলতে থাকে। বগুড়া ও ঢাকার প্রায় সাড়ে তিনশ’ শিল্পী ও কলাকুশলী এই নাটকে অংশগ্রহণ করছে। প্রতœস্থপনায় নাটক মঞ্চায়ন ছিল চ্যালেঞ্জ। মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। প্রতœ নাটকের প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যজন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান, নাট্যজন অধ্যাপক আব্দুস সেলিম, প্রতœতত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ আলতাফ হোসেন, নাটকের শেষ দৃশ্য ছিল মূকাভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন। আলোকসম্পাত এমন ছিল মনে হয়েছে, আঁধার ভেদ করে আলোকিত ভুবন চলে এল। এ সময় কণ্ঠে ভাসে সৈয়দ শামসুর হকের কবিতা ‘আমি তো এসেছি...। আমি জন্মেছি বাংলায়। আমি বাংলায় কথা বলি। আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি.....।
×