ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

ঐতিহাসিক মহাস্থান

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

ঐতিহাসিক মহাস্থান

ইতিহাস কথা কয় ইতিহাস অবিরত মানুষের মনে মনে বয় ইতিহাস সব আঘাত সব দুঃখ সয় তারপর একদিন, দুই হাতে তুলে নেয় চূড়ান্ত বিজয় তুমি যত শক্তিশালী হও কৃতদাস, দেব না, দেব না মুছতে বাঙ্গালীর দৃপ্ত ইতিহাস কবি যথার্থই বলেছেন। ইতিহাস কখনও মুছে যায় না। তবে কখনও কখনও ইতিহাস চাপা পড়ে থাকে। ইতিহাসকে লালন করতে হয়। বঙ্গদেশের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ইতিহাস। কালের বিবর্তনে আর সামরিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এই ইতিহাস কিছু সময় ভুল পথে হেঁটেছে। ফলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে একটা বড় ধরনের টানাপোড়েন ঘটে। সংস্কৃতির লীলাভূমি এই বাংলা আবার তার নিজস্ব ঢঙে ফিরতে শুরু করেছে। প্রতœনাটক ‘মহাস্থান’ এরই নিদর্শন। একেবারে ভিন্নধর্মী এই প্রযোজনা বাংলা মঞ্চনাটকের তথা বাংলা সংস্কৃতির একটা মাইলফলক। ড. সেলিম মোজাহারের রচনায় ও লিয়াকত আলী লাকীর নির্দেশনায় গত ২৩ ও ২৪ নবেম্বর বগুড়ার মহাস্থান গড়ে প্রযোজনাটি মঞ্চায়িত হয়েছে। সহকারী নির্দেশক হিসেবে সর্বক্ষণিক কাজ করেছেন আব্দুল হালিম প্রামাণিক স¤্রাট। ৩৫০ জন কলাকুশলীর অংশগ্রহণে নির্মিত নাটকটি মহাস্থানগড়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নিদর্শন। আড়াই হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সে সঙ্গে শোষণ-নিপীড়ন ও মুক্তিসহ সব রসদের মিথষ্ক্রিয়ায় নাটকটি যেন নতুন প্রজন্মের কাছে এক অমূল্য দলিল। প্রাচীর ঘেরা মহাস্থানগড়ের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের নানা প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানীও ছিল। তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্য ধর্মের রাজারা এখানে রাজত্ব করেছেন। ঐতিহাসিক এ স্থানটি এক সময় ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ধর্মের বাণী বুকে নিয়ে কেউ যেমন মানবতার কথা বলেছেন, মানবপ্রেম ছড়িয়েছেন অন্যদিকে মানুষের অধিকার বিনষ্টও করেছেন। মহাস্থান গড়ের পরিচয়-বর্ণনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নাটক। ধারাবাহিক এ বর্ণনায় দর্শক খুব সহজেই জেনে নিতে পারে সঠিক ইতিহাস। মহাস্থানগড়ের ধারাবাহিক বর্ণনায় যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে সব দৃশ্য। এরপর বন্দনা সঙ্গীত ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে মূল প্রযোজনার সূচনা একেবারে বাঙালীর আদি রসাত্মক সংস্কৃতিকেই উপস্থাপন করে। বর্তমান প্রজন্ম আজ এই সংস্কৃতি থেকে বেশ দূরে। এই মহাস্থান নামক আখ্যান প্রজন্মের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে। প্রাচীন শিকার যুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, আদিবাসী পর্ব, রামায়ণের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিনামা, বৈষ্ণব পদাবলী, ব্রাহ্মসঙ্গীত, লোকগান ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা পালাগানরূপে একের পর এক মালা গেঁথে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমষ্টিগতভাবে এগুলোই আমাদের ঐতিহ্য। অসংখ্য সুরের বৈচিত্র্য দর্শককে নিয়ে যায় শেকড়ে। এ যেন মাটির গন্ধ। তাল, লয় ও সুরের মূর্ছনা আর সেই সঙ্গে লোকজ নৃত্য সত্যিই বড় রোমাঞ্চকর। আদি কবিদের এই কথন দর্শকদের যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। নাটকের নির্দেশক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘পৃথিবীতে এভাবে আর্কিও ড্রামার ইতিহাস নেই। এর কাজ প্রতœ ইতিহাসকে দৃশ্যকাব্যে রূপান্তরিত করে শিল্পে রূপ দেয়া। মহাস্থানের গৌরবোজ্জ্বল আখ্যানের ভেতর দিয়ে সমগ্র বাংলার মহাস্থান হয়ে ওঠার গল্প। মহাস্থান, কোটি বছরজুড়ে এ মাটির জেগে ওঠার কথা। হাজার হাজার বছর ধরে তার মানববসতির কথা। মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল। এ সময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে আসেন পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে। তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে এই রামনামক ব্রাহ্মণ দ্বারা নল পরাজিত হয় এবং তিনি রাজা হন। ইতিহাসে তিনিই পরশুরাম নামে পরিচিত। এরপর ফকিরবেশী আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র)-এর যুদ্ধ হয় এবং পরশুরাম পরাজিত হয়। ইতিহাসের পাশাপাশি নাটকের বিষয়বস্তুতে আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে সম্প্রীতি। বাঙালী যে চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল তার একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। সকল ধর্মের সম্মিলিত জনগণ হচ্ছে বাঙালী জাতি। পরস্পরের সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ ও দেশপ্রেম নিয়েই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জন্ম নিয়েছিল এই বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে ক্লান্তিহীন পরিশ্রম আর আন্তরিকতায় নানা পরিকল্পনা নিয়ে গড়তে শুরু করেছিলেন। মহাস্থান নাটকে এই বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ইতিহাসেরও কিছুটা বিচ্যুতি ঘটেছিল। তাই সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপনের একটি বড় উদাহরণ এই মহাস্থান নামক প্রতœনাটক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়াটা যাত্রার একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে। এখানে ইতিহাসের পাশাপাশি যাত্রা শিল্পের একটি বার্তা দেয়া হয়েছে। যাত্রা আজ তার সেই জৌলুস থেকে দূরে চলে গিয়েছে। একটা সময় যাত্রা ছিল এই উপমহাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি তথা বিনোদনের একটি বিশেষ মাধ্যম। বিশেষ করে শীতকালে জেলায় জেলায় এমনকি পাড়া-মহল্লায় যাত্রা উৎসব হতো। এপার ওপার বাংলার বিখ্যাত অপেরা অংশ নিত এসব যাত্রাপালায়। আবাল-বৃদ্ধবনিতা যাত্রা উপভোগ করত। সামাজিক এই যাত্রাপালাগুলো মানুষকে বিনোদন দেয়ার পাশাপাশি অনেক নৈতিক বার্তা দিত যা কিনা সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াতে সক্ষম হতো। যাত্রা যে আমাদের একটি শক্তিশালী বিনোদন ও ঐতিহ্য ছিল এ নাটকে তারই বার্তা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ দ্বারা বাংলা ভাগ, চাকমা বিদ্রোহ, রংপুর কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট, জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকা-, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর মার্শা ল, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭৫-এর ১৫ আগস্টসহ সব ইতিহাস পর্যায়ক্রমে উঠে এসেছে। পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকদের অবদান সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাইট উপাধি-প্রত্যাখ্যান, নজরুলের বিদ্রোহ, অতুল প্রসাদ, দ্বিজেন্দ্র লালের ভূমিকা। প্রতিটি লড়াই-সংগ্রামে আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্ট দেশাত্মবোধক গান, বিদ্রোহী গান, প্রেরণাদায়ক গান ও কবিতার ব্যবহার দর্শককে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। মনে করিয়ে দেয় অতীতকে। ধরিয়ে দেয় আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। সংস্কৃতি চর্চার লীলাভূমি এই বাংলা তৈরি হতে যত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেছে, যত লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে তা অনুধাবন করতে পারলেই দেশপ্রেম জেগে উঠবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। নাটকজুড়ে ছিল এরই প্রয়াস। দেশপ্রেম জাগ্রত হওয়া মানেই দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকা। সবাই তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারলেই স্বস্থান হতে প্রত্যেকেই দেশ গড়ায় অবদান রাখবে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করাই এখন সময়ের দাবি। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির থাবা থেকে দেশ রক্ষা করতে হবে। এই উপলব্ধিটুকু জাগাতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে। তাই সব প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি অঙ্গনসহ সকলে সম্মিলিতভাবে ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন করে দেশের সার্বিক কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করতে হবে। প্রতœনাটক মহাস্থান সৃষ্টি করেছে নবধারা। নাটক যে কত শক্তিশালী বার্তা দিতে পারে তা মহাস্থান প্রমাণ করেছে। এর আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগেই ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে দেবাশীষ ঘোষের নির্দেশনায় প্রথম প্রতœনাটক সোমপুর কথন মঞ্চস্থ হয়েছিল। এরপর ওই বছরের ৬ জুন নরসিংদী জেলার উয়ারী বটেশ্বরের প্রতœতাত্ত্বি¡ক নিদর্শনের ওপর নির্মিত ‘উয়ারী-বটেশ্বর’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। তানভীর আহমেদ সিডনির রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন স¤্রাট প্রামাণিক। তবে মহাস্থান নাটকে ইতিহাস ঐতিহ্যের ব্যাপকতা প্রকাশ পেয়েছে। মহাস্থান সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস।
×