ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে বেকায়দায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে বেকায়দায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে নতুন করে বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি দাবি করে বিএনপি কি করে স্বাধীনতাবিরোধী একটি দলকে নির্বাচনে নিজেদের প্রতীক দিয়ে দিতে পারে এ নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে দলীয় হাইকমান্ডের তোপের মুখে পড়ার আশঙ্কায় বিএনপির কোন নেতাকর্মী এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলছে না। উল্লেখ্য, সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করতে গিয়ে আগেই বড় ধরনের ধাক্কা খায় বিএনপি। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে বিএনপির সঙ্গে জোট হবে না বলে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কাশাল হোসেন ও যুক্তফ্রন্টের সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। অবশ্য বিএনপি কৌশলে ড. কামাল হোসেনকে পটিয়ে রাজি করাতে পারলেও অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এ দলটির সঙ্গে জোট না করে দূরে সরে যান। তবে ড. কামালকে বিএনপি কথা দিয়েছিল জামায়াত ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে থাকলেও বৃহত্তর জোটের সঙ্গে নির্বাচন না করে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলোর মতো জামায়াতকেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়। মঙ্গলবার রাতে জামায়াতের ২৫ নেতাকে ২৫টি আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে বিএনপির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য এ ২৫টি ছাড়াও আরও অন্তত ২০টি আসনে জামায়াত স্বতন্ত্র প্রার্থী দেয়। এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তবে দলীয় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এ নিয়ে বেশি মাতামাতি না করতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। তবে বিএনপি নেতাকর্মীরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোন কথা না বললেও জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এদিকে জামায়াতকে ধানের শীষ দিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ায় বৃহস্পতিবার নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন যুদ্ধাপরাধীকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতের সবাই যুদ্ধাপরাধী নয় জামায়াতেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে । নজরুল বলেন, বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই সরকারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র জমা দিতে আমাদের নেতাকর্মীদের পদে পদে বাধা দেয়া হয়। ছোট থেকে বড় সবাইকে আসামি করা হচ্ছে। অনেকেই নিখোঁজ হচ্ছে। এগুলো সবই সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। নজরুল বলেন, আওয়ামী লীগ একের পর এক ফাউল করছে। সরকার ও ইসি নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এভাবে চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের মতো আবারও একটি প্রহসনের নির্বাচন করতে সরকার গ্রেফতার বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে। তিন মাস আগে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারান্তরীণ তেজগাঁও থানা ছাত্রদলের নেতা আব্দুল্লাহ আল তামিম গাজীপুর জেলে বুধবার মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারের নির্যাতন এবং কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেল নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, অন্য নেতাদের পক্ষে কাজ করার জন্য অনেক সিনিয়র নেতা মনোনয়ন জমা দেননি। এটাকে আপনারা নির্বাচনী কৌশলও বলতে পারেন। ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ধানের শীষ দেয়া হবে না, এটা সবাইকে আশ্বস্ত করতে পারি। তবে জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়ার বিষয়টি নজরুল ইসলাম খান ব্যাখ্যা দিয়েও যে সামাল দিতে পারবেন না তা বোঝা গেছে তার পাশে বসে থাকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর অবস্থা দেখে। নজরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে যতক্ষণ জামায়াতের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন ততক্ষণ রিজভী গালে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে বসে থাকেন। হয়ত তিনি মনে মনে এটিই চিন্তা করেছিলেন জামায়াতকে ধানের শীষ দেয়ার মাসুল অনেক দিন গুনতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। তখন যুদ্ধাপরাধী দুই জামায়াত নেতা মতিউর রহমান ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেয় বিএনপি। আর এ সুযোগে দুই যুদ্ধাপরাধী তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে মহা দাপটে সর্বত্র নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেন। এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পরে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার এক বছর পর জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে টানা ৯২ দিন সহিংস আন্দোলন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এ সুযোগে সরকারও বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলে। এক পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের কাছে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে এড়িয়ে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীও জামায়াতকে দূরে রেখে চলতে পরামর্শ দেয়। এর পর গোপনে সখ্যতা রেখে প্রকাশ্যে কৌশলে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার অভিনয় করে বিএনপি। আর তা করতে গিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগের মতো জামায়াত নেতাদের পাশে বসানো থেকে বিরত থাকে বিএনপি। তবে জামায়াত এ নিয়ে বিএনপির প্রতি নাখোশ হয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোট ব্যাংকের হিসেব মাথায় নিয়ে আবারও জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে বিএনপি। দলের নিবন্ধন না থাকায় জামায়াত দলগতভাবে নির্বাচন করতে পারবে না দেখে বিএনপি নিজেদের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়। আর তা করতে গিয়ে নতুন করে সঙ্কটে পড়ে বিএনপি। এবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫টি আসন দেয়া হয়েছে। এ ২৫টি আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন বলে জানা গেছে তারা হলেন- আব্দুল হাকিম (ঠাকুরগাঁও-২), মোহাম্মদ হানিফ (দিনাজপুর-১), আনোয়ারুল ইসলাম (দিনাজপুর-৬), মনিরুজ্জামান মন্টু (নীলফামারী-২), আজিজুল ইসলাম (নীলফামারী-৩), গোলাম রব্বানী (রংপুর-৫), মাজেদুর রহমান সরকার (গাইবান্ধা-১), রফিকুল ইসলাম খান (সিরাজগঞ্জ-৪), ইকবাল হুসেইন (পাবনা-৫), মতিউর রহমান (ঝিনাইদহ-৩), সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের (কুমিল্লা-১১), হামিদুর রহমান আজাদ (কক্সবাজার-২), শামসুল ইসলাম (চট্টগ্রাম-১৫), আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদত হোসাইন (যশোর-২), আব্দুল ওয়াদুদ (বাগেরহাট-৩), আবদুল আলিম (বাগেরহাট-৪), মিয়া গোলাম পরওয়ার (খুলনা-৫), আবুল কালাম আযাদ (খুলনা-৬), রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), আব্দুল খালেক (সাতক্ষীরা-২), গাজী নজরুল ইসলাম (সাতক্ষীরা-৪), শামীম সাঈদী (পিরোজপুর-১), ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী (সিলেট-৫), হাবিবুর রহমান (সিলেট-৬) ও শফিকুর রহমান (ঢাকা-১৫)। তবে এর বাইরে যে ২০টি আসনে জামায়াত স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়েছে তাদের ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হবে না বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জোটের শরিক দল হিসেবে জামায়াতকে ২৫টি আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকায় জামায়াতকে দূরে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। আর এ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতকে বিএনপির দরকার আছে।
×