ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভাসানচর

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

ভাসানচর

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ প্রস্তুত নোয়াখালীর হাতিয়ার সেই ভাসানচর। এখন থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে জেগে ওঠা দ্বীপ। কোন জনবসতি ছিল না। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে সরকার উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় দেয়ার পর তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় সরকার যাবতীয় প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দিন যতই বিলম্বিত হচ্ছে ততই উখিয়া টেকনাফের জনপদ বিপর্যস্ত হচ্ছে। ফলে প্রত্যাবাসন শুরুর পাশাপাশি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য ভাসানচরকে প্রথম পর্যায়ে বেছে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বসবাসের প্রাক প্রস্তুতির যাবতীয় কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দফায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবির থেকে নিয়ে যাওয়ার টার্গেট রয়েছে। পরবর্তীতে আরও ২ লাখ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩’-এর আওতায় এ প্রকল্পের জন্য গত বছরের নবেম্বর মাসে একনেক অনুমোদন দিয়েছে ২৩শ’ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ওপর। প্রকল্প কাজ শুরু হওয়ার নয় মাসের মধ্যেই প্রথম দফায় ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তরের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পর প্রত্যাবাসনে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেখানে নৌবাহিনীর ২ শতাধিক কর্মকর্তা ও সৈনিক দিনরাত কাজ করে চলেছেন। ইতোমধ্যে ১৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস নির্মিত হয়েছে। অবশিষ্টগুলোর নির্মাণ কাজও এগিয়ে চলেছে। প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতিটি কক্ষের সাইজ ১৪ দ্ধ ১২ ফুট। যা জাতিসংঘের স্ট্যান্ডার্ড সাইজের চেয়েও বেশি। প্রতিটি হাউসে নির্মিত হচ্ছে ৫টি করে কক্ষ, যার সঙ্গে থাকছে টয়লেট বাথরুম ফ্যাসিলিটিজ। সারিবদ্ধভাবে নির্মিত হাউসগুলোতে ১৬ পরিবার থাকার ব্যবস্থা থাকছে। একটি পরিবারে সদস্য ধরা হয়েছে ৪ জন করে। সূত্র জানায়, নোয়াখালীর হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অধীনে ভাসানচরটির মোট আয়তন ১৩ হাজার একর। এরমধ্যে ১৭০২ একর বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের হুমকিমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ৪শ’ একরেরও বেশি এলাকায় বসবাসের জন্য বাড়িঘরসহ যাবতীয় সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। বাঁধের উচ্চতা রাখা হয়েছে বিগত ১শ’ বছরের ঝড় জলোচ্ছ্বাসের পরিসংখ্যান নিয়ে। করেছে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ২১ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল টিম প্রকল্প পরিদর্শন করে ব্যাপক সন্তোষ প্রকাশ করেছে। সূত্র জানিয়েছে, স্থানান্তরিত হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য সুয়্যারেজ, সেফটি ইত্যাদি সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পের মধ্যে ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে ১৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে। নৌবাহিনীর পক্ষে সেখানে ১০ সহস্রাধিক মহিষ, গরু, ছাগল, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রাণি লালন পালন করে চলেছে। শুধু তাই নয়, শুরুতে ১শ’ ভেড়া সেখানে নেয়া হয়, যা বেড়ে বর্তমানে ২শয়ে উন্নীত হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৮ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এ প্রকল্প সম্পন্নের কাজে লাগানো হয়েছে। পুরো এলাকাটি বিদ্যুতায়িত করা হয়েছে সোলার সিস্টেমে। এছাড়া প্রতিটি হাউস লাল টিনে আচ্ছাদিত। আকাশ পথে যাতায়াতকারী বিমানের পাইলটদের কাছে এটি এখন পথ নির্দেশক হিসেবেও কাজ করছে বলে জানিয়েছে সূত্র। এ প্রকল্পে ছাগল লালন পালনের পাশাপাশি মুরগি ফার্ম প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সেনা বর্বরতার মুখে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখা ১২ লক্ষাধিক হলেও সরকারী বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরের ২৫ আগস্টের রাতের পর বাংলাদেশের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৭ লাখ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিচয় দুভাগে বিভক্ত। ইতিপূর্বে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে তাদের মধ্যে ৩২ হাজার শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত। অবশিষ্ট সরকারী- বেসরকারী পরিসংখ্যানের সকল রোহিঙ্গা আশ্রিত হিসেবে রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সনদের আওতায় শরণার্থী ও আশ্রিত হিসেবে যে কোন বিদেশী নাগরিকের জন্য কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। যা বর্তমানে উখিয়া টেকনাফের ৩০ শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অনেকাংশে মানছে না। যে কারণে ওই এলাকার জনপদে এক বড় ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। চলছে অপপ্রচার এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটির বিপরীতে নানা অপপ্রচার শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের ২৮ নবেম্বরের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে, ‘লাইক এ প্রিজন ক্যাম্প দ্যান এ রিফিউজি হেভেন’। এ প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করে সরকারী প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘ইট উইল বি এ হেভেন ফর রোহিঙ্গা পিপলস’। প্রশাসন সূত্রে আরও জানা গেছে, অস্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা এ ভাসানচরে বসবাসের সুযোগ পাবে। ভবিষ্যতে এসব রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে গেলে এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩ এর আওতায় দেশীয়দের বসবাসের জন্য ছেড়ে দেয়া হবে। এ বিষয়েও সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ভাসানচর পরিদর্শনের কর্মসূচী ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার কারণে তা স্থগিত করা হয়। এরপরে গত ১৫ অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ ধার্য ছিল। কিন্তু আশ্রিত রোহিঙ্গারা সমস্বরে জানান দিয়েছিল তারা এই মুহূর্তে নিজ দেশে ফিরে যাবে না। ফলে প্রত্যাবাসন কর্মসূচী থমকে যায়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আগামীতে কখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার কোন দিনক্ষণ ঘোষণা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর মূল কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আগামী ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল। সরকারী-বেসরকারীসহ দেশবাসী এখন নির্বাচনমুখী। এ অবস্থায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সীমাবদ্ধ এলাকায় রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যা ধীরে ধীরে কার্যকর করা হচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনে কোন রোহিঙ্গা যাদের নিজেদের সংশ্লিষ্ট করতে না পারে সে লক্ষ্যেই এ তৎপরতা। এমনিতর পরিবেশে ভাসানচর প্রস্তুত হয়ে আছে স্থানান্তরযোগ্য রোহিঙ্গাদের জন্য। সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছে প্রথম দফায় ১ লাখ রোহিঙ্গা ভাসানচরে সাময়িক পুনর্বাসন করে তাদের জীবনযাপন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করবে। এ ঘোষণার আলোকেই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চৌকস কর্মীরা মাত্র ১১ মাসে রোহিঙ্গাদের বসবাসযোগ্য করে তুলেছে সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠা এ ভাসানচরকে। সূত্র জানিয়েছে, সরকার আগামীতে সিদ্ধান্ত নেবে আরও ২ লাখ রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের উপযোগী করা হবে। যেহেতু ১৩ হাজার একরের এ চরটির মাত্র ১৭শ’ একর বেড়িবাঁধের আওতায় এনে মাত্র ৪ শতাধিক একর প্রথম ধাপের ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। ডব্লিউএফপি, ইউএনএইচসি-আরসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি দল এ চর ও প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শন করে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। এ অবস্থায় বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা অপপ্রচার অত্যন্ত দুঃখজনক বলে সূত্রের অভিমত। সূত্র উদাহরণ দিয়ে জানিয়েছে, বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩০ আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের যে ব্যবস্থা রয়েছে সে তুলনায় ভাসানচর হবে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ‘হেভেন।’ প্রকল্প এলাকায় সাধারণ কোন মানুষের বসবাস নেই। কিন্তু বিপুল অঙ্কের অর্থব্যয়ে সরকার এই চরকে বসবাসের জন্য যে প্রক্রিয়ায় উপযোগী করে তুলেছে এটি রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইন রাজ্য বা উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় শিবিরের তুলনায় স্বর্গ সমতুল্য। কেননা, এদেশের দারিদ্র্যপীড়িত জনপদে বসবাসরত জনগণের সুযোগ-সুবিধার চেয়ে বহুগুণ বেশি মানসম্মতভাবে নির্মিত হয়েছে পরিবারভিত্তিক হাউস। যেখানে রয়েছে টয়লেট, বাথরুম, সুয়্যারেজ, ফ্যাসিলিটিজসহ যাবতীয় সুবিধা এবং এর পাশাপাশি জীবিকা অর্জনের প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে। কখন থেকে রোহিঙ্গাদের সেখানে নেয়া হবে তা এখনও নির্দিষ্ট করা হয়নি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িতদের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুরো ভাসানচর এখন প্রস্তুত। যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা এ চর থেকে নিজ দেশে ফিরে না যাবে ততদিন পর্যন্ত তাদের সেখানে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা সম্পন্ন হচ্ছে। মাত্র ১৫ শতাংশ কাজ এখন বাকি রয়েছে। রাতের বেলায় আলো ঝলমলে এই ভাসানচর আগামীতে একটি পর্যটন কেন্দ্রেও রূপ নিতে পারে বলে প্রশাসনের বিভিন্ন সূত্রের অভিমত।
×