ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরপেক্ষতার নামে বিএনপি জোটের পাতা ফাঁদ!

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

নিরপেক্ষতার নামে বিএনপি জোটের পাতা ফাঁদ!

জোসেফ গোয়বেলস হিটলারের প্রোপাগাণ্ডা মিনিস্টার বলেছিলেন, ‘যদি আপনি বড় বড় মিথ্যা কথা বলেন এবং ক্রমাগত এর পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন তবে মানুষ অবশেষে এটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ জন্মের পর থেকেই মিথ্যাচার বিষয়ে গোয়েবলসকে অনুসরণ করেছে বিএনপি নামের দলটি। ক্ষমতায় বসবার পর থেকেই তারা মিথ্যাচার শুরু করেছে ‘মুজিব’ এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে। তারা বলেছে শেখ মুজিব দেশে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন বলে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এবং জিয়াউর রহমানই হলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। ইতিহাস সাক্ষী ’৭০ সালে এক ঐতিহাসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবের দল ক্ষমতায় এসেছিল। এরপর ’৭১ সালের ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন করার পর দেশের নানা দল নিয়ে ’৭৩ সালে সার্বভৌম সংসদের নির্বাচন দেয়া হয়েছিল। অথচ তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক পোশাক পরিধান করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দুক কাঁধে সেনাবাহিনী প্রধানের তকমা নিয়ে বসেছিলেন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে কোন নির্বাচনী সনদ নিয়ে আসেননি। পরবর্তীতে ’৭৭ সালে ‘হ্যাঁ-না’ নামে এক হাস্যকর ভোটের মধ্য দিয়ে তার ক্ষমতা পোক্ত করার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর মসনদে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি দল গঠন করেছিলেন সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিবর্গ নিয়ে সেকথা ইতিহাস সচেতন জনগণ জানেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষে যে জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠনের চরম নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ভূমিকার কথা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়, তাদের দলের পালের গোদা আমিরকে পাকিস্তান থেকে তিনি সংগোপনে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং তার স্ত্রী সেই গোলাম আযমকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। প্রকৃতপক্ষে জন্মের আজন্ম পাপের মতো এখন পর্যন্ত তারা একই কায়দায় আসন্ন নির্বাচন নিয়ে চলছে তাদের মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনা। কিন্তু বিএনপির খয়েরখাঁরা কি কম সরেস। এর প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে ড. কামাল হোসেন বর্তমানে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চরম অসত্য বলে চলছেন। বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া এক শূন্য আসনে জয়লাভ করা ছাড়া তার জীবনভর নির্বাচনের জগতে পাওনা গ-া আর কিছু ছিল না। পাওনা না থাক দেনার ভারটি যে পরিপূর্ণ ছিল সেটা না বললে বোধ হয় ভুল করা হবে। নির্বাচনে জামানত বাজেয়াফত হবার দেনার দায়ে আসলে তার নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করার কথা। যদিও ড. কামাল হোসেন নামের একবারের নির্বাচিত আইনজ্ঞ দীর্ঘ প্রায় তিন দশকে নিজে যে সমস্ত রাজনৈতিক পার্টি গঠন করেছেন সেগুলো নিয়ে অনেক মানুষ তাকে বরাবরই এক নেতা ও এক ভোটের দল হিসেবে তামাশা করেন। কিন্তু সেসব কথা ভুলে গিয়ে তিনি গোচরে হোক অগোচরে হোক এক কৌতুক করলেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। যাকে বলা যায় ‘মায়ের কাছে মাসির গল্প’ শুধু নয় মাসি সম্পর্কে মাকে নতুন করে জ্ঞান দান করা। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটেনের হাইকমিশনারকে সম্প্রতি এমন কায়দায় গল্প শোনাচ্ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বলে কথিত আইনজ্ঞ কামাল সাহেব। আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, কোন খেলায় খেলোয়াড় কখনও রেফারি হতে পারে না। তিনি আরও বললেন, ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে তা গণতন্ত্রসম্মত হবে না। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় হঠাৎ করে বিএনপির মতো দেশের অন্যতম বড় দলের নেতৃত্বাধীন জোটের নেতা বনে গিয়ে তিনি এখন এতটাই বেচায়েন যে ভুলেই গিয়েছিলেন ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হচ্ছে ইংল্যান্ড। শত শত বছরের ধারাবাহিকতায় ক্রমে ক্রমে সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান রূপ লাভ করেছে। সেই পদ্ধতিতে সরকারের মেয়াদপূর্ণ কিংবা ক্ষমতাসীন দলের প্রয়োজন পড়লে আগাম নির্বাচন দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সর্বাঙ্গীণ দায়িত্ব থাকে দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের। ভোট গ্রহণ সম্পন্নের পর নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত পুরনো সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। ব্রিটেনের এই রীতি পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ছাড়াও অস্ট্র্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডসহ বহু গণতান্ত্রিক দেশ। এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল ডেমোক্রেসিতেও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যাবতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়। সম্ভবত পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র সম্পর্কে এমন ছবক পেয়েই কি ব্রিটিশ হাইকমিশনার বিশাল তকমার আন্তর্জাতিক বিখ্যাত আইনজীবী হিসেবে কথিত কামাল হোসেনের সঙ্গে মাত্র ১৯ মিনিটে বৈঠক সাঙ্গ করে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে কেটে পড়েছেন। অথচ ঢাকার পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে ইতোপূর্বে বিকল্পধারার ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে একই হাইকমিশনার নির্বাচন নিয়ে প্রায় দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা আলোচনাই শুধু নয়, সেরেছিলেন মধ্যাহ্ন ভোজও। কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করতে বিএনপি বাধ্য হয়েছিল সেটা সচেতন মানুষ জানেন। কারণ, দেশে এমনকি নিউইয়র্কেও সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেয়া খালেদা জিয়ার সেই অবিস্মরণীয় বাণী ‘পাগল এবং শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হতে পারে না’ এখনও আছে দেশ বিদেশের খবরের কাগজের পাতায়। শুধু তাই নয়, দেশে নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির উৎসব হয়েছিল তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল বিএনপির নেতৃত্বে মাগুরা উপনির্বাচনের মাধ্যমে। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের ওপর অত্যাচার, শারীরিক নিগ্রহ ও বল প্রয়োগ করে ভোট কেন্দ্র থেকে কর্তব্যরত পোলিং অফিসারসহ নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করে ব্যালেট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে ধানের শীষে সিল মারার মহোৎসব শুধু নয়, তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাগুরা থেকে জীবন সংশয়ের আশঙ্কায় ঢাকায় পালিয়ে আসেন। এমতাবস্থায় জনগণের উত্তাল প্রতিবাদে ও আন্দোলনে বিএনপি বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চালু করতে। নিজেদের বিতর্কিত এমন ভূমিকায় সেই পদ্ধতিটিকেই তারা পচিয়ে ফেলেছে। আর তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন স্বয়ং তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়ে সেই ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে কবর রচনা করেছিল সেই পদ্ধতির। এখানেই শেষ নয়, জনগণের প্রতি আস্থা না থাকায় ভোটাধিকার হরণের উদ্দেশে বিএনপি আমলে এক কোটি ৪০ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরি হয়েছিল। যার বিরুদ্ধে সে সময় ড. কামাল হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। এখন মজার কথা, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু নিয়ে তারা দিচ্ছে ব্যাঘ্র হুঙ্কার। অথচ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বপ্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা দেখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধি দল সন্তুষ্টি ব্যক্ত করে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচনী কমিশনার যখন বলছেন তারা সকল পক্ষের জন্য লেভেল প্লেয়িংয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। যাতে করে তালিকাভুক্ত ভোটাররা নির্বিঘেœ ভয়-ভীতিহীনভাবে ভোট প্রয়োগ করতে পারেন এবং তারা যাদের ভোট দেবেন তারাই গঠন করবেন সরকার। কিন্তু কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট না হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা করে চলছে একের পর এক নতুন নতুন দাবিতে উদ্বাহু নৃত্য। মির্জা ফখরুল, মওদুদ ও রিজভী সাহেবরা সকাল-সন্ধ্যা লেভেল প্লেয়িংয়ের নামে অসত্য ও উদ্ভট অভিযোগ তুলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবকে পদত্যাগ বা রিপ্লেসের কথা বলছেন আর সেই সব দাবি একনিষ্ঠ খয়ের খাঁ ঐক্য প্রক্রিয়ার আইনজ্ঞ নেতা কলের গানের মতো বাজিয়ে চলেছেন। সেসব অযৌক্তিক দাবির উদ্দেশ্য হচ্ছে ভয় দেখানো ও চাপের মুখে রেখে ইসির নিরপেক্ষ উদ্যোগ ভেস্তে দিয়ে তালগোল পাকানো এবং নিজেদের খায়েশ মতো নির্বাচন করা। তাদের এই অপকৌশল সম্পর্কে ইসিকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ- মানুষ বিএনপির মাগুরা মার্কা নয়, চায় পছন্দের আদর্শিক প্রার্থীকে ভোট দেবার অধিকার। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×