ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

’৭১-এ ড. কামালের রহস্যময় ভূমিকা!

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

’৭১-এ ড. কামালের রহস্যময় ভূমিকা!

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার ছক রচনার জন্য যখন পাকিস্তানী জেনারেলরা সিলেটের এক চা বাগানে বৈঠক করেছিলেন সেখানে ড. কামালকেও দেখা গেছে বলে উল্লেখ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাসির উদ্দিন ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ নামক মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তার গ্রন্থে। এছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠ্ঠা তার আত্মজীবনীমূলক পুস্তক ‘আনলাইকলি বিগিনিংস’-এ লিখেছেন যে, ড. কামালের অনুরোধে তিনি ড. কামালকে ২৮ মার্চ সেনাবাহিনীর ডিভিশনাল সদর দফতরের মেসে প্রহরীসহ নিরাপদে অবস্থান প্রদান করেন। ব্যারিস্টার আমিরের গাড়ি থেকে কেটে পড়েছিলেন ড. কামাল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থের ১৯ ভলিউমে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে যে, ব্যারিস্টার আমির এবং শহীদ তাজউদ্দীন ড. কামালকে নিয়ে ২৫ মার্চ রাতে গাড়িতে করে পশ্চিম বাংলার উদ্দেশে কুষ্টিয়ার পথে ঢাকা থেকে রওনা হন। যাত্রা শুরুর পরপরই ড. কামাল তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে যান যে, তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন। ব্যারিস্টার আমির এবং শহীদ তাজউদ্দীন এরপর গাড়ির ভেতরেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু ড. কামাল আর ফিরেননি। অবশেষে তারা দু’জনই কুষ্টিয়ার পথে এগুতে থাকেন। এরপর আর ড. কামালের কোন খবর পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর অবশ্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তান থেকে ফিরে এলে জানা গেল তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানেই ছিলেন- যে দেশে তার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু তিনি কিভাবে পাকিস্তান গেলেন, কোথায় ছিলেন- এ প্রশ্নগুলো অন্ধকারেই থেকে গেল। এ প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া গেছে পাকিস্তান স্পেশাল সার্ভিসের যাকে স্থপতি বলা হয় সেই মেজর জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠ্ঠার উপরে উল্লিখিত বইটিতে। পাকি জেনারেল মিঠ্ঠা ড. কামালকে নিরাপদে আশ্রয় দিয়েছিলেন ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাতের কয়েকদিন পূর্বে জেনারেল ইয়াহিয়া মেজর জেনারেল মিঠ্ঠাকে ১২ দিনের জন্য বাংলাদেশ পাঠিয়েছিলেন বিশেষ দায়িত পালনের জন্য। ড. কামাল সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা হলো এই যে, তার বাংলাদেশ ভ্রমণের শেষদিকে ড. কামালের ভগ্নিপতি আমানউল্লা, যিনি মেজর মোহাম্মদ কামালের চাচা/মামা, তাকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেন, সেই ডিনারে ড. কামাল, রেহমান সোবহান এবং টুল্লু নামক এক ব্যবসায়ীও উপস্থিত ছিলেন। ড. কামাল এবং রেহমান সোবহান জানতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্দেশ পেলে একশনে যাবে কিনা। জেনারেল মিঠ্ঠার উত্তর ছিল, সেই পরিস্থিতিতে পাকি সৈন্যদের কোন বিকল্প থাকবে না। জেনারেল মিঠ্ঠা আর এক জায়গায় লিখেছেনÑ ১৯৭১-এর ২৮ মার্চ তিনি ড. কামালের ভগ্নিপতি আমানের কাছ থেকে একটি বার্তা পান। বার্তায় আমান বলেছেন যে, তিনি (আমান) তার স্ত্রীর ভ্রাতা ড. কামালের কাছ থেকে এই মর্মে একটি বার্তা পেয়েছেন যে, ড. কামাল অন্যদের সঙ্গে ভারতে চলে যাননি। তিনি চাচ্ছেন তাকে (ড. কামালকে) যেন নিরাপদ হেফাজতে নেয়া হয়। কারণ ড. কামাল তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত তিনি ভাবছেন অন্যরা তাকে খুন করবে। সেদিনই জেনারেল মিঠ্ঠা ড. কামালকে ডিভিশনাল সদর দফতরের মেসে গার্ডের পাহারাসহ নিরাপদে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং পরদিন তাকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। জেনারেল মিঠ্ঠা আরও লিখেছেন যে, ড. কামাল এবং রেহমান সোবহান কারোরই রক্ত ঝরেনি, বরং ড. কামাল তাদের ভয়েই শঙ্কিত ছিলেন যাদের তিনি তার শত্রু বলে মনে করেছেন এবং মুজিব যখন খুন হন তখন কামাল এবং সোবহান উভয়েই অতীতের অনুশীলনীরই পুনরাবৃত্তি ঘটান, কামাল যুক্তরাজ্যে এবং সোবহান যুক্তরাষ্ট্রে গা ঢাকা দেন। মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা উল্লেখ করেছেন যে, ড. কামালের ভগ্নিপতি আমানউল্লা তার (মিঠ্ঠার) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এবং সে (আমানউল্লা) ছিল মেজর মাহমুদ কামালের চাচা/মামা এবং সেই সুবাদেই আমানের সঙ্গে তার পরিচয়। যদিও জেনারেল মিঠ্ঠা মেজর মাহমুদ কামাল পাকিস্তানী ছিলেন কি-না এ কথা লেখেননি, তবুও মিঠ্ঠার লেখায় এমন ইঙ্গিত বহন করছে যে, তিনি পাকিস্তানী। এখানে আরও দুটি কথা উল্লেখযোগ্যÑ প্রথমটি হলো ড. কামালের স্ত্রী পাকিস্তানী, তার শ্বশুরবাড়ি পাকিস্তানে এবং বহু বছর বাংলা ভাষায় অনুশীলন নেয়ার পরে এখনও ড. কামাল ভাল করে বাংলা পড়তে বা লিখতে পারেন না। সোজা কথায় তাকে বাঙালী বলা যায় কি-না সেটাই এক বড় প্রশ্ন। ২৫ মার্চের সন্ধিক্ষণে ড. কামাল এবং পাকিস্তানী জেনারেলরা একই সময়ে একই সরকারী ভিআইপি ভবনে। ’৭১-এ ড. কামালের ভূমিকা সম্পর্কে আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাসির উদ্দিন তার লেখা বইয়ে, যার নাম ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’। তার লেখনী থেকে যা জানা যায় তা হলো, তিনি ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে রংপুর সেনানিবাসে সামরিক কর্মজীবন শুরু করেন। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেনানিবাসগুলোর অভ্যন্তরেও বৃদ্ধি পায় সামরিক তৎপরতা, গোয়েন্দা তৎপরতা। ‘প্রতিটি বাঙালী সৈনিকের গতিবিধি এবং কথাবার্তার ওপর সতর্ক মনোযোগ রাখা হচ্ছিল। বেশ একটা থমথমে ভাব সেনানিবাসের ভেতরে।’ নাসির দেখতে পেলেন ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল ঘিরে সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা। ‘এর পরই রংপুর সেনানিবাসে এক বড় মহড়ার পরিকল্পনা হঠাৎ করেই স্থির হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তের ওপারে ভারতীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ। ‘তিতুমীর’ নামের এই মহড়াটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৪ পদাতিক ডিভিশনের চারটি ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত অধিকাংশ অফিসারই এই মহড়ায় অংশ নেন।’ ‘তিতুমীর’ মহড়া শেষ হওয়ার পর একদিন হঠাৎ কর্নেল সাগির তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট নাসিরকে ডেকে অবিলম্বে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বললেন, শ্রীমঙ্গল পৌঁছে ইপিআর’র সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সেকান্দারের সঙ্গে বিশেষ বার্তার বিষয়ে সত্বর যোগাযোগ করতে এবং ভারত সীমান্ত সংলগ্ন দোলই, কুরমা ও মাধবপুরে বনমোরগ ও বুনোহাঁস শিকারের স্থানগুলো চিহ্নিত করতে। নাসির (সে সময়ের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট) শ্রীমঙ্গল পৌঁছে কর্নেল সেকান্দারের কাছ থেকে জানতে পারলেন এটি কোন সাদামাটা শিকারের ব্যাপার নয়। এতে থাকবেন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা এবং কুমিল্লার ৫৩ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি। শ্রীমঙ্গলে নাসির উদ্দিন অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন যে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা টি রিসার্চ ল্যাবরেটরির যে ভিআইপি ভবনটিতে উঠলেন সেখানে একই সময় অবস্থান করছিলেন ড. কামাল হোসেন। এ প্রসঙ্গে মেজর নাসিরের (ড. কামাল তখন ভিআইপি ছিলেন না এবং ভবনটি ছিল সরকারী) লেখার অংশ বিশেষ হুবহু প্রকাশ করা হলো: ‘জেনারেল ইয়াকুব এবং জেনারেল রাজা টি রিসার্চ ল্যাবরেটরির যে ভিআইপি ভবনটিতে উঠলেন, উল্লেখযোগ্য সেখানে একই সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেন। শ্রীমঙ্গলে তিনি কবে এবং কেন এসেছেন সে ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই। আমি জানতে চেষ্টাও করিনি। তবে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক নেতাদের পাশাপাশি একই রেস্ট হাউসে একই সময়ে ড. কামাল হোসেনের মতো আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতার উপস্থিতি গোটা পরিবেশকে দৃশ্যত অর্থবোধক করে তোলে।’ (পৃষ্ঠা-১০৩)। ঐ অনুষ্ঠানটি যে নেহাতই শিকারের অনুষ্ঠান ছিল না, বরং এর পেছনে যে অন্য অকথিত উদ্দেশ্য ছিল তা মেজর (পরবর্তীতে) নাসিরের নি¤œলিখিত বাক্যগুলো থেকে পরিষ্কার: ‘এরপর প্রাতরাশ শেষে ক্লাবের খোলা বারান্দায় গিয়ে বসলেন তারা... কথা হচ্ছিল পাকিস্তানের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অসহিষ্ণু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে...। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফাভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের স্পর্ধিত ঘোষণাকে রীতিমতো দেশদ্রোহিতা বলেই আখ্যায়িত করলেন তারা। জেনারেল রাজা তার উত্তেজিত বক্তব্যের এক পর্যায়ে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) ২৫ ও ২৭ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ বাতিলের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে রাজি করাতে সর্বশক্তি প্রয়োগের অনুরোধ জানালেন জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে।...সব শুনে শেষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব খুব ধীরস্থির স্বরে সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, জেনারেল হামিদ এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই খুব সচেতন রয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় সব কিছু তিনি অবশ্যই করবেন। এই সময় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির চোখ পড়ল আমার দিকে। মনে হলো যেন তিনি খুব চমকে উঠেছেন আমাকে দেখে, একজন বাঙালী অধীনস্থ অফিসার তাদের এই অতি গোপন শলাপরামর্শ শুনছেÑ ব্যাপারটি যেন খুবই অনাকাক্সিক্ষত। ভ্রƒ কুঁচকে অত্যন্ত বিরক্তির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই তিনি কর্নেল সাগিরের উদ্দেশে স্বজাতীয় ভাষায় বললেন, তোমার এই ছোকরা এখানে কেন? ওকে এখনই চলে যেতে বল।... দোলই ভ্যালি ক্লাবের বারান্দায় খানিকক্ষণের জন্য হলেও আমি তাদের ষড়যন্ত্রের যে আলাপচারিতা শুনলাম তাতে আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, শেখ মুজিবকে কোন অবস্থায়ই ওরা ক্ষমতায় যেতে দেবে না। ...ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ সকালে আমি ও আমার কমান্ডিং অফিসার রংপুরের পথে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। (পৃষ্ঠা : ১০৫-১০৭)। নাসির উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে গমন বইটির লেখক, সেই (সময়ের) নাসির উদ্দিন জুন মাসে আরও দু’জন বাঙালী অফিসারসহ রংপুর সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে এবং তৎপর প্রত্যক্ষভাবে দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে যান। তার ক’দিন পূর্বে হাজারো জনতা রংপুর সেনানিবাস আক্রমণ করলে মেশিনগান দিয়ে তাদের পাখির মতোই হত্যা করা হয়, যে হত্যাযজ্ঞে অংশ নিয়েছিল দু’জন তথাকথিত বাঙালী অফিসার (১) ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ (যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্প্রতি অভিযুক্ত করা হয়েছে) এবং (২) ক্যাপ্টেন শহুদ (সেই ব্যক্তি খালেদা জিয়া যাকে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে বহাল করছিলেন; কিন্তু পরে আমার এক আদালত অবমাননা রুলে সাজা পেয়ে যিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন)। এছাড়া সেনানিবাসে নাসির উদ্দিনকেও নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে নাসির উদ্দিন মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জিয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মেজর নাসির জেনারেল খালেদ মোশারফের পক্ষ নেয়ার কারণে খুনি জিয়া তাকে কারাগারে পাঠান কয়েক বছরের জন্য। মেজর নাসির উদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। ড. কামাল সংযুক্ত পাকিস্তানের সংবিধান রচনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লন্ডন প্রবাসী পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এক সলিসিটারের (আগে ব্যারিস্টার ছিলেন) নাম আজিজ কুর্তা। ইংল্যান্ডে আজিজ কুর্তা এক সময় বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানেও একজন নামী ব্যারিস্টার ছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় আমার ব্যারিস্টারি পড়ার সময় থেকে। ২০০৫ সালে একদিন আমি, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির এবং সম্ভবত আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী প্রমুখ এক রাজনৈতিক সভা থেকে ফেরার সময় আজিজ কুর্র্তার সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাদের চা পানে আপ্যায়ন করেন। চায়ের টেবিলে কথা প্রসঙ্গে আজিজ কুর্তা বলেন, ’৭১-এ ভুট্ট, কুর্তা এবং ড. কামাল হোসেনকে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন সংযুক্ত পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র রেখে সেই ফেডারেশনের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করার। তারা উভয়েই তাতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। তাই ভুট্টর নির্দেশে কামাল ও কুর্তার প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। বঙ্গবন্ধু কেন ড. কামালকে নিয়ে এসেছিলেন? এটি সকলেরই প্রশ্ন। আমরা যতটুকু জেনেছি এটি ছিল ভুট্টর এক কৌটিল্য পদ্ধতির ষড়যন্ত্রের সফল ফসল। ভুট্ট ভেবেছিলেন তাদের দেশের জামাতা এবং তাদের নিজস্ব লোক বলে বিবেচিত ড. কামালকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে পাঠাতে পারলে পাকিস্তান লাভবান হবে। তাই তার এই ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু সবেমাত্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাছাড়া বিশাল হৃদয়ের এই মানুষের মহানুভবতা ছিল আকাশচুম্বী। তিনি কাউকে সন্দেহ করতে বা অবিশ্বাস করতে পারতেন না। তাই ভুট্টর ষড়যন্ত্রও তিনি আঁচ করতে পারেননি, যেমন পারেননি মোশতাক-জিয়া, তাহের ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম, মাহবুবুল আলম চাষীদের ষড়যন্ত্র, যেমন পারেননি ডালিমের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে, যে ডালিমকে তিনি ঘরের ছেলের মতো ¯েœহ করতেন। ড. কামালের ’৭৫ পরবর্তী ভূমিকা সম্প্রতি এক গোলটেবিল আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর অতি ঘনিষ্ঠজন ড. ফরাসউদ্দিন যথার্থই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় ড. কামালের হাত ছিল কিনা এটা খতিয়ে দেখা উচিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই যুক্তরাজ্যে ছাত্রলীগ (আমি সে সময় সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম) একটি সভা ডাকায় আমি এবং যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক আবুল হাসেম বহুবার ড. কামালকে অনুরোধ করার পরেও ড. কামাল সেই সভায় যোগ দেননি। তিনি তখন অক্সফোর্ডে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অবশ্য এসেছিলেন। এরপর বিশ্বখ্যাত আইরিশ মানবতাবাদী নোবেল লরিয়েট শোন মেকব্রাইটের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হলে ড. কামাল সেই তদন্ত কমিশনে থাকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে শোন মেকব্রাইটের নেতৃত্বে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়, যে পরিষদে আমিও ছিলাম। ছিলেন মাইকেল বার্নস, ছিলেন সর্বজনাব ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকী, সৈয়দ আশরাফ, ডাঃ সেলিম, ডাঃ জায়েদুল হাসান, এ্যাকাউনটেন্ট রউফ প্রমুখ। অন্য সবার নাম এখন মনে নেই। কিন্তু ড. কামাল ঐ পরিষদে যোগ দেয়ার প্রস্তাবও নাকচ করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি জোট বেঁধেছেন সেই দলের সঙ্গে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল নকশাকারী এবং সে দলের বর্তমান নেতা তারেক জিয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। সুতরাং ড. ফরাসউদ্দিনের দাবি অমূলক নয়। লেখক : সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
×